জামায়াত-বিএনপির ‘আন্দোলনে’র প্রস্তুতি by রাহাত খান

দেখে-শুনে মনে হয় জামায়াত-বিএনপিপন্থীরা তাদের রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে এমন একটি পরিকল্পনা করেছেন যার বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই তারা মাঠে নেমে গেছেন। দলীয় ব্যানারে তেমন কিছু করছেন না তারা। তাদের সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা আপাতত নেই বলেই অনেকে মনে করেন।


তবে সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ক্ষোভ ও ক্রোধ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা কিছু তো করতে হবে। তা নইলে রমজান ও ঈদের পর জামায়াত-বিএনপি ঘোষিত কঠোর কর্মসূচীর আন্দোলনটা তাদের হবে কিভাবে। রমজান ও ঈদের পর দেশে একটা বড় ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি না করলে যে বিএনপি- জামায়াতের রাজনীতি বাঁচে না। চাপাবাজি বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপারে ভাল-মন্দ বিচার না করে শুধু অন্ধভাবে সরকারের সমালোচনা করলে তো আন্দোলন হয় না। আর রাজনৈতিকভাবে বাঁচতে হলে পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচন জিতে সরকারে যেতে হলে জামায়াত-বিএনপির দেশব্যাপী বড় একটা আন্দোলন করা চাই-ই চাই।
জামায়াত-বিএনপির হাতে গ্রেনেড, বোমা, বন্দুক পিস্তল আততায়ী সবই গোপনে মজুদ আছে। আছে তাদের গ্রেনেড ও বোমাবাজি করা ‘শিল্পীরা’। তাদের দিয়ে দেশে একটা আতঙ্ক ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যায় অনায়াসে। বিশেষ কথা কি, জামায়াত-বিএনপির আদর্শ দেশ পাকিস্তান, সুদান, সোমলিয়া প্রভৃতি দেশে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সহায়তায় এরাই তো সেসব দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে জামায়াত-বিএনপি বার বার ‘ন্যাড়া মাথায়’ ‘বেলতলায়’ যাবে না। ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দলকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এবং বাংলাদেশকে একটি ‘আদর্শ শক্তিশালী’ জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করা এবং দেশে লুণ্ঠন ও লুটপাট করা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করার কৌশল তো তারা নিয়েছিল। তাদের শাসনামলে দেশ-বিদেশের জঙ্গীরা কি নিশ্চিন্তে বাংলাদেশে বসবাস করত। পুলিশ প্রটেকশনে জঙ্গীদের পালাবার ব্যবস্থাও জামায়াত-বিএনপির আমলেই হয়েছে। চট্টগ্রামে ধরা পড়া দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের নির্বিঘœ পাচারে জামায়াত-বিএনপি সরকারের যে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল তাও তো দেশে জনগণের কাছে পরিষ্কার। এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরও দেয়া যায় যা মানুষের বিপক্ষে যায়। গণতন্ত্রের বিপক্ষে যায়। কিন্তু জামায়াত-বিএনপির কাছে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ ও গণতন্ত্র তো তাদের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির কোন এজেন্ডা নয়! তারা ক্ষমতায় গেলে তবে না গণতন্ত্র! তা নইলে কিসের গণতন্ত্র।
যা হোক ২০০১-২০০৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে দেশে বোমাবাজি গ্রেনেডবাজি কাহাকে বলে উহা কত প্রকার ও কি কি তার কিছু কিছু নমুনা জামায়াত-বিএনপি দেখিয়েছিল। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, উদ্দেশ্য ছিল গত তিন-সাড়ে তিন দশকে (২০০৬ সাল পর্যন্ত) দ্রুত উন্নতি-সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকা দেশ, বাংলাদেশকে টেনে নামিয়ে সুদান, সোমালিয়া বা পাকিস্তানের ন্যায় প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে নামিয়ে আনা। আফসোস দেশের মানুষ সেটা পছন্দ করল না, বরং জামায়াত- বিএনপির রাজনৈতিক মতলবটা বুঝে ফেলল। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এবং পশ্চিমা দেশগুলোও তত দিনে ক্ষমতাসীন জামায়াত-বিএনপির মতলব বুঝে ফেলেছিল।
