বেপরোয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘ইমন বাহিনী’ by সুদীপ অধিকারী

সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। একাধিক মামলায় ২০০৮ সাল থেকে কারাগারে থেকেই ধানমণ্ডি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। গত ১৫ই আগস্ট জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবারো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে তার বাহিনী। ধানমণ্ডি, পশ্চিম ধানমণ্ডি, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, টালি অফিস, জিগাতলা, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেটসহ পুরো এলাকার ভবন নির্মাণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ময়লার সিন্ডিকেট, ডিশ ব্যবসা, ইন্টারনেটের ব্যবসা সব কিছুর একক আধিপত্য পেতে এখন মরিয়া ইমন বাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধানমণ্ডি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ধানমণ্ডি ৪ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর বাড়ির ডাক্তার মল্লিক আব্দুল্লাহ’র ছেলে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন।

আলোচিত চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ ওরফে টিপু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ইমন। ১৯৯৮ সালের ১৮ই ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রামস ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী সেই সময় গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে  চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর কথাকাটাকাটি হয়। এর প্রতিশোধ নিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। ঘটনার রাতে সোহেল তার বন্ধুদের নিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। রাত আড়াইটার দিকে আবারো তিনি ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সোহেলকে লক্ষ্য করে ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক ও আদনান গুলি চালায়। এরপর থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে আলোচিত হয়ে ওঠে ইমন। নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পাং বাবুসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৪ সালে র?্যাবের ধাওয়া খেয়ে কলকাতায় পালিয়ে যায় ইমন। ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়ার পর ফোনের সূত্র ধরে বাংলাদেশের সিআইডি পুলিশ কলকাতা পুলিশকে বিষয়টি জানালে ২০০৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ২০০৮ সালের ৭ই মার্চ কলকাতা পুলিশ ইমনকে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। সেই থেকেই মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও থানার আটটি মামলায় কুমিল্লা জেলা কারাগারে বন্দি ছিলেন পুলিশের তালিকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১১ই এপ্রিল  তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। জেলে থেকেই তিনি পুরো এলাকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। তিনি জেলে থাকলেও তার বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ছিল। কেউ বাড়ি নির্মাণ করলেই বাহিনীর সদস্যরা মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে চাঁদা দাবি করতো। শুধু চাঁদাবাজি নয় জেলে বসেই একাধিক হত্যাকাণ্ডও চালিয়েছে এই ইমন। স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে ২০২৩ সালের  ১৮ই সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় নিজের একসময়ের বন্ধু শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের ওপর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় ইমন। সেই গুলি লেগে মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৩ সালে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি আফজাল হোসেন সাত্তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও কারাগারে থেকেই ইমনের নাম আসে। দীর্ঘ ১৭ বছর কারাগারে থাকার পর গত জুলাই বিপ্লবের পর ১৫ই আগস্ট দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পায় অপরাধ জগতের ক্যাপ্টেন ইমন।
যেভাবে ময়লার ব্যবসা দখলে নেয় ইমন বাহিনী: পশ্চিম ধানমণ্ডির এক নারী বলেন, আমরা এই এলাকায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষের বাসাবাড়ি থেকে ময়লা টানছি। সিটি করপোরেশনের কাগজপত্র সব আছে আমাদের। এরপরও যে দল যখন ক্ষমতাই আসে তখন তাদের ওয়ার্ড নেতাদের মাসোয়ারার একটা ভাগ দিতে হয়। কিন্তু ৫ই আগস্টের পর কয়েকজন লোক এসে নিজেদের ইমনের লোক পরিচয় দিয়ে আমাদের বলেন- আজ থেকে এই এলাকার ময়লার ব্যবসা ইমন ভাইয়ের। তোমরা এখন থেকে কর্মচারী। মাস গেলে বেতন পাবে। আর টাকা আমরা উঠাবো। ষাটোর্ধ্ব এই নারী বলেন, আমরা ছিলাম মালিক আর এখন আমরা হয়ে গেছি কামলা (কর্মচারী)। সব কাজ আমরা করি আর বাসাবাড়ি থেকে স্লিপ দিয়ে টাকা তোলে ইমনের লোক। বেতন তো ঠিকমতো দেয়ই না। উল্টো দুই মাসে ৩০ হাজার টাকা কেটে নিয়েছে। প্রতিটি এলাকাতেই ইমনের লোক ময়লার ব্যবসা দখলে নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ওপর এসব নির্যাতনের কথা যার কাছে বলতে যাই- সেই বলে- চুপ থাকো, এরা ভালো মানুষ না। জানে মেরে ফেলবে। কাজ করে খাচ্ছো- এটাই অনেক। থানা পুলিশও এই ইমন বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলতে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেও জানান ময়লা ব্যবসায়ী।
