বাংলাদেশ কি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে যাবে? by মাহফুজ উল্লাহ
গত কয়েকদিনের কয়েকটি ঘটনা জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই এ নিয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচনা হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। বিষয়গুলো খুব সাধারণ ঘটনা হলে হয়তো আলোচনার কারণ হতো না কিংবা সরকারের মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কেউই জড়িয়ে পড়তেন না। যারা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন তাদের চোখে হয়তো এসব নেহাতই আইন-শৃঙ্খলার ঘটনা।
কিন্তু যারা এসব ঘটনার শিকার তারা তো চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী বা অপরাধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। গ্রান্ড আজাদ হোটেলের মালিক আবুল কালাম আজাদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ নিজ নিজ যোগ্যতার কারণে এই সমাজে পরিচিত নাম। দু'জনের জগৎ ভিন্ন। কিন্তু কর্মের কারণে তারা জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আজাদ প্রোডাক্টসের মালিক খুব ছোট অবস্থা থেকে উপরে উঠে এসেছেন এবং এই উঠে আসার প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই হয়তো তার এই সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। কিন্তু বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কার্ড বিতরণের যে সংস্কৃতি এদেশে চালু হয়েছে তার বদৌলতে এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই আজাদ প্রোডাক্টসের পণ্যের সঙ্গে পরিচিত। সম্ভবত ব্যবসায়িক সাফল্য এবং নিয়মিত কর প্রদানের কারণে তিনি সিআইপি বা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সরকারি মর্যাদাও পেয়েছিলেন। সেই আজাদ প্রোডাক্টসের মালিককে যখন ধরে নেয়ার পর আবার রিমান্ডে পাঠানো হয় তখন বিস্ময়ের শেষ থাকে না। বিষয়টি যতটা না বিস্ময়ের, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগের। কথিত অপরাধের কারণে জনাব আজাদের মতো মানুষ যদি হেনস্থা হতে পারেন তাহলে সাধারণ নাগরিকরা কী ধরনের অস্বস্তি ভোগ করছেন তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এর পরের ঘটনাটি ঘটেছে আনু মুহাম্মদকে কেন্দ্র করে। এক সময়ের সহকর্মী, অনুজপ্রতিম আনু মুহাম্মদ ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনের কারণে ঢাকা শহরে হয়তো লক্ষাধিক লোকের মিছিল হয়নি, কিন্তু জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণের প্রশ্নে তৈরি হয়েছে জনউদ্বেগ। হাল আমলে এ দেশের মানুষ বিভিন্ন বিষয়ের নিরাপত্তা সম্পর্কে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা শুনছেন। তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জ্বালানি নিরাপত্তা। সাংবিধানিকভাবে দেশের যে সম্পদের মালিক জনগণ তার ব্যবহারের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে দ্বিমত থাকতে পারে; কিন্তু জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এ সম্পদের ব্যবহার প্রশ্নে খুব একটা দ্বিমতের অবকাশ নেই। আনু মুহাম্মদ জাতীয় সম্পদ রক্ষার মিছিলে আহত হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। কিন্তু অপরাধীর দুর্নাম তাকে সপর্শ করতে পারেনি। ঘটনা নিয়ে আনু মুহাম্মদের দুঃখ করে লাভ নেই। তিনি যে বিষয়ে শিক্ষকতা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে বিষয়েরই প্রবাদপুরুষ শিক্ষক ড. আবু মাহমুদ চার দশকেরও বেশি সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে যাওয়ার পর আদালত প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন ও মার খেয়েছিলেন। সেদিন ড. আবু মাহমুদের ওপর হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান সরকারের উর্দিবিহীন পোষ্য গুন্ডারা। তাদের সবই ছিল, কিন্তু পোশাক ছিল না। আবুল কালাম আজাদ এবং আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা একটি মৌলিক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে, এটি কি সেই ধরনের রাষ্ট্র যেখানে সরকার জনগণের সব ধরনের কর্মকান্ডের ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে? এ ধরনের রাষ্ট্রকে ইংরেজি ভাষায় পুলিশ সেটট বা বাংলায় পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রে আইন এবং নির্বাহী বিভাগের যে ক্ষমতা তার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। পুলিশি রাষ্ট্রে জনগণ যেসব কর্মকান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ সহ্য করেন, তেমন একটি ছিল তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচি। রাজনীতি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় পুলিশি রাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে-জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ব্যক্তির শাসন সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করে এবং এই