পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা by মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
(শেষাংশ) বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগে অভিযোগ ইত্যাদি মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০০০ মিলিয়ন ডলার, নদী শাসন প্যাকেজের সম্ভাব্য ব্যয় ৮৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সুপারভিশন কনসালট্যান্সি ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শেষোক্ত প্যাকেজের কাজ পাওয়ার জন্যই প্রতিযোগিতা বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে।
শুরুতেই একটি কোম্পানিকে ‘ফেবার’ করার চেষ্টা আঁচ করতে পেরে মূল্যায়ন কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে পরবর্তী কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির মূল্যায়ন চলাকালীন একটি মহল ই-মেইলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের দেয়া ই-মেইলের কপি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জাপানী একজন কর্মকর্তার কাছেও পাঠানো হয়। শুরু থেকে না হলেও কয়েক মাস পর থেকে উক্ত ই-মেইলের কপি বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আমার ই-মেইলে ফরওয়ার্ড করা হয়। দেখা যায় যে, দুটি প্রতিষ্ঠান (এসএনসি-লাভালিন ও এইচপিআর) কারিগরি মূল্যায়নে বেশি নম্বর পেতে পারে বলে ওই মহলটি আশঙ্কা করে, এ প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। কোন কোন মেইলে তারা ঐধষপৎড়-িএরও দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে। মূল্যায়ন কমিটির বিভিন্ন সদস্য, মন্ত্রী, সচিব এমনকি বিশ্বব্যাংকের মনোনীত পরামর্শক ও টাস্ক টিম লিডারকে জড়িয়ে বানোয়াট তথ্য প্রদান করে। ইন্টিগ্রিটির কয়েক কর্মকর্তা ই-মেইল আদান-প্রদানে ও তথ্য সংগ্রহে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে। ২০১১ সনে পদ্মা সেতুর গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমি দু’বার বিশ্বব্যাংক সদর দফতরে গমন করি। প্রথমবার (সম্ভবত এপ্রিল, ২০১১) টাস্ক টিম লিডারকে জানাই যে, ইন্টিগ্রিটির জুনিয়র কর্মকর্তাগণ যেভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে একটি ভুল বিষয়ের ওপর যোগাযোগ করছে তা নিরসনের জন্য আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। টাস্ক টিম লিডার ইন্টিগ্রিটিকে জানালে তারা বলে যে, এ পর্যায়ে তারা কোন কথা বলবে না। দ্বিতীয়বার (জুন-জুলাই, ২০১১) ভ্রমণে মাননীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য, মাননীয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদ্মা প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি এডভাইজার। অনিয়মের কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রতিকারের জন্য তাঁকে জানানোর কথা। এ সফরে তিনি ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন; কিন্তু কথিত অভিযোগসমূহের বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস ইসাবেল গুরিয়েরা এর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের সময় আমি এ বিষয়টি পুনরায় উত্থাপন করি। তিনি জানান, ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করেন। যে পদ্ধতিতে তারা কোন বিষয়ের তদন্ত করে তাতে আমাদের কোন কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তাদের তদন্ত চলাকালীন পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকবে না। কাজ এবং তদন্তÑ এ দু’টি ইস্যু সম্পূর্ণ পৃথক। শুধু ওয়াশিংটনে নয়, আমি ঢাকাস্থ কান্ট্রি ডিরেক্টরকেও বিষয়টি অবহিত করি। পরবর্তীতে খবর পেলাম ইন্টিগ্রিটির কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে অভিযোগকারীদের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাগণকে আমি বললাম, ‘ইন্টিগ্রিটি যদি তদন্ত করে, তবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সকলেরই মতামত নিতে হবে।’ তারা জানালেন, ‘ইন্টিগ্রিটি বিভাগের কাজের ব্যাপারে আমাদের বলার কিছু নেই।’ জুলাই-আগস্ট, ২০১১-এর দিকে আমাকে জানানো হলো বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি সুপারভিশন কনসালট্যান্সি ছাড়াও মূল সেতুর টেন্ডারের অনিয়মে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্ত করছে। এক পর্যায়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর আমাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ গিয়েছে। তাঁকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রেখে এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আমি বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অবহিত করতে চাই।’ তাঁকে জানাই যে, আমরা যে পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর কাজ করে যাচ্ছি সে পদ্ধতিতে মাননীয় মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। কান্ট্রি ডিরেক্টর আমাকে বলেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল করে তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলেও হবে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভুল ধারণা নিরসনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইন্টিগ্রিটির একজন পরিচালকসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আনুষ্ঠানিকভাবে কথিত দুর্নীতির চেষ্টার বিষয়টি অবহিত করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে দুর্নীতির স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বলা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন সভায় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। তারা প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিউইয়র্কে কোন তথ্য-প্রমাণ দেয়নি। তবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী একই সময়ে ওয়াশিংটন গেলে তাঁর কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। উক্ত চিঠিতে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বটে, কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দেয়া হয়নি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রিন্ট মিডিয়ায় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তুমুল লেখালেখি শুরু হয়। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সেতু বিভাগ তখন মূল সেতুর প্রি-কোয়ালিফিকেশনের পর টেন্ডার আহ্বানের জন্য প্রস্তুত। আর সুপারভিশন কনসালট্যান্সির চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকের বিবেচনাধীন। এ পর্যায়ে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের অফিসে হানা দিয়ে তাদের কাগজপত্র জব্দ করে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মিডিয়ার অপপ্রচারের নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি চিঠিতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁকে ‘লেস দ্যান অনেস্ট’ আখ্যায়িত করেন। মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে নিজের সততা ও স্বচ্ছতার কথা বলেন, কিন্তু মিডিয়াতে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সে সময়ে আমি পিআইডিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করি। আমি পরিষ্কারভাবে উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরি এবং জানাই, যেভাবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সেতুর কাজ চলে আসছে তাতে মাননীয় মন্ত্রী কেন, তাঁর উর্ধের কোন কর্তৃপক্ষেরও এখানে হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া যেখানে ঋণের কোন টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির কোন প্রশ্নই আসে না। আমার সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য পরদিন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। একই সময়ে আমি কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও আমাদের স্বচ্ছতা এবং কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির বেনামী অভিযোগের বিষয়টি তুলে ধরি এবং বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই মর্মে জোর দিয়ে উল্লেখ করি। সে সময়ে দেশে কোন কোন মহল আমাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক তো আপনার (সচিবের) বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করছে না। আপনি মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন কেন?’ আমি বললাম, আমাদের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মন্ত্রী কেন, আমরা সকলেই দায়ী হব। তাছাড়া মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করে আমি দেখছি এ পর্যন্ত তিনি আমাদের কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেননি, কোন অনৈতিক বিষয়ে সুবিধা দাবি করেননি। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধেও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ হতে অভিযোগ পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে প্রকল্পের স্বার্থবিরোধী কাজের নমুনা পাওয়ায় মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের প্রস্তাব করি। অবশেষে অক্টোবর, ২০১১ প্রথমদিকে তাঁকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়। একই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাকে সেতু বিভাগের সচিব পদ থেকে বদলি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ এবং ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা এ বদলির প্রেক্ষিতে কিছুটা বিস্মিত হন।
দুর্নীতির অনুসন্ধান ও পরবর্তী পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাংকের পূর্বের প্রস্তাব ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু মন্ত্রীকে সরানোর পরও তারা স্থগিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেনি। সরকারের উপরের মহল থেকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান বিষয়টি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের হাতে। শোনা যায়, নিচের দিকে কিছু চেষ্টা হলেও জোয়েলিকের অনীহার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, কানাডিয়ান পুলিশ কর্তৃক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু করা হবে না। অক্টোবর, ২০১১ আমি সচিব থাকাকালীন বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পদ্মার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে কথা বলি। বিশ্বব্যাংকের যে সকল কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন তাদের অভিমত হলোÑ‘এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তবে আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না।’ এডিবি ও জাইকাসহ অন্যান্য সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তাগণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রকল্পের কার্যক্রমের মাঝপথে অর্থাৎ মূল সেতুর টেন্ডার আহ্বানের চূড়ান্ত মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক কাজ বন্ধ করে দেয়া যৌক্তিক হয়নি মর্মে মতপ্রকাশ করেন। তবে তারা এ-ও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যেহেতু প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছে সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরও মেনে নিতে হয়।’ এদিকে সরকারের উপরের মহল বুঝতে পারে যে, পদ্মা সেতুর কাজে এ যাবৎ কোন দুর্নীতি হয়নি, তথাপি পদ্মা সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের চাহিদামাফিক মন্ত্রীকে বদল করা হলো। তারপরও কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ এবং একজন মাননীয় উপদেষ্টার বিশ্বব্যাংকে গমন করে নেগোসিয়েট করা সত্ত্বেও কোন কাজ হয়নি। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে। তদন্তে মূল সেতুর বিষয়ে মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর কথিত দুর্নীতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সুপারভিশন কনসালট্যান্সি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য না দেয়ার কারণে এবং বিশ্বব্যাংকে চিঠি লিখে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ার কারণে এর তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের নিকট একটি চিঠি লিখে এবং কনসালট্যান্সি প্রদানের ক্ষেত্রে কথিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কতিপয় সরকারী-বেসরকারী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে। চিঠির কপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও দেয়া হয়। এবার অভিযোগের তীর আমার প্রতিও বর্ষিত হয়েছে মর্মে শুনতে পাই। উক্ত চিঠিতেও দুর্নীতির কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। শুধুমাত্র এসএনসি-লাভালিনের কেসে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে তথ্য আছে মর্মে এবং আরও কিছু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়, যদিও সে সব সূত্রের নাম প্রকাশ করা হয়নি। পত্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের সবগুলো দফা সরকারের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় বিধায় সরকার যতটুকু মানা সম্ভব ততটুকু মেনে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেগোসিয়েশন অব্যাহত রাখে। এ পর্যায়ে গত ২৯ জুন, ২০১২ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের কার্যকালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে একটি প্রেস নোট জারি করে। উক্ত প্রেস নোটটির ভাষা এবং অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর ও অপমানজনক। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যে আমার দৃষ্টিতে বেশ কিছু অতিরঞ্জন ও অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে। বিগত সেপ্টেম্বর, ২০১১ দু’টি ইন্্ভেস্টিগেশনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে মর্মে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা একেবারেই সত্য নয়Ñএটা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এপ্রিল, ২০১২ সালে ‘ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ঈড়হংঢ়বৎরপু’-এর সুনির্র্দিষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও কতিপয় ব্যবস্থা নিতে বলেÑযা একটি সার্বভৌম দেশের নিরপেক্ষ ইনস্টিটিউশনের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। তারা কথিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে এবং দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের পূর্ণ খবরদারি করার ক্ষমতা চায়Ñযা দুদক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সরকার মনে করে যে, সরকারী কর্মকর্তাগণ সুনির্দিষ্ট আইন, বিধি ও নিয়মের অধীনে প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত। তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি ছাড়া কাউকে বিশ্বব্যাংকের কথায় বিদায় করা অযৌক্তিক, যেখানে পুরু অভিযোগটিই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চলাকালে হঠাৎ করে ঋণচুক্তি বাতিল করার বিষয়টি স্বেচ্ছাচারিতার শামিল।
