নৌবাহিনীর প্রধানের সাক্ষ্য-তিন বাহিনীর প্রধানেরা প্রথমে সমঝোতার পক্ষে মত দেন

বিডিআর বিদ্রোহ দমন করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন বাহিনী প্রধানের মতামত জানতে চান। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন, দুটি পথ খোলা আছে। একটি সমঝোতা, অন্যটি সামরিক অভিযান। কিন্তু ভেতরের অবস্থা বোঝা না যাওয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। পরে সমঝোতা করাই ঠিক হবে বলে সবাই মত দেন।


একই সঙ্গে সমঝোতা না হলে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করা হবে বলে বলা হয়।
পিলখানা হত্যা মামলায় গতকাল সোমবার সাক্ষ্য দিতে এসে নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ এ তথ্য দেন। জবানবন্দিতে তিনি ১২ জওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। পরে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা তাঁকে জেরা করেন। নৌবাহিনী প্রধানসহ গতকাল ১৩ জন সাক্ষ্য দেন। বেলা পৌনে পাঁচটায় আদালতের কার্যক্রম আগামী বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে পিলখানা হত্যা মামলার বিচার চলছে। ৪ জুলাই এই আদালতের বিচারক অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আকতারুজ্জামান সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল শাহ মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানকে সমন দেওয়ার আদেশ দেন। গতকাল সকাল সোয়া নয়টায় নৌবাহিনী প্রধান সাক্ষ্য দিতে আসেন। সাড়ে নয়টায় আদালতের কার্যক্রম শুরুর হওয়ার পর সাক্ষ্য দেন নৌবাহিনী প্রধান।
নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের মাধ্যমে তিনি বিডিআরে বিদ্রোহের খবর পান। বেলা একটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার সরকারি বাসভবন যমুনায় যেতে বলা হয়। তিনি তখনই সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানকে দেখতে পান। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নিয়ে দোতলায় বৈঠক করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকও সেখানে ছিলেন। ঘণ্টা খানেক পর প্রধানমন্ত্রী নিচে এসে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
নৌবাহিনীর প্রধান বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের মতামত জানতে চান। তিনি আমাদের বলেন, দুটি পথ খোলা আছে। সমঝোতা, না হয় সামরিক অভিযান। কিন্তু ভেতরের অবস্থা বোঝা না যাওয়ায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। পরে আমরা সমঝোতা করা ঠিক হবে বলে মতামত প্রদান করি। কিন্তু একই সঙ্গে সমঝোতা না হলে সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমনের মতামত প্রদান করি। এরপর প্রধানমন্ত্রী বের হয়ে যান। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে তিনি বলেন, “বিডিআর সদস্যরা সমঝোতায় আসবে।’”
নৌবাহিনী প্রধান বলেন, ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ডিএডি হাবিব, নাসির, রহিম, জলিল, সিপাহি সেলিম রেজা, সিপাহি মনিরুজ্জামান, হাবিলদার রফিকুল ইসলামসহ ১২-১৪ জন বিডিআর সদস্য যমুনায় আসেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। ৩০ মিনিট পরে তিন বাহিনীর প্রধানেরা সেখানে যান। বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন অল্প বয়সী। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চ স্বরে এবং উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বিডিআরের কর্মকর্তাদের অবস্থা জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘সবাই ভালো আছে’। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের অস্ত্রসমর্পণ করতে বলেন এবং কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের তক্ষুনি ছেড়ে দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীর প্রধানকে দেখিয়ে বলেন, ‘তোমরা আত্মসমর্পণ না করলে তাঁরা (তিন বাহিনীর প্রধান) কঠিন অ্যাকশনে যাবেন।’ আলোচনার সময় বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার কথা গোপন করেন।
ভাইস অ্যাডমিরাল জহির আদালতকে বলেন, এই অবস্থায় নৌবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। খুলনায় বিডিআরে কর্মরত নৌবাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আসামিদের মধ্যে সিপাহি সালাউদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ ও নায়েক শফিকুলকে ঘটনার দিন টেলিভিশনে দেখেছেন বলে জানান নৌবাহিনী প্রধান। তিনি মোট ১২ জনকে চিনতে পারেন বলে জানান।
জহির উদ্দিন আহমেদকে প্রথমে জেরা করেন আসামিদের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম। তিনি জানতে চান, ওই ঘটনায় নৌবাহিনীর কোনো কমান্ড দল পাঠানো হয়েছিল কি না।
—না, হয়নি।
—সেনাপ্রধান কোনো দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন কি না।
—এটা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
—এ ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থার কোনো ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন কি না।
—এটা আমার আওতার বাইরে।
—ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জওয়ানদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে।
—এটা ঠিক না।
—প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জওয়ানদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, সেটা জানেন?
—জওয়ানের সঙ্গে বৈঠকের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমার কথা বলেছিলেন। কিন্তু জওয়ানরা বৈঠকে সব ভুল ও মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁরা কর্মকর্তাদের হত্যার কথা গোপন করেছিলেন।
এরপর নৌপ্রধানকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আরেক আইনজীবী শামীম সরদার। সবশেষে জেরা করেন আইনজীবী ফারুক আহমেদ।
আসামি ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমানের পক্ষে সরকার নিযুক্ত আইনজীবী নূরুল ইসলাম নৌপ্রধানকে জেরা করতে দাঁড়ালে তাঁকে বাধা দেন আসামি হাবিবুর। তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি কাউকে আইনজীবী নিয়োগ করিনি, আমি নিজেই জেরা করব।’ আদালত জানান, কেউ আইনজীবী নিয়োগ না করলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তাঁকে আইনজীবী দেওয়া হয়। আসামির নিজে জেরা করার বিধান আইনে নেই। হাবিবুর তা মানতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এর আগে তিনি এই আদালতে জেরা করেছেন। এখনো সেভাবে জেরা করবেন। পরে তাঁর পক্ষে আর জেরা হয়নি।
বেলা সোয়া একটার দিকে জেরা শেষে নৌপ্রধান আদালত ছেড়ে যান। এ সময় নৌপ্রধান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাহিনী প্রধান হিসেবে এবং বাহিনীর পোশাকে আমি প্রথম এই আদালতে সাক্ষ্য দিলাম।’ বিদ্রোহের সময় সমঝোতার পক্ষে কেন মত দিয়েছিলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা জানা তখন দুষ্কর ছিল। আর সবাই তো আমাদের নিজেদের মধ্যেই—ভাই, আত্মীয়স্বজন। এ জন্যই সমঝোতার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছিল।’

No comments

Powered by Blogger.