সাইফুর রহমান একশ বছরের গর্ব by ফেরদৌস সালাম
বাংলাদেশের 'তলাবিহীন ঝুড়ির' অর্থনীতিকে যিনি স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য যে ধরনের সততা, দক্ষতা ও প্রশাসনিক নিয়মশৃঙ্খলার প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন তার ব্যাপক অভাব ছিল। বরং ক্ষমতাসীন মহলের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে নেমে এসেছিল মারাত্মক বিপর্যয়।
আন্তর্জাতিকভাবে এ দেশের পরিচিতি জুটেছিল 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে। পরবর্তী পর্যায়ে জিয়ার কেবিনেটের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মেধা, দক্ষতা ও সুপরিকল্পনা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সচল করে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক ফোরামেও বিষয়টির মূল্যায়ন হয়েছিল। এরশাদ সরকারের আমলের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। '৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা সরকারের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে সমস্যাকে চিহ্নিত করেন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে তিনি প্রথমেই বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। তার এই পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। রাতারাতি পরিবর্তন না এলেও বলা চলে অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছিল, ফিরে এসেছিল কাজের সুষ্ঠু পরিবেশও। শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই নয়, বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচনের প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি অত্যন্ত সুসপষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিকে মানব কল্যাণের অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। তিনি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক ধারণাও দিয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত একটি দেশ, গত দশকেও যার পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল 'ভিক্ষুকের দেশ'- সেই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের ঈর্ষণীয় মেধা, জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণে বিশ্বের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও চমৎকৃত হয়েছেন। তারা অনুভব করেছেন, বাংলাদেশের মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া একটি বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে গতিশীল নেতৃত্ব দিয়ে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসা মোটেই চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাঁর সঠিক পদক্ষেপের কারণেই অর্থনৈতিক সেক্টরে গতিশীলতা এসেছে, সূচিত হয়েছে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত। বলা বাহুল্য, তাঁর সপর্শে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা দুর্বল অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে গিয়েছিল। প্রতিযোগিতার বিশ্ব থেকে যে বাংলাদেশ ছিটকে পড়েছিল, সে দৌড় প্রতিযোগিতার ট্র্যাকে ফিরে এসেছিল- জনগণ ফিরে পেয়েছিল মনোবল। আর এটি সম্ভব হয়েছিল অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানেরই আন্তরিক পরিশ্রমের কারণে। তিনি তার মেধা, পরিশ্রম এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মতো গতিশীলতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তলাবিহীন ঝুড়ি ও ভিক্ষুকের দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে আসার স্বীকৃতিসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার নেতৃত্ব দেয়ার ফলে অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ১৯৯৩ সালে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক সংস্থা। বর্তমানে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫০। দেশ ও ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণের পরই সাধারণত কোনো দেশের অর্থমন্ত্রী এ পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হন। বিশ্লেষণ করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থনৈতিক চিন্তাধারা কতটা সুদূরপ্রসারী। সেসময় তাদের বিশ্লেষণ ছিল, বাংলাদেশ অনুন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। তার চেয়েও বড় বিষয় ছিল এম. সাইফুর রহমানের মুক্ত অর্থনৈতিক চিন্তা বিশ্বের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সময়োপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কারণ, তিনি সপষ্ট উচ্চারণ করেছেন, 'দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রাধান্য দিয়েই বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।' বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান এম. সাইফুর রহমান তাদের রায়েই সেদিন লাভ করলেন বিরল সম্মান। এ অঞ্চলে প্রায় ৪৫ বছর আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী বোর্ড অব গভর্নরস-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের পরিধি এবং কার্যকারিতা এত বেশি প্রভাবশালী ছিল না। এ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেমন-জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে ন্যায়নীতি ও বিশ্বের সমস্যা অনুধাবনে এম. সাইফুর রহমান যেমন আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার রক্ষায় তার আন্তরিকতা ও স্বচ্ছ নেতৃত্বই সেদিন তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে এ পদে নির্বাচিত হওয়ার সম্মানে সম্মানিত করেছে। এই প্রাপ্তি দিয়ে তিনি শুধু বাংলাদেশের মানুষকেই গর্বিত করেননি, সমগ্র এশিয়ার জনগোষ্ঠীর জন্য ও বয়ে এনেছিলেন দুর্লভ সম্মান। জনগণের রায়ে সে সময় বিএনপি সরকার গঠনের পর অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন। তিনিই সম্ভবত সমকালীন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, যিনি সরকারি কর্মচারীদের ব্যর্থতার কথা, মন্ত্রণালয়ের এবং অর্থায়ন সেক্টরের শীর্ষ ব্যক্তিদের দুর্নীতির কথা অকপটে তুলে ধরতেন সবসময়। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল না। দেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তার অনেক বক্তৃতা-বিবৃতিকে সমালোচকরা ফাঁকা বুলি বলে সমালোচনা করলেও তিনি পিছপা হননি। অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি তার জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। তিনি তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছিলেন। সরকারের কর ব্যবস্থার উন্নয়নে তীব্র আন্দোলনের মুখেও ভ্যাট সিষ্টেমকে চালু করে এক্ষেত্রে কর ফাঁকি রোধ ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিকে নিশ্চিত করেছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর মুহূর্তেও তিনি কম বিরোধিতার সম্মুখীন হননি। কিন্তু এর বাস্তবায়নে তিনি অনড় ছিলেন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশ আজ বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর মুক্তবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তার এই পদক্ষেপ দেশের উন্নয়নকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী অনিয়মতান্ত্রিক শ্রমিক-কর্মচারী রাজনীতির স্বেচ্ছাচারিতাকেও তুলে ধরেছেন সপষ্টভাবে। তিনি বলেছেন, এদেশের তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের কাছে কলকারখানা এবং দেশ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এর ফলে এখানে শিল্পের বিকাশ অনেকটা রুদ্ধ। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখানকার কলকারখানায় ঘন ঘন হরতাল-ধর্মঘট দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত। এ ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ ধরনের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। জনগণের লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে ব্যাংকিং সময়সূচির বৃদ্ধি করেছিলেন। শিল্পখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অর্থমন্ত্রী ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বিশেষ খাতে বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সুবিধাও দেয়া হয়েছিল। সাইফুর রহমান কর্তৃক মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু, ভ্যাট প্রবর্তন এবং অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা ও কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। এম. সাইফুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, তিনি তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের অগ্র সেনানী হিসেবে কাজ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। উন্নয়নশীল বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংস্থানের অভাব, নিরক্ষরতা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কালোছায়ায় আক্রান্ত। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে তা অতিক্রম করার সঠিক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। পাশাপাশি শিল্পোন্নত বাংলাদেশ করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নেও তিনি ছিলেন তৎপর। এতে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল। পাঁচবারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার প্রচেষ্টায় নিজেকে অব্যাহত রেখেছিলেন। সব সময় এরই লক্ষ্য হিসেবে তার সর্বশেষ উদ্যোগ ছিল কনভার্টিবিলিটি অব টাকা কার্যক্রম। এতে বিশ্ববাজারের টাকার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পেয়েছে। এশিয়ার সফল অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান মুক্তবাজার অর্থনীতি, ভ্যাট এবং 'কনভার্টিবিলিটি অব টাকা' দ্বারা যে উন্নয়ন অর্থনীতির সূচনা করেছিলেন, তা-ই একদিন অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে আসবে, যা আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।
No comments