৫৫ লাখ দলিতের হাহাকারঃ ‘আমাদের তো কোনো জায়গা নেই, আমরা কোথায় যাবো?’ by মফিজুল সাদিক

‘‘আমাদের তো কোনো জায়গা নেই, আমরা কোথায় যাবো? তাই রাষ্ট্রের কাছে আমার দাবি, আমাদের মতো দলিতদের জন্য যেন কিছু করে’’- এ আকুতি বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরির।
তিনি এ দেশে বসবাসকারী দলিত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে নির্যাতিত ৮ লাখ জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে চা-শ্রমিক সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি।
রোববার নিজ এলাকা থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন রামভজন কৈরি। তিনি দলিতদের কথা তুলে ধরে তাদের সমস্যার সমাধান ও নির্যাতনের নিরসনের জন্য আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। তুলে ধরেন নিজেদের সম্প্রদায়ের এসব সমস্যা- নির্যাতনের নানা দিকগুলো। এসব দূর করে চা-শ্রমিকসহ দেশের মোট ৫৫ লাখ দলিত মানুষকে সমাজের মূল স্রোতধারায় উঠিয়ে আনারও আকুতি জানান রামভজন কৈরি।   

রোববার বিকেল ৪টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সম্মেলন কক্ষে গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ (আরডিসি) এবং অক্সফার্ম ওই সেমিনারের আয়োজন করে। ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস এবং প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের নানা তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভের চেয়ারপার্সন প্রফেসর মেসবাহ কামালের সঞ্চালনায় সেমিনারে রামভাজন ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহ আলম, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত,  নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন প্রমুখ। 

বাংলাদেশে দলিতের সংখ্যা ৫৫ লাখ
সেমিনারে জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৫৫ লাখের মতো দলিত মানুষ বসবাস করেন। দলিতদের দলনের ইতিহাস বহু প্রাচীন, শোষণ-নির্যাতন যেন তাদের ভাগ্যের লিখন। বংশ পরম্পরায় এই দলিতরা মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন।

সামাজিকভাবে যে সব কাজকে হেয় করে দেখা হয়, সে সমস্ত কাজই দলিতদের জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। যেমন ঝাড়ুদার, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ, চামড়ার কাজ, শব দাহ করার কাজ ইত্যাদি।

এ দেশের দলিতরা ১৪টি দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, হরিজন, বর্মন, ধোপা, মালো, বাগদি, নমশূদ্র, কায়পুত্র, রবিদাস, জলদাস, করনিদাস, মায়মল, বাহেরারা, রাজকরলী এবং ঋষি।

গবেষণায় দেখা গেছে, দলিতদের মধ্যে ৬৯ শতাংশই নিরক্ষর।

সেমিনারে আরো জানানো হয়, দলিতদের ৪ ভাগের মধ্যে ৩ ভাগই আদি পেশায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

আদিবাসী
সেমিনারে গবেষণার বরাত দিয়ে জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী বাস করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে চাকমা, মারমা, কুর্মি, তঞ্চঙ্গাসসহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী। আর সমতলে রয়েছে সাঁওতাল, গারো, ওঁরাও, হাজং, মুন্ডাসহ ৬৪টি আদিবাসী গোষ্ঠী।

আদিবাসীর মধ্যেও অনেকে দলিত জীবন-যাপন করেন।

আদিবাসীরা এখনও গতানুগতিক চাষাবাদে অভ্যস্ত। পাহাড়িদের মধ্যে ২০০৯ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাত্র ২.৬ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করেছেন এবং কোনো দিন স্কুলে যাননি এদের সংখ্যা ৫৩.৯ শতাংশ।

আদিবাসীদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশের জমির দলিল আছে।

এছাড়া সেমিনারে বলা হয়, গারোদের বিরুদ্ধে গড়ে ৩টি করে মামলা আছে বনের সম্পদ চুরির অভিযোগে।
আদিবাসীদের অনেকে ষড়যন্ত্রে পড়ে ৩০-৪০ বছর ধরে বাড়িঘর ছাড়া হয়ে নি:স্ব জীবন-যাপন করছেন।