অথচ ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়, পাশ্চাত্যের শক্তিধর দেশগুলোর কাছে বিএনপি-জামায়াত লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা ক্ষমতায় যেতে পারলে বাইরে গ্যাস রফতানি করবে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনর্¯’াপন করবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নন-কানেটিভিটির দুয়ার অবারিত করে দেবে। জঙ্গীবাদ হত্যা-গুমের রাজনীতির সঙ্গে কোন সম্পর্ক তারা রাখবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০০০-২০০১ সালে নির্বাচনে টুইসডে ক্লাব নামে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ভারত অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায় ঢাকার কূটনীতিকদের নিয়ে একটি অঘোষিত ক্লাব তৈরি হয়েছিল যারা নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা যুগিয়ে ভয়াবহ সেনা সন্ত্রাস ও কারচুপির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে অবৈধপন্থায় জয়ী হতে গোপনে সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে অবশ্য জামায়াত-বিএনপি একটা প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। বাইরে বাইরে “পাশ্চাত্য ও জাপানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিল ঠিকই, তবে ২০০১-২০০৬ জামায়াত-বিএনপি সরকার পূরণ করতে সচেষ্ট ছিল বাংলাদেশকে একটি জঙ্গীরাষ্ট্রে পরিণত করা যায় কিনা, তাদের বহুত পেয়ারা দেশ প্রায় ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাতারে নামিয়ে আনা যায় কিনা, সেই গোপন এজেন্ডা পরিপূরণে। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসবাদী, লুণ্ঠনবাদী ‘স্বৈরশাসনে’ শুধু যে দেশের মানুষ রুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, তাই নয়, জাপান এবং পাশ্চাত্যের শক্তিধর দেশগুলোও বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের কায়দায় বিএনপি-জামায়াত সরকার একদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে ঋণ, মজুরি ও উন্নয়ন খাতে মোটা টাকা নিয়েছে, অন্যদিকে গোপনে লালন-পালন করেছে তারা লস্কর-ই তৈয়বা, আল কায়েদা, হুজি, জেএমবিসহ নানা দেশী-বিদেশী সন্ত্রাসীদের এবং বাংলাদেশকে তারা ভারতে সন্ত্রাস চালানোর দেশ তথা দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে সর্বতোভাবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটিসহ পাশ্চাত্যের সেরা দেশগুলো এবং জাপান ও ভারত নিশ্চয়ই এতদিনে বিএনপি-জামায়াতের আসল চরিত্র হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়েছে। হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে সেটা তাদের এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। ২০০১-৬ সালে নিজেদের জঙ্গীবাদী স্ট্র্যাটেজি যে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে জামায়াত-বিএনপি। এবার তাই আন্দোলনের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে আপাতত গ্রেনেড ও বোমাবাজ ‘শিল্পী’দের সাহায্য তারা নিচ্ছে না। তারা জানে আগের মতো গুপ্তহত্যা, গুম বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি করলে হারার আগেই তারা হেরে যাবে। পাশ্চাত্য শক্তি ভারত প্রভৃতি দেশের তো জামায়াত-বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ারই কথা কারণ বাইরে কূটনৈতিক ভদ্রতা যতই দেখাক, ভেতরে ভেতরে তারা বেশ জানে যে জামায়াত-বিএনপি পাকিস্তানের জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসবাদী ‘আদর্শে’র এক্সটেনশন বৈ আর কিছু নয়। দেশের লোকেরাও বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তানী ‘আদর্শ’কে ততটা ঘৃণা করে যতটা দুর্ভোগ ও দুঃসহ পরিস্থিতির শিকার তাদের হতে হয়েছিল ২০০১-২০০৬ এবং ১৯৭১ সালের ন’মাসে।
কাজেই বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে আপাতত কাজে লাগাতে চাইছে না। তাতে হিতেবিপরীত হবে সেটা তারাও জানে। জানে সরকারবিরোধী একটা আন্দোলন তাদের দেশব্যাপী গড়ে তুলতেই হবে, কেননা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা তারা করেছিল, সেসব ইস্যু তো ফ্লপ করেছেই পদ্মা সেতু ইস্যুতেও প্রধানমন্ত্রীর সাহসী কণ্ঠ দেশব্যাপী দেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মহাজোট সরকারপক্ষে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে কাজেই আগামী রমজান মাস ও ঈদের পর ‘কঠোর’ আন্দোলনে যেতে হলে তাদের চাই নতুন রাজনৈতিক কৌশল বা ইস্যু।
