বিএনপি’র ইফতারে রাজনৈতিক দলের মিলনমেলা
ইফতার পূর্ব আলোচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে তারেক রহমান বলেন, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অপতৎপরতা এবং চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে উগ্রবাদী জনগোষ্ঠী এবং পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তি দেশে পুনরায় গণতন্ত্রের কবর রচনা করবে। অপরদিকে গণতান্ত্রিক বিশ্বে ইমেজ সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। দেশের অসম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চরিত্র সমুন্নত রাখতে চরমপন্থা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী অপশক্তিতে প্রতিহত করার পাশাপাশি গণহত্যাকারী পলাতক মাফিয়া চক্রকে যেকোনো মূল্যে বিচারের সম্মুখীন করার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা শক্তিশালী করাই হবে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির আগামী দিনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সকলের চিন্তা, ভাবনা হয়তো এক নয়। আমাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তা রয়েছে, ভিন্ন দল-মত-দর্শন রয়েছে। তবে মতে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু সবাই একসঙ্গে বসেছি। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। এটি আবহমানকালের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এক অনন্য প্রতিফলন। তবে দুঃখজনকভাবে গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন শোষণে দেশের শুধুমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়নি, বরং বাংলাদেশের আবহমানকালের ধর্মীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সামাজিক সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে নষ্ট করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জুলাই আগস্টে বীর জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে মাফিয়া সরকার পালিয়েছে। মাফিয়া সরকারের পতনের পর সাত মাস পার হয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক মাফিয়া শাসন শোষণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ মেরামতের জন্য হয়তো এটা খুব বেশি সময় নয়। তবে আগামী দিনগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম কিংবা কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা জনগণের সামনে আরও স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হলে জনমনে থাকা সকল সন্দেহের অবসান হতো।
তারেক রহমান বলেন, শুধুমাত্র একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই মাফিয়া সরকারের পতন ঘটেনি-এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও আরও চরম সত্য হয়তো একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন না করার জন্যই মাফিয়া সরকারের নির্মম পতন হয়েছিল। সুতরাং একটি নির্বাচনকে শুধুমাত্র কোনো একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করার অবকাশ নেই। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সুযোগ পান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ এবং সরকার গঠিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সর্বোপরি, প্রতিটি সফল ও কার্যত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের চুক্তি, নবায়িত রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের মালিকানা সম্পর্ক গভীরতর হয়। রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সোচ্চার।
তিনি বলেন, বিএনপিসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দল মনে করে, সংস্কার এবং নির্বাচন উভয়টি প্রয়োজন। সুতরাং সংস্কার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করার কোনোই প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করার উপায় শুধুমাত্র সংস্কারের উপরে নির্ভর করে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হয় প্রতিদিনের গণতান্ত্রিক চর্চার উপরে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্র এবং সরকার পরিচালনা করেন। জনগণের বিচার বুদ্ধির ওপরে আস্থাহীনতার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে দুর্বল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিভিন্ন খাতের সংস্কার প্রস্তাবগুলো ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে। আমি অনুরোধ করবো এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে মতামত দেয়ার। যাতে সবাইকে নিয়ে সামনের পথ এগোতে পারি। তিনি বলেন, আজকে আমরা অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করছি। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশ পেলেও এখনো গণতন্ত্রের দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মূল আকাঙ্ক্ষা। ঐক্যে জোর দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এই মুহূর্তে ঐক্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো নিরসন করা। বিএনপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে দলের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার বিকল্প নেই বিএনপি মহাসচিব বলেন, দ্রুত নির্বাচনের কথা পরিষ্কারভাবে বলছি কারণ জনগণের নির্বাচিত সরকার গঠন করা যায়। নির্বাচিত সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দোসররা বিভিন্ন জায়গায় রয়ে গিয়েছে। আমরা যেটা বলেছি, ফ্যাসিবাদী সিস্টেমটা পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব আগামীতে যার হাতেই যাক না কেন, একটি পরিবর্তিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। তিনি বলেন, একটি কথা বলা হচ্ছে যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন (ইনক্লুসিভ ইলেকশন), আমি মনে করি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার মতো, দেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো রাজনৈতিক দল বা পক্ষ বাংলাদেশে রয়েছে। ৫ই আগস্ট যে শক্তিকে বাংলাদেশের মানুষ পরাজিত করেছে, মুজিববাদ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করেছে, আগামীতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি ও নির্বাচনে সেই মুজিববাদী রাজনীতির কোনো স্থান হবে না। এনসিপি’র আহ্বায়ক বলেন, একটি বিচার প্রক্রিয়া চলমান আছে, সেই বিচারের আগে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রশ্নই উঠে না। আমি রাজনৈতিক দলের প্রতি এই আহ্বানটাও রাখবো যেন এই বিষয়ে আমরা একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসতে পারি। আমরা সবসময় এমন এক বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছি, যেখানে রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, নীতিগত পার্থক্য, সমালোচনা থাকবে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে বসতে পারবো, আলোচনা করতে পারবো দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে। নাহিদ ইসলাম বলেন, যখন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বসার মতো অবস্থা থাকে না, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে যদি অনৈক্য তৈরি হয় সেখানে অরাজনৈতিক শক্তিগুলো সুযোগ সন্ধানী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, এটা হয়েছে। আমরা মনে করি এখন যে পরিবেশ, পরিস্থিতি রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক ঐক্যটা থাকবে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আজকে বাংলাদেশ একটা পরীক্ষার মাঝে অগ্রসর হচ্ছে। ৫ই আগস্টে আমরা একটি বিশাল সফলতা পেয়েছিলাম। তার মূল ছিল সকল শ্রেণির মানুষের ঐক্য। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার জন্য এখনো জাতীয় ঐক্যই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ঐক্য রেখেই যার যার জায়গা থেকে যেটি প্রয়োজন, সেটি অবশ্যই আমরা এখানে ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করবো। জামায়াতের পক্ষ থেকে চারটি পয়েন্টে জাতীয় ঐক্যের জন্য আমি সকলের কাছে অনুরোধ জানাই। এক. বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, এখানে কোনো আপস হবে না, দুই. একটি টেকসই গণতন্ত্র, তিন. একটি ফেয়ার নির্বাচন, চার. দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু’র সঞ্চালনায় ইফতার মাহফিলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বক্তব্য রাখেন। দোয়া পরিচালনা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মামুনুল হক।
ইফতার মাহফিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, জেএসডির সিনিয়র সহ সভাপতি তানিয়া রব, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত চৌধুরী, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান আব্দুর রকিব, বিএলডিপি’র সভাপতি শাহদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, এনপিপি’র চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের জোট এবং দলগুলোর নেতারাও ইফতার মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি’র নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা ইফতারে উপস্থিত ছিলেন।
No comments