আমি আগেও উল্লেখ করেছি কনসালট্যান্সির বাজেট ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে এসএনসির প্রস্তাব ছিল ৪০ মিলিয়নেরও নিচে। তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছিল আরও দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান এবং দুটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৬ হাজার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবলের পাঁচ বছরব্যাপী ব্রিজ নির্মাণ কার্যক্রমের তদারকির কাজ। এ প্রেক্ষাপটে তাদের দ্বারা মোটা অঙ্কের ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব আমার কাছে একান্তই অমূলক মনে হয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্প থেকে মুনাফা করতে না পারলে নিজের পকেট থেকে বাংলাদেশে টাকা দেয়ার কথা নয়। মূলত মোঃ ইসমাইল নামক একজন বাংলাদেশী কানাডীয় ইঞ্জিনিয়ার এসএনসি-লাভালিনের পক্ষে অন্যান্য জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ প্রকল্পে প্রস্তাব দাখিল করেন মর্মে জানতে পেরেছি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে এসে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব দাখিল করে। এ সব প্রস্তাব দাখিলের পর দরদাতা সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগের পদ্মা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ব্রিটিশ, কানাডা ও জাপানের মান্যবর রাষ্ট্রদূতগণ মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে অনুরূপ উদ্দেশ্যে দেখা করেন। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে যার মাধ্যমে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। উল্লেখ্য, দরপ্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত এবং এ বিষয়ে কারও কোন অভিযোগ নেই। যদি মূল্যায়ন সঠিক থাকে, সেক্ষেত্রে কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগই অবান্তর।
রমেশ সাহা নামক এসএনসির কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ইতিপূর্বে তিনি বাংলাদেশে ২-১টি প্রকল্পে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তার ‘আউট-পুট’ ও আচরণ সুবিধার নয় বিধায় তাকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে চায় না। সে জন্যই উক্ত কোম্পানি প্রথমে তাকে এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রণয়ন ও দাখিলের সঙ্গে যুক্ত করেনি মর্মে প্রতীয়মান হয়। জনাব ইসমাইলের সঙ্গে তার সদভাব ছিল না। কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই চাকরি থেকে সরিয়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে নিজে বাংলাদেশে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়। উক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তার উর্ধতন কর্মকর্তা মি. কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। তার আচরণ এবং কাজের সুনাম না থাকায় এসএনসি-লাভালিন কাজ পেলে তার নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হবে না মর্মে মি. ওয়ালেসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। মি. ওয়ালেসও এতে সম্মত হন। এসএনসি-লাভালিনের অনুরূপভাবে সম্মিলিত মূল্যায়নে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ঐধষপৎড়-িএর সিইও বাংলাদেশে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলে তাকেও জানানো হয় যে, কাজ পেলে এ প্রকল্পে যোগ্য লোকবল নিয়োগ করতে হবে।
পরিলেখ
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য; অভিযোগকারীগণ ই-মেইলে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের এবং বিশ্বব্যাংকের মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ সদস্যের বিরুদ্ধেও বলেছে আমাদের সঙ্গে নাকি তাদের যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এসএনসি-লাভালিনকে ‘কাজ পাইয়ে দেয়ার’ জন্য আমরা যদি সত্যিকারভাবে দায়ী হই তবে তাদেরও দায় থাকা উচিত। উল্লিখিত ‘অপরাধের জন্য’ এমনকি একটি অযোগ্য চীনা কোম্পানিকে ‘কোয়ালিফাই’ করার জন্য যারা চাপ প্রয়োগ করেছিল বিশ্বব্যাংক কি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে? সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীগণের ব্যবহৃত ঢ়ধফসধথনৎরফমব@ুসধরষ.পড়স-এর অনুসন্ধানপূর্বক অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদ্ঘাটন করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই যে নিষ্ঠা, সততা ও সাহসিকাতার সঙ্গে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পদ্ধা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়েছি, তার পুরস্কারের বদলে পাচ্ছি অপবাদ ও সমালোচনা। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ এবং সৎ জীবনযাপন করি ও দেশপ্রেম বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে সরকারী কাজ করি। বত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে যে সব সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করেছি তারা সকলেই আমার সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাক্ষী। চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে ইন্্শাআল্লাহ্্ পদস্খলনের আর সম্ভাবনা নেই। বিষয়টি দুদকের তদন্তাধীন বিধায় তদন্তের ফলই বলে দেবে আমি দোষী কি না।
* এ নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব। এটি কোন সরকারী বক্তব্য নয়।
লেখক : সচিব ও নির্বাহী চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা।
