সমকালীন প্রসঙ্গ-নির্বাচিত সরকারের অধীনে গণতন্ত্র কোথায়? by বদরুদ্দীন উমর
দেশে আজ যতই অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করুক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে নিয়ে সরকারি মুখপাত্রদের পক্ষ থেকে এটা বোঝার কোনোই উপায় নেই। কারণ, তারা যে জনগণের জীবন বিপন্ন করে রেখেছেন তাদের সামনে দাঁড়িয়েই এ কথা বলতে অসুবিধা বোধ করেন না যে, বাংলাদেশের জনগণ এখন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ
করছেন! নিয়মিতভাবে পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে মানুষের মৃত্যু হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথা বলতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, তাদের এই সরকারের আমলে কোনো ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি!
কোনো দেশে সাবালকের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেই যে সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ও শাসন ব্যবস্থা থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু অনেক দেশেই নির্বাচিত সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের দেশের শাসন ব্যবস্থাকে বলা যেতে পারে 'গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র'। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের সরকারকে 'গণতান্ত্রিক ফ্যাসিজম' নামেও আখ্যায়িত করা চলে। বাংলাদেশ এ রকমই এক দেশ। এখানে যে সরকারই নির্বাচিত হোক, তার দ্বারা জনগণ কোনো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পায় না। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সামরিক সরকার বহাল থেকেছে। তাদের সময় বাদ দিয়েও বলা চলে যে, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পর থেকে কোনো সময়ই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকেনি। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রই হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ট্র্যাজিক নিয়তি।
গত ১৩ জুলাই সমকালে 'কতদিন থাকবে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা' নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় 'মুক্তাঙ্গন' নামে সভা-সমাবেশের একটি জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই সংকীর্ণ স্থানটিতে জনগণকে একেবারে স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া। এটা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়। তিনি পল্টন ময়দানসহ ঢাকার সভা-সমাবেশের যত জায়গা ছিল সেগুলো নানা কৌশলে বন্ধ করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, যখন জনগণের মিলিত হওয়ার একমাত্র উপায় দাঁড়িয়েছিল রাস্তার ওপর মিটিং করা। আগে রাস্তায় সভা-সমাবেশের কোনো ব্যাপার ছিল না। যেসব ছোটখাটো সমাবেশ রাস্তার ধারে হতো সেগুলোকে বলা হতো ংঃৎববঃ পড়ৎহবৎ সববঃরহম. কোনো বড় সমাবেশ রাস্তায় করার চিন্তা কেউ করত না। কারণ, তার জন্য যথেষ্ট খোলা জায়গা পাকিস্তান আমল থেকেই পড়েছিল।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর খুব ব্যাপকভাবে দেশে সফর করেছেন। তিনি প্রায়ই সভা-সমিতি করতেন। কিন্তু ঢাকায় তিনি একটিও জনসভা করেননি! এ জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশের কোনো জায়গা রাখার প্রয়োজন তার ছিল না। তিনি সেগুলো বন্ধ করেছিলেন। সেই অবস্থায় ১৯৭৯ সালে ছোটখাটো সমাবেশ যাতে হতে পারে এ জন্য ঢাকার তৎকালীন মেয়র 'মুক্তাঙ্গন' প্রতিষ্ঠা করে বলেন যে, সেখানে জনগণ সভা করতে পারবেন এবং তার জন্য তাদের কোনো প্রশাসনিক অনুমতির প্রয়োজন হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক দিন পর্যন্ত 'মুক্তাঙ্গনে'র সে রকম কোনো ব্যবহার হয়নি। জায়গাটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। জিয়াউর