উত্তেজনাপূর্ণ ৯৬ ঘণ্টা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতি
যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছেন, কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে পৃথক বৈঠকের পর উভয় পক্ষ গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু চুক্তির শেষদিকে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বার বার সতর্ক করে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেন। এই চুক্তির ফলে গাজা শহর এবং দক্ষিণ গাজা থেকে লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি তাদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে পারবেন। ফিলিস্তিনিদের জন্য চুক্তির অন্যতম দিক হলো, এর ফলে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ছয়শ’ ট্রাক ত্রাণ এবং চিকিৎসাসামগ্রী প্রবেশ করতে দেয়া হবে। গাজায় অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোকে সচল রাখতে ৫০টি জ্বালানিভর্তি লরিও পাঠানো হবে বলে জানানো হয়েছে। এদিকে চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন- এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র নভেম্বরে তার ঐতিহাসিক বিজয়ের কারণে। বিবিসি ভেরিফাইয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর জিম্মি করা ২৫১ জনের মধ্যে এখনো গাজায় আছেন ৯৪ জন। এর মধ্যে ৬০ জন এখনো জীবিত এবং ৩৪ জন মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে। জেরুজালেম থেকে সাংবাদিক জানাহ ফিশার জানিয়েছেন, কয়েকটি পর্যায়ে এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। এ সময়ে হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। প্রতিজন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ইসরাইল বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে।
স্বাগত জানালেন ট্রাম্প-বাইডেনসহ বিশ্বনেতারা: ঐতিহাসিক এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশ। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা। যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর অন্যতম ছিল কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর। গাজা যুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। যুদ্ধের শুরু থেকেই বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরাইল। তাদের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও তারা তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে পিছপা হয়নি। ২০২৩ সাল থেকেই একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতির চুক্তি নিয়ে গভীর আলোচনা পর্যালোচনায় সরাসরি যুক্ত ছিল উল্লিখিত ওই তিন দেশ। তারা এই চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। এর মধ্যে ধীরে ধীরে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে ইসরাইল। এ ছাড়া হামাসের হাতে থাকা জিম্মি এবং ইসরাইলি কারাগারে বন্দিদের মুক্ত করবে উভয় পক্ষ।
কাতারের রাজধানী দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল থানি বলেছেন, রোববার থেকে কার্যকর হবে যুদ্ধবিরতি। মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো হামাস ও ইসরাইলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি কাজ করছেন। প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আমি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে পারি; কেননা ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে জিম্মি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার মাধ্যমে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে এবং ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে যেসব জিম্মি আটক রয়েছে তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে বলেও জানিয়েছেন বাইডেন। যুদ্ধবিরতিতে তার সরকারের কৃতিত্ব তুলে ধরেন বাইডেন। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে জিম্মিদের জন্য একটি নতুন চুক্তি হয়েছে, তাদের খুব শিগগিরই মুক্তি দেয়া হবে। ধন্যবাদ!’ ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফরমের একটি পোস্টে তিনি আরও বলেন, ‘এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জাতীয় নিরাপত্তা দলের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজায় যেন পুনরায় ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয়স্থল হতে না পারে সেজন্য ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।’ বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, কয়েক মাসের ভয়াবহ রক্তপাত এবং অসংখ্য প্রাণহানির পর, এটি সেই দীর্ঘস্থায়ী সংবাদ যার জন্য ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনি জনগণ মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করেছে। তিনি আরও বলেন, যেসব নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি রাতারাতি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জন্য এই যুদ্ধবিরতি মানবিক সহায়তার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই মুহূর্তে গাজার দুর্দশা নিরসনে যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন স্টারমার। যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুঁতেরা। তিনি বলেছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নে সমর্থন জানায় জাতিসংঘ। অগণিত ফিলিস্তিনিদের জন্য টেকসই মানবিক সরবরাহ বৃদ্ধি করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেন, যুদ্ধবিরতির চুক্তি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে তুরস্ক। এক্স-এর একটি পোস্টে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং গাজায় দ্রুত মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে জোর দিয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তিকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। কেননা, জিম্মিরা তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে পারবে। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডি ক্রু বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে চলা সংঘাতের পর, জিম্মিরা তাদের পরিবারের কাছে ফেরত যেতে পারবে। এ ছাড়া গাজার জনগণের জন্য প্রচুর স্বস্তি অনুভব করছি। এই যুদ্ধবিরতি সংঘাতের অবসান ঘটাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, আশা করা যায় যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং গাজায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে।
No comments