দুর্নীতির অনুসন্ধান ও পরবর্তী পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাংকের পূর্বের প্রস্তাব ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু মন্ত্রীকে সরানোর পরও তারা স্থগিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেনি। সরকারের উপরের মহল থেকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান বিষয়টি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের হাতে। শোনা যায়, নিচের দিকে কিছু চেষ্টা হলেও জোয়েলিকের অনীহার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, কানাডিয়ান পুলিশ কর্তৃক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু করা হবে না। অক্টোবর, ২০১১ আমি সচিব থাকাকালীন বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পদ্মার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে কথা বলি। বিশ্বব্যাংকের যে সকল কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন তাদের অভিমত হলোÑ‘এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তবে আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না।’ এডিবি ও জাইকাসহ অন্যান্য সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তাগণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রকল্পের কার্যক্রমের মাঝপথে অর্থাৎ মূল সেতুর টেন্ডার আহ্বানের চূড়ান্ত মুহূর্তে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক কাজ বন্ধ করে দেয়া যৌক্তিক হয়নি মর্মে মতপ্রকাশ করেন। তবে তারা এ-ও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যেহেতু প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছে সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরও মেনে নিতে হয়।’ এদিকে সরকারের উপরের মহল বুঝতে পারে যে, পদ্মা সেতুর কাজে এ যাবৎ কোন দুর্নীতি হয়নি, তথাপি পদ্মা সেতুর কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের চাহিদামাফিক মন্ত্রীকে বদল করা হলো। তারপরও কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ এবং একজন মাননীয় উপদেষ্টার বিশ্বব্যাংকে গমন করে নেগোসিয়েট করা সত্ত্বেও কোন কাজ হয়নি। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে। তদন্তে মূল সেতুর বিষয়ে মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর কথিত দুর্নীতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সুপারভিশন কনসালট্যান্সি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য না দেয়ার কারণে এবং বিশ্বব্যাংকে চিঠি লিখে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ার কারণে এর তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের নিকট একটি চিঠি লিখে এবং কনসালট্যান্সি প্রদানের ক্ষেত্রে কথিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কতিপয় সরকারী-বেসরকারী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে। চিঠির কপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও দেয়া হয়। এবার অভিযোগের তীর আমার প্রতিও বর্ষিত হয়েছে মর্মে শুনতে পাই। উক্ত চিঠিতেও দুর্নীতির কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। শুধুমাত্র এসএনসি-লাভালিনের কেসে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে তথ্য আছে মর্মে এবং আরও কিছু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়, যদিও সে সব সূত্রের নাম প্রকাশ করা হয়নি। পত্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের সবগুলো দফা সরকারের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় বিধায় সরকার যতটুকু মানা সম্ভব ততটুকু মেনে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেগোসিয়েশন অব্যাহত রাখে। এ পর্যায়ে গত ২৯ জুন, ২০১২ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের কার্যকালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে একটি প্রেস নোট জারি করে। উক্ত প্রেস নোটটির ভাষা এবং অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর ও অপমানজনক। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যে আমার দৃষ্টিতে বেশ কিছু অতিরঞ্জন ও অসত্য তথ্য দেয়া হয়েছে। বিগত সেপ্টেম্বর, ২০১১ দু’টি ইন্্ভেস্টিগেশনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে মর্মে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা একেবারেই সত্য নয়Ñএটা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এপ্রিল, ২০১২ সালে ‘ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ ঈড়হংঢ়বৎরপু’-এর সুনির্র্দিষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও কতিপয় ব্যবস্থা নিতে বলেÑযা একটি সার্বভৌম দেশের নিরপেক্ষ ইনস্টিটিউশনের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। তারা কথিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে এবং দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের পূর্ণ খবরদারি করার ক্ষমতা চায়Ñযা দুদক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সরকার মনে করে যে, সরকারী কর্মকর্তাগণ সুনির্দিষ্ট আইন, বিধি ও নিয়মের অধীনে প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত। তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি ছাড়া কাউকে বিশ্বব্যাংকের কথায় বিদায় করা অযৌক্তিক, যেখানে পুরু অভিযোগটিই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চলাকালে হঠাৎ করে ঋণচুক্তি বাতিল করার বিষয়টি স্বেচ্ছাচারিতার শামিল।
