ধূমপান ছেড়ে স্বপ্নের দেশ গড়ার সংগ্রামে ১৩ বন্ধু by কুদ্দুস বিশ্বাস
মানুষের বিপদে ছুটে যাওয়া, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো সহমর্মিতা আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না। আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে সবাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার খবর এখন খুব একটা শোনা যায় না। তবুও বিরলে এমন অনেক মানুষের খোঁজও মেলে, যাঁরা দেশের জন্য, দশের জন্য নিজেকে কাজে লাগান। স্বপ্নের দেশ গড়ে তোলার চেষ্টায় তাঁরা হাত লাগান তাঁদের চারপাশের মানুষের অবস্থার উন্নয়নের কাজে। সামান্য সহযোগিতায় প্রায়ই বদলে যেতে দেখা যায় বহু মানুষের ভাগ্য।
সেই রকম লক্ষ্য নিয়েই সুদূরপ্রসারী এক স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে নিবেদিত রৌমারীর প্রত্যন্ত গ্রামের ১৩ বন্ধুর একটি দল। চারপাশের যত ক্লেদ, যত গ্লানি_সব মুছে দিয়ে অন্য রকম এক দেশ গড়ার শপথ নিয়ে তাঁরা সতত নিয়োজিত কল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।
ওঁরা ১৩ বন্ধু : আলমগীর হোসেন (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত), শফিকুল ইসলাম (শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ), বজলুর রশীদ দুলাল (শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), জিয়াউর রহমান (শিক্ষক), রায়হানুল ইসলাম (শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), মাইদুল ইসলাম (প্রবাসী), আবদুর রহমান (প্রবাসী), নুর আলম (শিক্ষার্থী, রৌমারী ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়), আনারুল ইসলাম (শিক্ষার্থী, কৃষি ডিপ্লোমা), ইসলাম উদ্দিন (ব্যবসায়ী), ছাইদুর রহমান (শিক্ষার্থী, টঙ্গী সরকারি কলেজ), সিরাজুল ইসলাম (শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), আসাদুজ্জামান (শিক্ষার্থী, করটিয়া সা'দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ)। এই তরুণদের বাড়ি রৌমারী উপজেলার চতলাকান্দা, ওকড়াকান্দা, বাউসমারী, শৌলমারী ও বোয়ালমারী গ্রামে।
যেভাবে শুরু : ওই ১৩ বন্ধুর মধ্যে শফিকুল ইসলাম জানান শুরুর গল্পটা। 'এক ঈদে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথাবার্তায় জানা গেল, বোয়ালমারী গ্রামের এক মেধাবী ছাত্র স্কুলজীবন থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তার আর লেখাপড়া হয়নি। আরো আলাপ করছিলাম আশপাশের গ্রামের শিশুরা স্কুলে যায় না_এ বিষয়ে। অসচেতন অভিভাবকরাও এ বিষয়ে সচেতন নন। এসব নানা কথাবার্তার একপর্যায়ে আমরা ১৩ জন একমত হই, নিজেরা জীবনে কখনো ধূমপান করব না। ওই সময় একজন প্রস্তাব দিল, প্রতি মাসে ধূমপানের পেছনে যে টাকা ব্যয় হয়, সেই টাকা দিয়ে গ্রামের অভাবী মানুষের জন্য কিছু করা যায় কি না। সবাই একমত পোষণ করল। হাতে হাত রেখে আমরা শপথ করলাম, ধূমপান করব না। সিগারেটের পেছনে যে টাকা খরচ হতো, তা জমা করে আর্তমানবতার সেবায় কাজ করব।' ব্যস, শুরু হয়ে গেল নতুন অধ্যায়। ১৩ বন্ধু তাঁদের গ্রামের নাম অনুসারে 'চতলাকান্দা, ওকড়াকান্দা, বাউসমারী, বোয়ালমারী, শৌলমারী সোশ্যাল অ্যাসোসিয়েশন', সংক্ষেপে কোবসা নামের একটি সংগঠন গড়ে তুললেন। ২০০৬ সালের জুন মাসের ১ তারিখ কোবসার আত্মপ্রকাশ। তার পর থেকে কেবলই এগিয়ে চলা।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের কোনো মেয়ের টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না, এমন খবর পেলে ছুটে যাবেই ১৩ বন্ধুর দলটি। উদ্যোগ নেবে সমস্যাটি সমাধানের। প্রয়োজনে বিয়ের খরচের টাকা সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি নিজেরা উপস্থিত থেকে ধুমধাম করে আয়োজন করেন বিয়ের অনুষ্ঠানও। সংগঠনের সভাপতি আলমগীর হোসেন জানান, অভাবী দিনমজুর ঘরের শিশুরা যাতে স্কুলে যায় এবং ঝরে না পড়ে, এ নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা হয়। শিশুর মায়েদের নিয়েও আলোচনা করা হয়। বাড়িতে শিশুরা যাতে ঠিকমতো পড়াশোনা করে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে।
