গুজরাট নির্বাচনে নতুন শিক্ষা by হরিশ খারে
বছর ত্রিশেক আগে পশ্চিমের রাজনীতিবিদদের সামনে যখন তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনা ও এর সুফল সম্পর্কে বলা হলো, তখন ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির একজন নীতিনির্ধারক, নরম্যান টেবিট এটাকে সাদরে গ্রহণ করেননি। তিনি সন্ধিগ্ধ ছিলেন।
বলেছিলেন, জনগণের সামনে যদি লাল গোলাপের পাপড়ি মুড়িয়েও কিছু দেওয়া হয়, তাহলে তারা বলবে- এটা একটা ইঁদুর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুসারীরা সেই ধারণা ভুল বলে প্রমাণ করলেন। নির্বাচনে অসামান্য সাফল্য দ্বারা তা-ই প্রমাণিত হলো। চৌকস নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি রাজ্যের গরিব শ্রেণী, সংখ্যালঘু, উপজাতিদের মতো নাগরিকদেরও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। কোথাও নরম কথা, কোথাও চোখরাঙানির মতো ভূমিকা পালন করতে হয়েছে তাঁকে। যেভাবেই হোক, নিজের মেয়াদেই তিনি নিজেকে অপরাজেয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
২০১২ সালের ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই নির্বাচনী প্রচারে তিনি কৌশলগতভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা তাঁর নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহযোগিতা করেছে। নিজের শাসনামলে যেসব উন্নয়ন হয়েছে, তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করার কৌশল ছিল সাধারণ ভোটারদের কাছে আকর্ষণীয়। ওই প্রচারণায় যে শতভাগ সত্য তথ্য ছিল, তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু প্রচারণায় ছিল মুনশিয়ানা। ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রীর পদ পাওয়ার পর যেসব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা যেন অভাবনীয় কিছুকেই উপহার দিতে পেরেছে- সে রকম একটা ধারণা তিনি মানুষের মনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রচারসর্বস্ব 'সদ্ভাবনা'র মাধ্যমে তিনি যে চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানেও তিনি সফল হয়েছেন। 'সদ্ভাবনা'র মাধ্যমে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা মনে করতে থাকে, মোদি নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীও তাঁর এই চাতুর্যের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর এই সফল কৌশল তাঁকে এখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। কেউ কেউ এখন মনে করছে, নরেন্দ্র মোদিকে আগামী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষ করে তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করেন, তেমন নেতাদের ব্যাপারেও বেশ বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাই বলে তাঁদের সম্পর্কে নিজের ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি পিছপা হননি। যেমন গান্ধী-নেহরু পরিবারের কথা বলা যায়। আহমেদ প্যাটেল কিংবা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কথা ধরা যায়। তাঁরা কেউই তাঁর মিছরির ছুরি থেকে রেহাই পাননি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত চতুর কৌশলের সাহায্য নিয়েছেন।
তারপর আসে পুলিশের যথেচ্ছ ব্যবহার। তাকে বর্ণনা করা যায়, 'দাবাংগিরি' হিসেবে। রাজ্য পুলিশকে তিনি ব্যবহার করেছেন রীতিমতো হাতিয়ার হিসেবে। মানুষকে সন্ত্রস্ত রাখার জন্য পুলিশের এ ধরনের ব্যবহারের নৈতিকতা নেই। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পুলিশের উপস্থিতি দেখেই তটস্থ থেকেছে।
নরেন্দ্র মোদি শুধু সংখ্যালঘুদের সঙ্গেই যে দাবাংগিরি করেছেন, তাও নয়। তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও সেই খেলা খেলেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশ কাটিয়েই তিনি প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। সুসমা স্বরাজ কিংবা এল কে আদভানির মতো নেতারা তাই তাঁকে 'ভাবী প্রধানমন্ত্রী' হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন। অন্তত দলের ওপর তাঁর যে আধিপত্য, তা দেখে এমনটাই মনে করা যায়। কেন্দ্রীয় নেতারা আহমেদাবাদে এসেছেন নির্বাচনের আগে। কিন্তু তাঁদের জনসংযোগ ছিল ঘরোয়া পর্যায়ে। তিনি তাঁদের সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোনো জনসমাবেশে তাঁদের বক্তৃতা করার সুযোগও দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সেখানে পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগই ছিল না।
তাঁর এই বিজয়ে তিনি নিজেই ছিলেন নায়ক। ২০০২ কিংবা ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘ সদস্যদের সেভাবে পাননি। যে কারণে তিনি তাদের ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। গুজরাটের নির্বাচনের পর এখন নতুন করে ভাবতে হবে, আসলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বদল হবে কি না। এখন থেকে তাঁর সমর্থকরা সংগত কারণেই মনে করছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও এখন মোদিকেই স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
এটাও ঠিক, মোদির এক দশকের শাসনকালের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি কিভাবে ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। গত দশককালের উদাহরণগুলো স্পষ্টত। সেখানে দেখা গেছে, চারটি করপোরেট গ্রুপ তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের স্বার্থের প্রয়োজনে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন, সুশীল সমাজের মানসিকতা মূল্যায়ন করেছেন। এমনকি প্রচারমাধ্যমেও তাদের আধিপত্য ছিল প্রচণ্ড।