আমি আগেও উল্লেখ করেছি কনসালট্যান্সির বাজেট ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে এসএনসির প্রস্তাব ছিল ৪০ মিলিয়নেরও নিচে। তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছিল আরও দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান এবং দুটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৬ হাজার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবলের পাঁচ বছরব্যাপী ব্রিজ নির্মাণ কার্যক্রমের তদারকির কাজ। এ প্রেক্ষাপটে তাদের দ্বারা মোটা অঙ্কের ঘুষ দেয়ার প্রস্তাব আমার কাছে একান্তই অমূলক মনে হয়েছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্প থেকে মুনাফা করতে না পারলে নিজের পকেট থেকে বাংলাদেশে টাকা দেয়ার কথা নয়। মূলত মোঃ ইসমাইল নামক একজন বাংলাদেশী কানাডীয় ইঞ্জিনিয়ার এসএনসি-লাভালিনের পক্ষে অন্যান্য জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ প্রকল্পে প্রস্তাব দাখিল করেন মর্মে জানতে পেরেছি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে এসে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব দাখিল করে। এ সব প্রস্তাব দাখিলের পর দরদাতা সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগের পদ্মা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ব্রিটিশ, কানাডা ও জাপানের মান্যবর রাষ্ট্রদূতগণ মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে অনুরূপ উদ্দেশ্যে দেখা করেন। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটি রয়েছে যার মাধ্যমে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। উল্লেখ্য, দরপ্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত এবং এ বিষয়ে কারও কোন অভিযোগ নেই। যদি মূল্যায়ন সঠিক থাকে, সেক্ষেত্রে কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগই অবান্তর।
রমেশ সাহা নামক এসএনসির কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ইতিপূর্বে তিনি বাংলাদেশে ২-১টি প্রকল্পে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তার ‘আউট-পুট’ ও আচরণ সুবিধার নয় বিধায় তাকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে চায় না। সে জন্যই উক্ত কোম্পানি প্রথমে তাকে এ প্রকল্পের প্রস্তাব প্রণয়ন ও দাখিলের সঙ্গে যুক্ত করেনি মর্মে প্রতীয়মান হয়। জনাব ইসমাইলের সঙ্গে তার সদভাব ছিল না। কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই চাকরি থেকে সরিয়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে নিজে বাংলাদেশে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়। উক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তার উর্ধতন কর্মকর্তা মি. কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। তার আচরণ এবং কাজের সুনাম না থাকায় এসএনসি-লাভালিন কাজ পেলে তার নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হবে না মর্মে মি. ওয়ালেসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। মি. ওয়ালেসও এতে সম্মত হন। এসএনসি-লাভালিনের অনুরূপভাবে সম্মিলিত মূল্যায়নে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ঐধষপৎড়-িএর সিইও বাংলাদেশে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলে তাকেও জানানো হয় যে, কাজ পেলে এ প্রকল্পে যোগ্য লোকবল নিয়োগ করতে হবে।
পরিলেখ
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য; অভিযোগকারীগণ ই-মেইলে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের এবং বিশ্বব্যাংকের মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ সদস্যের বিরুদ্ধেও বলেছে আমাদের সঙ্গে নাকি তাদের যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এসএনসি-লাভালিনকে ‘কাজ পাইয়ে দেয়ার’ জন্য আমরা যদি সত্যিকারভাবে দায়ী হই তবে তাদেরও দায় থাকা উচিত। উল্লিখিত ‘অপরাধের জন্য’ এমনকি একটি অযোগ্য চীনা কোম্পানিকে ‘কোয়ালিফাই’ করার জন্য যারা চাপ প্রয়োগ করেছিল বিশ্বব্যাংক কি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে? সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীগণের ব্যবহৃত ঢ়ধফসধথনৎরফমব@ুসধরষ.পড়স-এর অনুসন্ধানপূর্বক অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদ্ঘাটন করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলতে চাই যে নিষ্ঠা, সততা ও সাহসিকাতার সঙ্গে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পদ্ধা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়েছি, তার পুরস্কারের বদলে পাচ্ছি অপবাদ ও সমালোচনা। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ এবং সৎ জীবনযাপন করি ও দেশপ্রেম বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে সরকারী কাজ করি। বত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে যে সব সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করেছি তারা সকলেই আমার সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাক্ষী। চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে ইন্্শাআল্লাহ্্ পদস্খলনের আর সম্ভাবনা নেই। বিষয়টি দুদকের তদন্তাধীন বিধায় তদন্তের ফলই বলে দেবে আমি দোষী কি না।
* এ নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব। এটি কোন সরকারী বক্তব্য নয়।
লেখক : সচিব ও নির্বাহী চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা।
No comments