চরাচর-বাঁশিওয়ালা বাজাও বাঁশি ... by জাহাঙ্গীর হোসেন

বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। চোরা দিনদুপুরে চুরি করে/রাত্তিরে তো কথা নাই/ডাকাতিয়া বাঁশি। চোর বলুন আর ডাকাতই বলুন মনুষ্য হৃদয় হরণ করার সবচেয়ে আদি ও ভয়ানক অস্ত্রটির নাম বাঁশি। প্রায় ৪৩ হাজার বছর আগের বাঁশিটি পাওয়া গেছে জার্মানিতে। এই অর্থে বাঁশিকে মানুষের তৈরি প্রাচীনতম সংগীতযন্ত্র বলা যায়।


বাঁশি সে যে বাঁশের, যে ঢঙেরই হোক, দেশে দেশে এর আবেদন সমান। গ্রামবাংলার অবলা নারী অভিযোগের স্বরে বলেন, 'সরলা বাঁশের বাঁশি ছিদ্র গোটা ছয়/বাঁশি কতই কথা কয়। নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি রহন না যায়/প্রাণ সখী রে ঐ শোন কদম্বতলায় বংশী বাজায় কে।' সরলা এই বাঁশির আবেদন সরল পরিবেশেই যথার্থ। শহুরে যান্ত্রিকতা ও ব্যস্ততার মধ্যে বাঁশির মতো সরল যন্ত্রটিও যেন দিশেহারা। এত হাজার বছর ধরে যে বাঁশি সিঁদ কেটেছে হৃদয়ের ঘরে, সে বাঁশি শহরে এসে যেন কোনো ঘরই খুঁজে পায় না, সিঁদ কাটবে কী? তবু জয়নাল মিয়া বাঁশির কানে কানে ফুঁ দিয়ে জীবন্ত করে তোলেন এই মোহন বাঁশিকে। ফার্মগেট থেকে শুরু করে শিশুপার্ক পর্যন্ত তার পথচলা। কাঁধে কবি-সাহিত্যিকদের মতো ঝোলা। ঝোলাভর্তি বিভিন্ন মাপের বাঁশি। মাঝেমধ্যে জয়নাল মিয়াকে খুঁজে পাবেন চারুকলার সামনে। ঝোলা থেকে যেকোনো একটি বাঁশি বের করে জয়নাল মিয়ার হাতে দিয়ে দেখুন। জাদুকরের হাতের ফুল যেমন নিমেষেই পায়রা হয়ে উড়ে যায়, তেমনি যেকোনো বাঁশির কানে কানে জয়নাল মিয়া কথা বললেই যেন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে বাঁশি, আর সুর ছড়ায় হাস্নাহেনার মতো অকৃপণ হাতে। কেউবা দাঁড়িয়ে বাঁশি শোনে, কেউবা দু-তিনটি বাঁশি নাড়াচাড়া করে সুর ওঠাতে চায় জয়নাল মিয়ার মতো। ব্যস্ত মানুষজনের স্রোত বয়ে যায় নদীর মতো। নদীকে নিয়ে বাজানো গান কারো কানেই যেন যায় না। 'আজি নদী না যাইও রে বইদো/নদী না যাইও রে, বইদো/নদীরো ঘোলারে ঘোলা পানি' গানে যখন টান মারেন জয়নাল, তখন যাঁরা আব্বাসউদ্দীনের এই গান শুনেছেন, তাঁদের পা চলে না। ... জয়নালের বাঁশি আবেদন জানায় বইদোকে নদীতে না যাইতে। আর পথচারীর পা আটকে যায় সুরের মূর্ছনায়। সুর ও সংগীতের কোনো সীমা নেই। সুর-সংগীত সর্বজনীন। মাঝেমধ্যে জয়নাল বাঁশির কানে ফুঁ দেন আর বাঁশি গেয়ে ওঠে- ছুপ গায়া কই রে দুরসে পুকারকে/দারদে আনুখে হায় দে গায়া পেয়ারকে। লতাজির মায়াভরা কণ্ঠ ধারণ করতে একটুও অপারগ নয় যেন প্রাচীনতম এই যন্ত্র। সুর ও আবেগ ঢেলে বাঁশি কেঁদে যায়। কথাগুলো হয়তো হিন্দিতে; কিন্তু যাঁরা হিন্দি বোঝেন না, তাঁরাও যেন টের পান- বাঁশি বলছে, দূর থেকে ডাক দিয়ে কে যেন হারিয়ে গেল আর দিয়ে গেল প্রেমের গহিনতম ও নিগূঢ়তম বেদনা। জয়নাল মিয়ার বাঁশি শুনে কেউবা ঘরে ফেরে বাঁশি নিয়ে, কেউবা সুরের মূর্ছনা নিয়ে। কিন্তু জয়নাল মিয়ার ঘরে ফেরা হয় না। তাঁর যে কোনো ঘর নেই। যে নদীতে না যাইতে বইদোকে নিষেধ করে তাঁর বাঁশি, সেই নদীই সব কেড়ে নিয়েছে জয়নাল মিয়ার। ঘুম থেকে উঠে দেখেন, নিজে ভাসছেন নদীতে আর পরিবার হয়তো ভেসে গেছে আরো আগেই। যে ঘরে পরিবার নেই, সেই ঘরে জয়নাল মিয়া আর কোনো দিন ফিরবেন না।
জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.