সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! by সুভাষ সাহা
হায়! কী দুর্ভাগা আমরা_ দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪১ বছরের মাথায়ও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন রেখা মুছে গেল না। এখনও কে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা একাত্তরে শান্তি কমিটির কেউকেটা হিসেবে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ঠিকুজি সন্ধান করতে হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারীদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে পুনর্বাসনের কারণেই আমাদের আজও পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হচ্ছে। কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদের বক্তব্যের পর মনে হচ্ছে, এসবের কি কোনো প্রয়োজন কখনও ছিল! তাদের আমলনামা কেন আবার সামনে আনতে হচ্ছে? মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল অলির কথা মানতে হলে এদের পাপাচার মোটেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। অলি একজন প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তাদের স্বাধীনতাবিরোধী নয়_ অর্থাৎ তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির সার্টিফিকেট দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী কি একাত্তরে হত্যা, লুটপাট, খানসেনাদের সার্বক্ষণিক দোসর হিসেবে কাজ করার মতো অপরাধ সংঘটনে কোনো ভূমিকা রাখেনি! তাহলে কারা সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থানে সঙ্গিন হাতে দাঁড়িয়েছিল? আজ যাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই কি জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নয়! কর্নেল অলি হয়তো ভুলে গেছেন যে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা-ক্যাডাররা তাদের একাত্তরের ঘৃণ্য ভূমিকার জন্য এখনও জাতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। আর তারা তাদের ঘরোয়া পর্যায়ে এসব অপরাধকে আড়াল করার প্রয়াস পায় ধর্মীয় নানা উদাহরণ ও পবিত্র যুদ্ধের বয়ানের মাধ্যমে। সুতরাং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির সন্ধান করার পেছনে কর্নেল অলির ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে যদি কেউ দাবি করেন, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কোন যুক্তিতে? এ প্রসঙ্গে আরেকজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, যিনি সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, সেই প্রয়াত লে. জেনারেল মীর শওকতের আলোচিত একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। তিনি রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীতে যারা ছিল এবং যারা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করা দূরে থাক হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করতে চাইতেন না। একবার নাকি মন্ত্রী হওয়ার সময় তাকে এক রাজাকারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে হয়েছিল বলে তিনি সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে এ বিএনপি নেতা দল থেকে নিজেই সরে গিয়েছিলেন। বলা হয়, লে. জেনারেল মীর শওকত ও কর্নেল অলি মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের সময় চট্টগ্রামে ছিলেন এবং জিয়ার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণায় উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। বলা হয়, অলিই হচ্ছেন প্রথম বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা যিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। অথচ সে সময়ের দুই সুহৃদ মীর শওকত ও কর্নেল অলির মধ্যে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পারস্পরিক কী বিপরীতমুখী পরিবর্তন! মীর শওকত বিএনপির রাজনীতি করেছেন, মন্ত্রী হয়েছেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাতে কুণ্ঠিত ছিলেন। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ার পর তিনি দল ছেড়ে দিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সঙ্গে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে লড়ে গেছেন। আর অলি এখন যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতাবিরোধী নয় বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! স্বার্থের বিনিময়ে কী না হয় এখানে! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলার সময় কর্নেল অলির এমন বক্তব্য যুদ্ধাপরাধকে রাজনীতির হীন স্বার্থচক্রে বন্দি করে মানুষের কাছে এই অপরাধের ভয়াবহতাকে আড়াল করার চেষ্টা বৈ কিছু নয়।
No comments