ভবন নির্মাণে চাঁদাবাজি: ধানমণ্ডি, জিগাতলা, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, লালমাটিয়া, তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুর এলাকার অংশবিশেষ এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের সময়ে চাঁদা আদায়ে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় ইমনের নাম। ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেই সেখানে গিয়ে ২০/৩০টি মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয় ইমনের লোকজন। তাদের দাবি করা চাঁদার টাকা না দিয়ে কাজ শুরু করতে পারে না ব্যক্তি বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোক। এমনই এক ভুক্তভোগী ধানমণ্ডি-১৯ নম্বর স্টার কাবাবের পেছনের রাস্তার এক ভবন মালিক। পুরাতন ভবন ভেঙে কোম্পানির মাধ্যমে নতুন ভবন নির্মাণ করছেন তিনি। প্রাণ ভয়ে নিজের নাম প্রকাশ না করলেও তিনি বলেন, আমি এখানে গত বছর থেকে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। মাসখানেক আগে সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ ৩০/৪০টা মোটরসাইকেল নিয়ে একদল যুবক এসে হাজির। তারা আমার শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করতে বলে আমাকে খবর দিতে বলে। আমি অন্য কাজে তখন বাইরে ছিলাম। তারা নিজেদের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের লোক দাবি করে আমার কাছে সিকিউরিটি মানি হিসেবে চাঁদা দাবি করে। আমি তাদেরকে বলি আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমি চাঁদা দিতে পারবো না। তখন আমাকে বলা হয়- চাঁদা না দেয়া পর্যন্ত একটা ইটও গাঁথা যাবে না। এমন কী আমাকে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়। আমি তাই ভয়ে আপাতত কাজ বন্ধ রেখেছি।  তিনি বলেন, আমি আশপাশের অনেক ভবন মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি- ইমন বাহিনীর সদস্যদের নাকি চাঁদা না দিয়ে কেউ এই এলাকায় কাজ করতে পারে না।    
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি: ধানমণ্ডি এলাকার ছোট থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নামে ওঠে মাসিক চাঁদা। তার লোকজনকে চাঁদা না দিয়ে দোকান খুলতে পারে না কেউ। পশ্চিম ধানমণ্ডির রায়ের বাজারের ফিরোজ নামে এক দোকান মালিক বলেন, গত আগস্ট মাসেই ইমনের লোকজন এসে আমাদের বলে গেছে- সকলকে চাঁদা দিতে হবে। তা না হলে কেউ বাজারে ব্যবসা করতে পারবে না। তিনি বলেন, শুধু এই বাজার নয় আশপাশের সব ব্যবসায়ীকেই ইমন বাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়। মার্কেট, শপিংমল থেকে শুরু করে বাজার কমিটি সবই তার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আর চাঁদার টাকা না দেয়ার জন্যই সব শেষ মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের দুই ব্যবসায়ী এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সোসাইটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক ও সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান দীপুকে সকলের সামনে রাস্তায় ফেলে এলাপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে ইমনের লোকজন।
এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের উপ-কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, সন্ত্রাসী যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন আমরা কাউকে ছাড় দিবো না। অভিযোগ পেলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে। এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি  মাসখানেক আগের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি বিরোধ চলছিল। সে কারণে অথবা অন্যকোনো কারণেও দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করা হতে পারে। তবে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নিউমার্কেট থানায় করা মামলায় দাবি করা হয়েছে- ইমন বাহিনীর দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেয়ায়ই মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রকাশ্যে দুই ব্যবসায়ী নেতাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। আমরা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। অভিযুক্তদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। ডিএমপি’র গোয়েন্দা দক্ষিণ বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, আমরা মূলত পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে থাকি। যেখানে যেই গোয়েন্দা তথ্য পাই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। আমাদের সেই গোয়েন্দা তথ্যে আন্ডারওয়ার্ল্ড বা ওপেন যারা আছে তাদের কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এ বিষয়ে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, কেউ অবৈধ কোনো কাজ করলে ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ইমনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসী সে যেই হোক তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আসতে হবে। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, ছিনতাইকারী, চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত রয়েছে। কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে ব্যক্তিগতভাবে তিনি রক্তচক্ষুকে ভয় পান না বলেও জানান।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.