রহমান যখন সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন তখন থেকে রাস্তার ওপর যেভাবে মিটিং হতো সেভাবেই মিটিং হতো 'মুক্তাঙ্গন' প্রতিষ্ঠার পরও। পরে ধীরে ধীরে সেটিতে নিয়মিতভাবে সভা-সমাবেশ শুরু হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর বড় অংশটিই গাড়ি পার্কিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকায় পুরো জায়গাটির ব্যবহার কখনোই হয়নি। উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই 'মুক্তাঙ্গনে'র সভা-সমিতি তার গেটের সামনে রাস্তার ওপরই হয়েছে। রাস্তার ওপর সভা করার জন্য পুলিশ অনেক সময়েই সভা ছত্রভঙ্গ করেছে; কিন্তু 'মুক্তাঙ্গনে' গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে কোনো সময়ই পুরো জায়গাটি ব্যবহারযোগ্য করা হয়নি। যাহোক, এ সত্ত্বেও জায়গাটি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সভা-সমিতির কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু হয় এবং এই ব্যবস্থা ২০১১ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত চালু থাকে। পরে মে মাস থেকেই জায়গাটিকে সভা-সমিতির জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকার ওই এলাকাটিতে স্থায়ী ১৪৪ ধারা জারি করায় সেখানে সভা-সমিতি বন্ধ হয়। কেউ সে চেষ্টা করতে গেলে পুলিশ তাদের হাতের সুখ মিটিয়ে লাঠিপেটা করে। এরপর সভা-সমাবেশের স্থান সরে আসে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তার ওপর। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলে যে, মুক্তাঙ্গনের সামনে সভা করতে দিলে ব্যস্ত রাস্তা আটক থাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা? সেটি কি কম ব্যস্ত? সেখানে এমনকি সভা-সমাবেশের সময় যানবাহন চলাচলের বিঘ্ন ঘটে না? সেখানে মিটিং করতে গেলেও অনুমতি লাগে এবং প্রায় সবসময়ই পুলিশ নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করে। কিন্তু তবু সেখানে মিটিং হয়। এখানে বলা দরকার যে, ঢাকায় যেখানে সোয়া কোটির ওপর লোকের বাস, সেখানে এ ধরনের ছোট জায়গা সভা-সমিতির জন্য খোলা রাখার অর্থই হলো সভা-সমিতি যাতে বড় আকারে হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে কী কারণে 'মুক্তাঙ্গন' সভা-সমিতির জন্য নিষিদ্ধ করেছে? কেন তারা ওই এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে? ব্রিটিশ আমল থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হতো তখনই, যখন কোনো বিশৃঙ্খলা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো অবস্থা হতো। অন্তত ১৪৪ ধারা জারির কারণ হিসেবে তাই বলা হতো। কিন্তু স্থায়ী ১৪৪ ধারা বলে কোনো কিছু ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে ছিল না। কিন্তু কয়েক দশক 'স্বাধীনতা উপভোগের' পর বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যে এখন জুটেছে স্থায়ী ১৪৪ ধারা। তাও আবার রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে!
কিন্তু কথাটা এভাবে বলাও ঠিক নয়। কারণ, সারা বাংলাদেশে এখন যে কোনো বিরোধী দলের সভা-সমিতির ওপর পুলিশি আক্রমণ যেভাবে হচ্ছে তাতে ঢাকা শহরের সভা-সমিতির জন্য 'মুক্তাঙ্গন' নিষিদ্ধ রাখা এবং যে কোনো সভা-সমাবেশের জন্য প্রশাসনিক অনুমতির ব্যবস্থা প্রায় নিষিদ্ধকরণের মতোই ব্যাপার। পুলিশ বলে, 'মুক্তাঙ্গনে' সভা-সমিতি করার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনুমতি দরকার হয়। তারাই সেটা দিয়ে থাকে। কিন্তু সমকালের রিপোর্টটিতে দেখা যায় যে, ডিসিসির অনুমতি পেলেও সেখানে পুলিশ কোনো সময়ই সভা-সমাবেশ করতে দেয় না। আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো প্রশ্ন না থাকলেও তারা সেই অজুহাত দেখিয়ে নিজেরা সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া পুলিশের পক্ষে কি এটা সম্ভব?