এ ছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা হয় গ্রামের মানুষকে। প্রতিবছর সংগঠনের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে গাছের চারা বিতরণ করা হয়ে থাকে। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বন্ধে তাঁরা গ্রামের মানুষকে উৎসাহিত করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার সুবাদে ওই পাঁচ গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। যারা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণের খরচ জোগাতে পারে না, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়।
'ওদের দেখে বুকটা ভরে যায়' : চতলাকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ বলেন, 'এই ছেলেরা যে এত ভালো ভালো কাজ করবে, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াবে, তা প্রথমে আমার বিশ্বাসই হয়নি। কিন্তু সত্যি সত্যি তাদের এ কর্মকাণ্ডের খবর শুনে এখন আমার বুকটা আনন্দে ভরে যায়। আমার দুই ছেলে ওই সংগঠনের সদস্য। আমি তাদের ভালো কাজে উৎসাহ দেই এবং তাদের সঙ্গে থাকি।' বাউসমারী গ্রামের রেজা আহম্মেদ রিপন বলেন, 'ওই ১৩ বন্ধুর কারণে গ্রামের ঘরে ঘরে পাকা পায়খানা, বাড়িতে বাড়িতে নানা প্রজাতির গাছ শোভা পাচ্ছে। ওই কয়েক গ্রামে কোনো বাল্যবিবাহ বা যৌতুক দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি বিগত পাঁচ বছরে।'
বোয়ালমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসরাত জাহান বলেন, '১৩ বন্ধুর কারণে আমাদের কয়েক গ্রামে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। উপজেলার মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এখন গ্রামের মানুষ যতই গরিব হোক, অন্তত ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়।'
কোবসার উপদেষ্টা রৌমারী সিজি জামান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু হোরায়রা বলেন, 'ওরা ১৩ জন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওদের কাজ দেখেশুনে আমি অবাক হয়ে যাই। আমিও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি। এই কয়েক বছরে ওরা অনেক ভালো কাজ করেছে, যা অনুকরণীয়।'
শেষ কথা : সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমরা ১৩ বন্ধু প্রায় সমবয়সী। একেকজন একেক স্থানে লেখাপড়া, চাকরি বা ব্যবসা করলেও আমাদের সংগঠনটি অটুট থাকবে। এ শপথ আমরা শুরুতেই নিয়েছি। সংগঠনের কাজই হলো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকা। কিন্তু আমাদের জমানো টাকার পরিমাণ কম থাকায় ইচ্ছা থাকার পরও অনেক সময় হোঁচট খাই। গ্রামেরই বিত্তবান মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। ভবিষ্যতে আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যত্রও সহযোগিতার হাত বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।'
যেভাবে শুরু : ওই ১৩ বন্ধুর মধ্যে শফিকুল ইসলাম জানান শুরুর গল্পটা। 'এক ঈদে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথাবার্তায় জানা গেল, বোয়ালমারী গ্রামের এক মেধাবী ছাত্র স্কুলজীবন থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তার আর লেখাপড়া হয়নি। আরো আলাপ করছিলাম আশপাশের গ্রামের শিশুরা স্কুলে যায় না_এ বিষয়ে। অসচেতন অভিভাবকরাও এ বিষয়ে সচেতন নন। এসব নানা কথাবার্তার একপর্যায়ে আমরা ১৩ জন একমত হই, নিজেরা জীবনে কখনো ধূমপান করব না। ওই সময় একজন প্রস্তাব দিল, প্রতি মাসে ধূমপানের পেছনে যে টাকা ব্যয় হয়, সেই টাকা দিয়ে গ্রামের অভাবী মানুষের জন্য কিছু করা যায় কি না। সবাই একমত পোষণ করল। হাতে হাত রেখে আমরা শপথ করলাম, ধূমপান করব না। সিগারেটের পেছনে যে টাকা খরচ হতো, তা জমা করে আর্তমানবতার সেবায় কাজ করব।' ব্যস, শুরু হয়ে গেল নতুন অধ্যায়। ১৩ বন্ধু তাঁদের গ্রামের নাম অনুসারে 'চতলাকান্দা, ওকড়াকান্দা, বাউসমারী, বোয়ালমারী, শৌলমারী সোশ্যাল অ্যাসোসিয়েশন', সংক্ষেপে কোবসা নামের একটি সংগঠন গড়ে তুললেন। ২০০৬ সালের জুন মাসের ১ তারিখ কোবসার আত্মপ্রকাশ। তার পর থেকে কেবলই এগিয়ে চলা।