সার্বভৌম ক্ষমতা পর্যবসিত হয় স্বৈরাচারী শাসনে। অবশ্য শাসনভেদে এ অবস্থার তারতম্য ঘটে। যেমন এক সময় সিঙ্গাপুরকেও পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হতো। এই দুর্নামের ভাগ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা বা হিটলারের জার্মানিও বাদ যায়নি। হাল আমলে পৃথিবীর দুটি বড় দেশ সম্পর্কে পুলিশি রাষ্ট্র বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রশ্ন তুলেছিল যুক্তরাজ্যের পুলিশি রাষ্ট্র বনে যাওয়া সম্পর্কে। সে অবস্থাটা ছিল টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া। তারও আগে, ২০০২ সালের ২৭ জুন মার্কিন কংগ্রেসম্যান রন পল প্রশ্ন তুলেছিলেন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছে? টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানুষের চলাচল ও কথাবার্তা-এসবের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে তার কারণে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কেও এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন নির্যাতক সংস্থা বিভিন্ন সময়ে মাঠে নেমেছে। সেনাবাহিনী ছাড়া অন্যরা নেমেছে অসামরিক প্রশাসনের আদেশ ও নির্দেশে। গণতান্ত্রিক লেবাসে এসব বাহিনী জনগণের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে সেসবের অনেক কিছুই পুলিশি রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের ভোগ করতে হয়। আর সেসব নির্যাতনের প্রায় অনেকগুলোই এদেশের মানুষ ভোগ করেছেন। সাংবিধানিক অনেক অধিকার তারা বিভিন্ন সময়ে ভোগ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো সরকার আসেনি যে আমলে মানুষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা ভোগ করেছেন। এক্ষেত্রে অপরাধীদের বিষয়টি ভিন্ন। অবশ্য অপরাধীদের প্রাপ্ত শাস্তি সম্পর্কেও দ্বিমত আছে। যে কারণে ক্রসফায়ারে মৃত্যু নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যত সোচ্চার, সাধারণ মানুষ ততটা নন। নিজেদের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যদি প্রতিবাদ জানানোর অধিকার না থাকে তাহলে জনগণের কাছে কী বিকল্প থাকতে পারে! দেশ স্বাধীন হয়েছে, সরকার বদলেছে, নেতৃত্বের অপসারণ হয়েছে এবং দু'জন জননন্দিত নেতা নিহত হয়েছেন। কিন্তু মানুষের আন্দোলনের ওপর নির্যাতনের যে ছন্দ তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এই নির্যাতনের কারণে পাকিস্তান আমলে শুরুর দিকে কমিউনিসট নেতা হাছান নাসির জেলেই মারা গেছেন। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দিদের গুলি করে মারা হয়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহে নেতৃত্বদানের অপরাধে ইলা মিত্রসহ অনেকে শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের। এ তালিকা অনেক দীর্ঘ। কখনও কখনও এসব বাহিনীর সদস্যরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু বাড়াবাড়ি করলেও তারা যে নির্বাহী বিভাগের আদেশে এসব কাজ করেছেন, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এ কারণেই নাগরিকদের প্রশ্ন-সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ কোথায়? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৮৬৫ সালে অষ্ট্রিয়ায় পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করার পর পুলিশি রাষ্ট্র শব্ধটির উদ্ভব ঘটে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এমন ধরনের নিন্দার ভাগী হতে চায় না। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের অলিখিত নির্দেশের কারণে বাড়াবাড়ি ঘটে এসব কর্মকান্ডের। এদেশের সংবাদপত্রের পাঠক ও টেলিভিশন দর্শকদের সমৃতিতে একটি দৃশ্য অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর তা হচ্ছে, এক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তী সরকারের আমলে রাস্তায় লাঠিপেটার শিকার হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ব্যাপারটি নিশ্চয় খুব সুখকর ছিল না এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে কোনো অগ্রগতি নয় বরং পিছিয়ে পড়ার প্রতীক। আনু মুহাম্মদের সৌভাগ্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না এবং তেমনটা হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনাও নেই। তবে তার কোনো ছাত্র কখনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যেতে পারেন। উপরে উল্লিখিত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে অপবাদ বাংলাদেশের কপালে জুটেছে তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। সেই নিন্দা থেকে অব্যাহতি পেতে হলে নির্বাহী বিভাগকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে, হতে হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মনে রাখতে হবে ভবিষ্যতে পিটুনি খাওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি। লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক
No comments