এটা তো গেল বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের গণতন্ত্র চর্চার একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত। কিন্তু এর থেকেও মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে ততই মানুষের জীবনের নিরাপত্তা পর্যন্ত উত্তরোত্তরভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। খুন-খারাবি একদিকে সরকারের পুলিশ ও র্যাব বাহিনীর দ্বারা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশে বাস্তবত কোনো অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি ক্রিমিনালদের অপরাধও ব্যাপক আকারে ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সকলের বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ নয়! তার একথা বলার অর্থ জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হলে সরকারকে তাদের শোবার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদি পাহারা দিতে হবে! দেশে মানুষের জীবন আজ যতখানি বিপন্ন হয়েছে আগে কি তাই ছিল? তখন কি মানুষের জীবন অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি নিরাপদ ছিল না? কিন্তু জনগণকে সে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকার প্রত্যেকের ঘর পাহারা দিত না। সমাজে এমন অবস্থা বজায় রাখত যাতে অপরাধীরা অবাধে অপরাধ করতে পারত না। অপরাধ করতে তারা ভয় করত। এখন অবস্থা অন্য রকম। অপরাধের যেহেতু কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই, সে কারণে তা অবাধ ও বেপরোয়া হয়েছে। ঠিক এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে বেডরুম পাহারা দেওয়ার।
দেশে আজ যতই অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করুক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে নিয়ে সরকারি মুখপাত্রদের পক্ষ থেকে এটা বোঝার কোনোই উপায় নেই। কারণ, তারা যে জনগণের জীবন বিপন্ন করে রেখেছেন তাদের সামনে দাঁড়িয়েই এ কথা বলতে অসুবিধা বোধ করেন না যে, বাংলাদেশের জনগণ এখন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছেন! নিয়মিতভাবে পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে মানুষের মৃত্যু হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথা বলতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, তাদের এই সরকারের আমলে কোনো ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি!
নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলো বাংলাদেশে নিজেদের যে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট চেহারা দেখিয়ে আসছে তার থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে, নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যেও গণতন্ত্রের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতিকে যে আজ বিপজ্জনক ও ভয়াবহ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে এটা কে অস্বীকার করতে পারে?
১৬.৭.২০১২
কোনো দেশে সাবালকের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেই যে সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ও শাসন ব্যবস্থা থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু অনেক দেশেই নির্বাচিত সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের দেশের শাসন ব্যবস্থাকে বলা যেতে পারে 'গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র'। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের সরকারকে 'গণতান্ত্রিক ফ্যাসিজম' নামেও আখ্যায়িত করা চলে। বাংলাদেশ এ রকমই এক দেশ। এখানে যে সরকারই নির্বাচিত হোক, তার দ্বারা জনগণ কোনো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পায় না। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সামরিক সরকার বহাল থেকেছে। তাদের সময় বাদ দিয়েও বলা চলে যে, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পর থেকে কোনো সময়ই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকেনি। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রই হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ট্র্যাজিক নিয়তি।