গার্মেন্টস শ্রমিক
বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মরত আছেন। কিন্তু নানা কারণে এ সেক্টরের শ্রমিকরাও দলিত জীবন-যাপন করছেন।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। যা আরো উদ্বেগজনক তা হলো যে, শ্রম অধিকার আইনগুলো অত্যন্ত সীমিতভাবে গার্মেন্টস সেক্টরে বাস্তবায়িত হয়।

একই ভাবে প্রচুর কারখানা নাজুক অবস্থায় রয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্বেও কারখানাগুলো মানসম্মত করা হয় না। দূর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য কারখানায় আগুনের ঝুঁকিসহ অন্যান্য ঝুঁকি বেশি থাকে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম মাত্র তিন হাজার টাকা, যা দিয়ে বাড়ি ভাড়াসহ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

জন্ডিস, দৃষ্টি শক্তির খর্বতা এবং মাথা ব্যথার সমস্যা প্রায় সব গার্মেন্টস কর্মীদের নিত্য-নৈমিত্তিক সমস্যা। প্রচুর শ্রমিকদের মধ্যে অপুষ্টির সমস্যা দেখা গেছে। অনেকের মধ্যে যক্ষাও পাওয়া গেছে।
সেমিনারে আরো বলা হয়, গরমকালে অনেক শ্রমিকদের অজ্ঞান হতে দেখা গেছে। এছাড়া মহিলারা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

সংখ্যালঘু
দলিতদের মধ্যে বেশি সংখ্যালঘু লক্ষ্য করা গেছে বলেও জানানো হয় সেমিনারে। তাদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিক অধিকারহীনতার শিকার। যার কারণে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী দিন দিন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.৩৪ শতাংশে।

সেমিনারে আরো জানানো হয়, সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ দলিত বলেও সেমিনারে উল্লেখ করা হয়।

২০০১ সালে নির্বাচন উত্তর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করা হয়। যার ফলে অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সে সময় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনেকে হত্যা, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন। উদাহরণস্বরূপ সেমিনারে জানানো হয়, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উমা দে, রুপা রাণী দাস ও তার মেয়ে, উল্লাপাড়ার কিশোরী পূর্ণিমা, পিরোজপুরের গীতা রানী ব্যাপারী, গৌরনদীর সাবিত্রী, গফরগাঁওয়ের জোৎস্না রানী,  ভোলার শেফালি রানী দাস ধর্ষণের শিকার হয়। চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ মুহুরি হত্যার শিকার হন।
.

এছাড়া সাম্প্রতিককালে রামুতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ওপর চালানো হয় বর্বরতা।

চা- শ্রমিক
দেশে ৫৫ লাখ দলিতদের মধ্যে চা-শ্রমিকদের বড়ো একটি অংশ রয়েছেন বলে সেমিনারে জানানো হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ চা-শ্রমিক আছেন, যারা মানবেতর জীবন-যাপন করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে চা শ্রমিকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একজন ছাত্র চা-শ্রমিকের ঘর থেকে এসেছেন।

সেমিনারে উঠে আসে চা-শ্রমিকদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন ও দলনের কথা।

জানানো হয়, চা-বাগানের আশেপাশে যাদের বাড়ি, তাদের একজন সদস্যকে চা-বাগানে নিয়োজিত করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া চা-শ্রমিকদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। প্রতিদিনের মজুরি মাত্র ৫৫ টাকা।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমাদের ওপর আদিম যুগের মতো নির্যাতন করা হয়। অন্য কোনো পেশার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের পরিবারের একজন সদস্যকে এ কাজে বলি দিতে হয়। তা না হলে বসতবাড়ি উচ্ছেদের হুমকি দিয়ে থাকেন মালিকেরা।’’

তিনি আকুল আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের তো কোনো জায়গা নেই, আমরা কোথায় যাবো? তাই রাষ্ট্রের কাছে আমার দাবি, আমাদের মতো দলিতদের জন্য যেন কিছু করে।’’

No comments

Powered by Blogger.