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের কোনো মেয়ের টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না, এমন খবর পেলে ছুটে যাবেই ১৩ বন্ধুর দলটি। উদ্যোগ নেবে সমস্যাটি সমাধানের। প্রয়োজনে বিয়ের খরচের টাকা সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। এমনকি নিজেরা উপস্থিত থেকে ধুমধাম করে আয়োজন করেন বিয়ের অনুষ্ঠানও। সংগঠনের সভাপতি আলমগীর হোসেন জানান, অভাবী দিনমজুর ঘরের শিশুরা যাতে স্কুলে যায় এবং ঝরে না পড়ে, এ নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা হয়। শিশুর মায়েদের নিয়েও আলোচনা করা হয়। বাড়িতে শিশুরা যাতে ঠিকমতো পড়াশোনা করে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে।
এ ছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা হয় গ্রামের মানুষকে। প্রতিবছর সংগঠনের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে গাছের চারা বিতরণ করা হয়ে থাকে। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বন্ধে তাঁরা গ্রামের মানুষকে উৎসাহিত করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার সুবাদে ওই পাঁচ গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। যারা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণের খরচ জোগাতে পারে না, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়।
'ওদের দেখে বুকটা ভরে যায়' : চতলাকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ বলেন, 'এই ছেলেরা যে এত ভালো ভালো কাজ করবে, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াবে, তা প্রথমে আমার বিশ্বাসই হয়নি। কিন্তু সত্যি সত্যি তাদের এ কর্মকাণ্ডের খবর শুনে এখন আমার বুকটা আনন্দে ভরে যায়। আমার দুই ছেলে ওই সংগঠনের সদস্য। আমি তাদের ভালো কাজে উৎসাহ দেই এবং তাদের সঙ্গে থাকি।' বাউসমারী গ্রামের রেজা আহম্মেদ রিপন বলেন, 'ওই ১৩ বন্ধুর কারণে গ্রামের ঘরে ঘরে পাকা পায়খানা, বাড়িতে বাড়িতে নানা প্রজাতির গাছ শোভা পাচ্ছে। ওই কয়েক গ্রামে কোনো বাল্যবিবাহ বা যৌতুক দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি বিগত পাঁচ বছরে।'
বোয়ালমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসরাত জাহান বলেন, '১৩ বন্ধুর কারণে আমাদের কয়েক গ্রামে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। উপজেলার মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এখন গ্রামের মানুষ যতই গরিব হোক, অন্তত ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়।'
কোবসার উপদেষ্টা রৌমারী সিজি জামান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু হোরায়রা বলেন, 'ওরা ১৩ জন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওদের কাজ দেখেশুনে আমি অবাক হয়ে যাই। আমিও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি। এই কয়েক বছরে ওরা অনেক ভালো কাজ করেছে, যা অনুকরণীয়।'
শেষ কথা : সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমরা ১৩ বন্ধু প্রায় সমবয়সী। একেকজন একেক স্থানে লেখাপড়া, চাকরি বা ব্যবসা করলেও আমাদের সংগঠনটি অটুট থাকবে। এ শপথ আমরা শুরুতেই নিয়েছি। সংগঠনের কাজই হলো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকা। কিন্তু আমাদের জমানো টাকার পরিমাণ কম থাকায় ইচ্ছা থাকার পরও অনেক সময় হোঁচট খাই। গ্রামেরই বিত্তবান মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। ভবিষ্যতে আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যত্রও সহযোগিতার হাত বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।'
No comments