গত ১৩ জুলাই সমকালে 'কতদিন থাকবে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা' নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় 'মুক্তাঙ্গন' নামে সভা-সমাবেশের একটি জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই সংকীর্ণ স্থানটিতে জনগণকে একেবারে স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া। এটা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়। তিনি পল্টন ময়দানসহ ঢাকার সভা-সমাবেশের যত জায়গা ছিল সেগুলো নানা কৌশলে বন্ধ করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, যখন জনগণের মিলিত হওয়ার একমাত্র উপায় দাঁড়িয়েছিল রাস্তার ওপর মিটিং করা। আগে রাস্তায় সভা-সমাবেশের কোনো ব্যাপার ছিল না। যেসব ছোটখাটো সমাবেশ রাস্তার ধারে হতো সেগুলোকে বলা হতো ংঃৎববঃ পড়ৎহবৎ সববঃরহম. কোনো বড় সমাবেশ রাস্তায় করার চিন্তা কেউ করত না। কারণ, তার জন্য যথেষ্ট খোলা জায়গা পাকিস্তান আমল থেকেই পড়েছিল।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর খুব ব্যাপকভাবে দেশে সফর করেছেন। তিনি প্রায়ই সভা-সমিতি করতেন। কিন্তু ঢাকায় তিনি একটিও জনসভা করেননি! এ জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশের কোনো জায়গা রাখার প্রয়োজন তার ছিল না। তিনি সেগুলো বন্ধ করেছিলেন। সেই অবস্থায় ১৯৭৯ সালে ছোটখাটো সমাবেশ যাতে হতে পারে এ জন্য ঢাকার তৎকালীন মেয়র 'মুক্তাঙ্গন' প্রতিষ্ঠা করে বলেন যে, সেখানে জনগণ সভা করতে পারবেন এবং তার জন্য তাদের কোনো প্রশাসনিক অনুমতির প্রয়োজন হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক দিন পর্যন্ত 'মুক্তাঙ্গনে'র সে রকম কোনো ব্যবহার হয়নি। জায়গাটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। জিয়াউর রহমান যখন সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন তখন থেকে রাস্তার ওপর যেভাবে মিটিং হতো সেভাবেই মিটিং হতো 'মুক্তাঙ্গন' প্রতিষ্ঠার পরও। পরে ধীরে ধীরে সেটিতে নিয়মিতভাবে সভা-সমাবেশ শুরু হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর বড় অংশটিই গাড়ি পার্কিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকায় পুরো জায়গাটির ব্যবহার কখনোই হয়নি। উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই 'মুক্তাঙ্গনে'র সভা-সমিতি তার গেটের সামনে রাস্তার ওপরই হয়েছে। রাস্তার ওপর সভা করার জন্য পুলিশ অনেক সময়েই সভা ছত্রভঙ্গ করেছে; কিন্তু 'মুক্তাঙ্গনে' গাড়ি পার্কিং বন্ধ করে কোনো সময়ই পুরো জায়গাটি ব্যবহারযোগ্য করা হয়নি। যাহোক, এ সত্ত্বেও জায়গাটি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সভা-সমিতির কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু হয় এবং এই ব্যবস্থা ২০১১ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত চালু থাকে। পরে মে মাস থেকেই জায়গাটিকে সভা-সমিতির জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকার ওই এলাকাটিতে স্থায়ী ১৪৪ ধারা জারি করায় সেখানে সভা-সমিতি বন্ধ হয়। কেউ সে চেষ্টা করতে গেলে পুলিশ তাদের হাতের সুখ মিটিয়ে লাঠিপেটা করে। এরপর সভা-সমাবেশের স্থান সরে আসে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তার ওপর। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলে যে, মুক্তাঙ্গনের সামনে সভা করতে দিলে ব্যস্ত রাস্তা আটক থাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা? সেটি কি কম ব্যস্ত? সেখানে এমনকি সভা-সমাবেশের সময় যানবাহন চলাচলের বিঘ্ন ঘটে না? সেখানে মিটিং করতে গেলেও অনুমতি লাগে এবং প্রায় সবসময়ই পুলিশ নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করে। কিন্তু তবু সেখানে মিটিং হয়। এখানে বলা দরকার যে, ঢাকায় যেখানে সোয়া কোটির ওপর লোকের বাস, সেখানে এ ধরনের ছোট জায়গা সভা-সমিতির জন্য খোলা রাখার অর্থই হলো সভা-সমিতি যাতে বড় আকারে হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে কী কারণে 'মুক্তাঙ্গন' সভা-সমিতির জন্য নিষিদ্ধ করেছে? কেন তারা ওই এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে? ব্রিটিশ আমল থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হতো তখনই, যখন কোনো বিশৃঙ্খলা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো অবস্থা হতো। অন্তত ১৪৪ ধারা জারির কারণ হিসেবে তাই বলা হতো। কিন্তু স্থায়ী ১৪৪ ধারা বলে কোনো কিছু ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে ছিল না। কিন্তু কয়েক দশক 'স্বাধীনতা উপভোগের' পর বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যে এখন জুটেছে স্থায়ী ১৪৪ ধারা। তাও আবার রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে!