গুজরাটের নির্বাচনের পর ইউপিএ ও এনডিএ-কেও নতুন করে মিত্র বাছাইয়ের কাজ করতে হবে। তার পরও হিমাচল ও গুজরাটের নির্বাচন দিয়েই ইউপিএ জোটের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যাবে- এমন কথা বলার সময় আসেনি। কংগ্রেস আগামী নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করবে- এটাও ঠিক। রাহুল গান্ধী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের মনে রাখার প্রয়োজন, মাত্র এক দশককাল আগেও এই মোদি ছিলেন জেলা পর্যায়ের একজন নেতা। আজকে তিনি কিভাবে রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিজের আসন দৃঢ়তর করতে সক্ষম হয়েছেন।
লেখক : জওয়াহেরলাল নেহরু ফেলোশিপ ২০১৩ অর্জনকারী
আউটলুক থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
২০১২ সালের ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই নির্বাচনী প্রচারে তিনি কৌশলগতভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা তাঁর নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহযোগিতা করেছে। নিজের শাসনামলে যেসব উন্নয়ন হয়েছে, তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করার কৌশল ছিল সাধারণ ভোটারদের কাছে আকর্ষণীয়। ওই প্রচারণায় যে শতভাগ সত্য তথ্য ছিল, তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু প্রচারণায় ছিল মুনশিয়ানা। ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রীর পদ পাওয়ার পর যেসব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা যেন অভাবনীয় কিছুকেই উপহার দিতে পেরেছে- সে রকম একটা ধারণা তিনি মানুষের মনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রচারসর্বস্ব 'সদ্ভাবনা'র মাধ্যমে তিনি যে চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানেও তিনি সফল হয়েছেন। 'সদ্ভাবনা'র মাধ্যমে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা মনে করতে থাকে, মোদি নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীও তাঁর এই চাতুর্যের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর এই সফল কৌশল তাঁকে এখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। কেউ কেউ এখন মনে করছে, নরেন্দ্র মোদিকে আগামী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষ করে তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করেন, তেমন নেতাদের ব্যাপারেও বেশ বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাই বলে তাঁদের সম্পর্কে নিজের ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি পিছপা হননি। যেমন গান্ধী-নেহরু পরিবারের কথা বলা যায়। আহমেদ প্যাটেল কিংবা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কথা ধরা যায়। তাঁরা কেউই তাঁর মিছরির ছুরি থেকে রেহাই পাননি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত চতুর কৌশলের সাহায্য নিয়েছেন।
তারপর আসে পুলিশের যথেচ্ছ ব্যবহার। তাকে বর্ণনা করা যায়, 'দাবাংগিরি' হিসেবে। রাজ্য পুলিশকে তিনি ব্যবহার করেছেন রীতিমতো হাতিয়ার হিসেবে। মানুষকে সন্ত্রস্ত রাখার জন্য পুলিশের এ ধরনের ব্যবহারের নৈতিকতা নেই। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পুলিশের উপস্থিতি দেখেই তটস্থ থেকেছে।
নরেন্দ্র মোদি শুধু সংখ্যালঘুদের সঙ্গেই যে দাবাংগিরি করেছেন, তাও নয়। তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও সেই খেলা খেলেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশ কাটিয়েই তিনি প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। সুসমা স্বরাজ কিংবা এল কে আদভানির মতো নেতারা তাই তাঁকে 'ভাবী প্রধানমন্ত্রী' হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছেন। অন্তত দলের ওপর তাঁর যে আধিপত্য, তা দেখে এমনটাই মনে করা যায়। কেন্দ্রীয় নেতারা আহমেদাবাদে এসেছেন নির্বাচনের আগে। কিন্তু তাঁদের জনসংযোগ ছিল ঘরোয়া পর্যায়ে। তিনি তাঁদের সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোনো জনসমাবেশে তাঁদের বক্তৃতা করার সুযোগও দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সেখানে পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগই ছিল না।
তাঁর এই বিজয়ে তিনি নিজেই ছিলেন নায়ক। ২০০২ কিংবা ২০০৭ সালের নির্বাচনে তিনি স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘ সদস্যদের সেভাবে পাননি। যে কারণে তিনি তাদের ছাড়াই এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। গুজরাটের নির্বাচনের পর এখন নতুন করে ভাবতে হবে, আসলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বদল হবে কি না। এখন থেকে তাঁর সমর্থকরা সংগত কারণেই মনে করছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও এখন মোদিকেই স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
এটাও ঠিক, মোদির এক দশকের শাসনকালের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি কিভাবে ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। গত দশককালের উদাহরণগুলো স্পষ্টত। সেখানে দেখা গেছে, চারটি করপোরেট গ্রুপ তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের স্বার্থের প্রয়োজনে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন, সুশীল সমাজের মানসিকতা মূল্যায়ন করেছেন। এমনকি প্রচারমাধ্যমেও তাদের আধিপত্য ছিল প্রচণ্ড।
গুজরাটের নির্বাচনের পর ইউপিএ ও এনডিএ-কেও নতুন করে মিত্র বাছাইয়ের কাজ করতে হবে। তার পরও হিমাচল ও গুজরাটের নির্বাচন দিয়েই ইউপিএ জোটের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যাবে- এমন কথা বলার সময় আসেনি। কংগ্রেস আগামী নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করবে- এটাও ঠিক। রাহুল গান্ধী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের মনে রাখার প্রয়োজন, মাত্র এক দশককাল আগেও এই মোদি ছিলেন জেলা পর্যায়ের একজন নেতা। আজকে তিনি কিভাবে রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিজের আসন দৃঢ়তর করতে সক্ষম হয়েছেন।
লেখক : জওয়াহেরলাল নেহরু ফেলোশিপ ২০১৩ অর্জনকারী
আউটলুক থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
No comments