জাতি হারাল এক কৃতী সন্তানকে
বাংলাদেশের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমান গতকাল অপরাহ্ন ৩টা ১০ মিনিটে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। প্রাইভেট কারযোগে সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জের খড়িওয়ালা নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
রাস্তার ওপর একটি গরুকে পাশ কাটাতে গিয়ে তাকে বহনকারী গাড়িটি চালকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। এসময় প্রাকৃতিক কারণে খাল-বিল, খানা-খন্দ পানিতে টইটম্বুর থাকে। তাকে বহনকারী গাড়িটি খাদে পড়ে পানিতে ডুবে গিয়েছিল। এম সাইফুল রহমান বার্ধক্যের কারণে শারীরিকভাবে অশক্ত ছিলেন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হচ্ছিল। এ দুর্ঘটনার ধকল তার শরীর সহ্য করতে না পারায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে জাতি যে এক কৃতী সন্তানকে হারিয়েছে-একথা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করবেন। নেতিবাচক রাজনীতির তিক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত সত্ত্বেও আমাদের দেশে যে গুটিকয়েক রাজনীতিক সব মহলের শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পেরেছিলেন, সাইফুর রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম। একজন প্রাজ্ঞ ও বাস্তববাদী অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তার খ্যাতি ছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল এবং বেগম খালেদা জিয়ার আমল মিলিয়ে তিনি মোট ১২ বার জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন। এটি একটি বিরল সাফল্য। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার সূচনা এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থার বিকাশ তার হাত দিয়েই হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে সাইফুর প্রবর্তিত ধারায় পরিচালিত হচ্ছে বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে মুক্ত অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় যে দু'জন অর্থমন্ত্রী সবচেয়ে সার্থক ভূমিকা পালনের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এদের একজন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং অপরজন আমাদের সাইফুর রহমান। এম সাইফুর রহমান ১৯৩২ সালে তার নানার বাড়ি মৌলভীবাজারের বাহারমর্দান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন। অথচ ভাষাসৈনিক হিসেবে তাকে কখনও অহঙ্কার করতে কেউ দেখেননি। একজন অতি দক্ষ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে তিনি ছিলেন দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তার প্রতিভার ব্যাপারে আস্থাবান হয়ে জিয়াউর রহমান তাকে কাছে টেনে নেন। সেই থেকে তিনি একজন বোদ্ধা রাজনীতিক হিসেবে জাতীয়তাবাদী ধারার পতাকা বহন করে আসছিলেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। মৃত্যুর আগেরদিন 'বিএনপি ফুরিয়ে যায়নি' বলে তার দৃপ্ত ঘোষণা জাতীয়তাবাদী ঘরানার নেতাকর্মী-সমর্থকদের নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। এমন এক সময়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন যখন তার মতো একজন নেতার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে দক্ষ অর্থনীতিবিদ, দক্ষ রাজনীতিক ও দক্ষ প্রশাসক। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। আমরা মরহুম এম সাইফুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং তার পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যদের জনাই গভীর সমবেদনা।
No comments