কিন্তু কথাটা এভাবে বলাও ঠিক নয়। কারণ, সারা বাংলাদেশে এখন যে কোনো বিরোধী দলের সভা-সমিতির ওপর পুলিশি আক্রমণ যেভাবে হচ্ছে তাতে ঢাকা শহরের সভা-সমিতির জন্য 'মুক্তাঙ্গন' নিষিদ্ধ রাখা এবং যে কোনো সভা-সমাবেশের জন্য প্রশাসনিক অনুমতির ব্যবস্থা প্রায় নিষিদ্ধকরণের মতোই ব্যাপার। পুলিশ বলে, 'মুক্তাঙ্গনে' সভা-সমিতি করার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনুমতি দরকার হয়। তারাই সেটা দিয়ে থাকে। কিন্তু সমকালের রিপোর্টটিতে দেখা যায় যে, ডিসিসির অনুমতি পেলেও সেখানে পুলিশ কোনো সময়ই সভা-সমাবেশ করতে দেয় না। আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো প্রশ্ন না থাকলেও তারা সেই অজুহাত দেখিয়ে নিজেরা সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া পুলিশের পক্ষে কি এটা সম্ভব?
এটা তো গেল বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের গণতন্ত্র চর্চার একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত। কিন্তু এর থেকেও মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে ততই মানুষের জীবনের নিরাপত্তা পর্যন্ত উত্তরোত্তরভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। খুন-খারাবি একদিকে সরকারের পুলিশ ও র্যাব বাহিনীর দ্বারা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশে বাস্তবত কোনো অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি ক্রিমিনালদের অপরাধও ব্যাপক আকারে ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সকলের বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ নয়! তার একথা বলার অর্থ জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হলে সরকারকে তাদের শোবার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদি পাহারা দিতে হবে! দেশে মানুষের জীবন আজ যতখানি বিপন্ন হয়েছে আগে কি তাই ছিল? তখন কি মানুষের জীবন অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি নিরাপদ ছিল না? কিন্তু জনগণকে সে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকার প্রত্যেকের ঘর পাহারা দিত না। সমাজে এমন অবস্থা বজায় রাখত যাতে অপরাধীরা অবাধে অপরাধ করতে পারত না। অপরাধ করতে তারা ভয় করত। এখন অবস্থা অন্য রকম। অপরাধের যেহেতু কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই, সে কারণে তা অবাধ ও বেপরোয়া হয়েছে। ঠিক এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে বেডরুম পাহারা দেওয়ার।
দেশে আজ যতই অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করুক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে নিয়ে সরকারি মুখপাত্রদের পক্ষ থেকে এটা বোঝার কোনোই উপায় নেই। কারণ, তারা যে জনগণের জীবন বিপন্ন করে রেখেছেন তাদের সামনে দাঁড়িয়েই এ কথা বলতে অসুবিধা বোধ করেন না যে, বাংলাদেশের জনগণ এখন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছেন! নিয়মিতভাবে পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে মানুষের মৃত্যু হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথা বলতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, তাদের এই সরকারের আমলে কোনো ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি!
নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলো বাংলাদেশে নিজেদের যে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট চেহারা দেখিয়ে আসছে তার থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে, নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যেও গণতন্ত্রের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এই পরিস্থিতিকে যে আজ বিপজ্জনক ও ভয়াবহ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে এটা কে অস্বীকার করতে পারে?
১৬.৭.২০১২
No comments