সেই রাজনৈতিক কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি জামায়াত- বিএনপি পরিকল্পিতভাবে করেছে। আমার বিবেচনায় পাঁচটি ক্ষেত্রে সংগঠনগত আন্দোলন ও নৈরাজ্য তৈরি করে, সেই পুঁজি সম্বল করে তারা ঈদের পর বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে চাইছে। খুবই সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত তাদের রাজনৈতিক কৌশল। আমার তাতে কোন সন্দেহ নেই।
(এক) দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দাবি-দাওয়ার নামে আন্দোলন তথা নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। সেটা ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বহু জঙ্গীবাদী, উগ্রপন্থী যোগ্য অযোগ্য ব্যক্তিকে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক পদে নিযুক্তি দেয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের বিশেষ করে জামায়াতের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন শিবিরকে নানাভাবে এমন শক্তিশালী করা হয়েছে, এত টাকা ঢালা হয়েছে মেধাবী বহু দরিদ্র শিক্ষার্থীর সাহায্য ও মগজ-ধোলাইর পেছনে, এমন সব অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র এবং এমন কমান্ডো প্রশিক্ষণ শিবির ক্যাডারদের দেয়া হয়েছে যে, প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েই তারা বহু ক্ষেত্রে গ্রাহ্য করার মতো শক্তি হিসাবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। এইসব লুকিয়ে থাকা জঙ্গীবাদী শিক্ষক এবং জঙ্গীবাদী ছাত্র সংগঠনের সাহায্য নিয়ে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা তো যায়ই। আমার ধারণা, বর্তমানে বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা চলছে, তা বিএনপি- জামায়াতের সেই আলোচ্য রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আগামী নির্বাচনে ভোটারও বটেই। তারাই এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শের সমর্থক। আল-বদর, রাজাকার, আল শামস, মুসলিম লীগ, পাকিস্তানপন্থী অংশের বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের তারা ঘোরবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রধান সহায় তারাই গ্রাম বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীসহ। বেশিরভাগ যুক্তিহীন দাবি-দাওয়ার ধুয়া তুলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণদের বিভ্রান্ত করাও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় খামোকা গড়ে ওঠা ঐসব প্রো-জামায়াত, প্রো-বিএনপি শিক্ষক ও সংগঠনের হিডেন এজেন্ডা।
(দুই) বিএনপি-জামায়াত গার্মেন্টস সেক্টরে বহিরাগতদের দিয়ে প্রচুর অর্থ ঢেলে দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সেক্টরে আন্দোলন সংগঠনের মাধ্যমে সেক্টরের কাজে-কর্মে অচলাবস্থা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। সেই চেষ্টায়ও যে তারা হঠাৎ হঠাৎ করছে, এও তো চোখের সামনে দেখতে পারছি।
(তিন) বিদ্যুতে বাংলাদেশ প্রায় সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। ২০১৩ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুত চাহিদার অন্তত ৯০ ভাগ পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরাই স্বীকার করেন। তবে এই সেক্টরে ‘ভূতের’ উপদ্রব নিহায়ত কম না। বিদ্যুত সরবরাহ সম্ভব, কিন্তু নানা স্টেশন, উপ-স্টেশনে লুকানো এ ভূতেরা সুযোগ পেলেই লোডশেডিং করে জনগণের জন্য অসহ্য বিদ্যুত ও পানি-সঙ্কট সৃষ্টি করে সরকারকে বিদ্যুত সেক্টরে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করছে।
(চার) রেল ও বাস পরিবহন সেক্টর।
(পাঁচ) প্রশাসন।
সর্বত্র জামায়াত-বিএনপির ভূতেরা সক্রিয়। বাংলাদেশে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে গোপনে সুড়ঙ্গ তৈরি করে বিকল্প পাইপলাইন তৈরির একটা ‘ষড়যন্ত্র’ও তো ধরা পড়েছে সম্প্রতি রুনি-সাগর হত্যা অনুসন্ধানরত গোয়েন্দা কমান্ডের মাধ্যমে। আমার ধারণা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব অপকর্মকা- বিএনপি-জামায়াতের লুকানো ভূতেরাই করছে রমজান ও ঈদের পর বিএনপি-জামায়াত বিরোধিত কঠোর আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। কাজেই এসব ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.