পার্বত্য চট্টগ্রাম-নারীর প্রতি সহিংসতা ও সাম্প্রতিক ঘটনা by ইলিরা দেওয়ান
সম্প্রতি আদিবাসী নারীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। গত ১৬ জুন আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার বিচারের দাবিতে জাতীয় কয়েকটি নারী সংগঠন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত পাহাড় ও সমতলে ১৯ জন আদিবাসী
নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে (সূত্র: প্রথম আলো), যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামেই সংঘটিত হয়েছে ১১টি। ১৯ জনের মধ্যে ১০ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে দুটি শিশুকে (৭ ও ১১ বছর বয়সী) ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বাকি আটজনের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৬-এর মধ্যে। সম্প্রতি ৮ জুলাই বলিমিলা চাকমা নামে আরেক আদিবাসী নারীকে রাঙামাটিতে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এভাবে একের পর এক ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনার প্রধান কারণ হলো অতীতে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার না হওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া।
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৮(১) ধারা মোতাবেক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পক্ষ থেকে ২০১০-১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের তথ্য চাওয়া হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ওই দুই বছরে তিন পার্বত্য জেলায় মোট ২১৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন-বিষয়ক মামলা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলা সবচেয়ে বেশি। প্রাপ্ত তথ্যে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, এসব মামলার মধ্যে এসিড নিক্ষেপের মামলা একদম নেই এবং পাচারসংক্রান্ত মামলা রাঙামাটি ও বান্দরবানে মাত্র তিনটি। এ ছাড়া ২১৫টি মামলার মধ্যে ১৬৬টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, রায় হয়েছে মাত্র নয়টির। আর রায় হওয়া মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের সংখ্যা শূন্য! প্রাপ্ত মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি মামলার সংখ্যা বেশি হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যই প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্ত বক্তিরা শাস্তির আওতায় আসে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত ৯ মে ১১ বছরের সুজাতা চাকমার হত্যাকারী ঘাতক মো. ইব্রাহিম সুজাতাকে ধর্ষণ ও হত্যার এক বছর আগে সুজাতার মামাতো বোনকে ধর্ষণ করার অপরাধে কয়েক মাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়েছিল। এর পরই সুজাতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। যদি প্রথম অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে এই ঘাতক দ্বারা শিশু সুজাতার জীবনহানি ঘটত না। আমরা চাই, বর্তমানে আটক এই ঘাতকের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন নির্মম ঘটনা সংঘটনের আগে কয়েকবার ভাবতে বাধ্য হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারাও আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আমরা কেবল নথিভুক্ত ২১৫টি মামলার তথ্য জানতে পেরেছি। কিন্তু পাহাড়ে প্রায়ই এমন অনেক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, যেগুলো অনেকে সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে প্রকাশ করতে চান না। কখনো কখনো নিরাপত্তা হুমকির কারণে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলাও করতে পারেন না। যেমন: গত ৩০ মে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের চাকমাপল্লিতে ভূমিগ্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে এবং নারীদের ওপর হামলা চালায়। আজ অবধি এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানা যায়নি; বরং নিরাপত্তার অভাবে ওই গ্রামের পুরুষ সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভূমির সঙ্গে আদিবাসী নারীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আদিবাসীরা মাটি বা পাহাড়কে যেভাবে মা বা দেবী মানে, তেমনি নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা বজায় রাখাও আদিবাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আজ পাহাড় ও সমতলে ভূমিগ্রাসীদের কাছে ভূমির সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নারীরাও লোভের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। যে ভূমির ওপর ভূমিদস্যুদের দৃষ্টি পড়ে, ওই ভূমি থেকে আদিবাসী পরিবারগুলো উচ্ছেদ করতে প্রথমে তারা যে কৌশলটি বেছে নেয় তা হলো, নারীর মর্যাদার ওপর আঘাত হানা। পরে ভয়ভীতি প্রদর্শন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ও হামলা করে তাদের ভিটেছাড়া করা হয়। আদিবাসীদের ভূমি বেদখলের ঘটনা পাহাড় ও সমতলে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এই বেদখল কেবল ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর অধিগ্রহণের মাধ্যমেও আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে।
নিজের ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ভূমিহারা নিঃস্ব মানুষের মিছিল দিনে দিনে দীর্ঘতরই হচ্ছে। সম্প্রতি বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের আমতলীপাড়ার ১৩টি ম্রো পরিবার ভূমিদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। ঢাকার ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরিফ’ গোষ্ঠী (যারা স্থানীয়দের কাছে ‘লাদেন গ্রুপ’ নামে পরিচিত) এই ম্রো পরিবারগুলোর ভূমি বেদখল করে নিয়েছে (সূত্র: ৮ জুলাই, প্রথম আলো)। এই গোষ্ঠীর কী এমন অদৃশ্য ক্ষমতা আছে, যার জন্য প্রশাসনের নির্দেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভূমি বেদখল অব্যাহত রেখেছে!
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের হেডম্যানদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার পাহাড়িদের ভূমির অধিকার রক্ষা করবে। পার্বত্য এলাকায় ভূমির মালিকানা যাতে পাহাড়িরাই পায়, তা নিশ্চিত করা হবে’ (সূত্র: ৭ জুলাই, সমকাল)। আমরাও চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত প্রথাগত ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনা হোক।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
ilira.dewan@gmail.com
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৮(১) ধারা মোতাবেক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পক্ষ থেকে ২০১০-১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের তথ্য চাওয়া হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ওই দুই বছরে তিন পার্বত্য জেলায় মোট ২১৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন-বিষয়ক মামলা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলা সবচেয়ে বেশি। প্রাপ্ত তথ্যে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, এসব মামলার মধ্যে এসিড নিক্ষেপের মামলা একদম নেই এবং পাচারসংক্রান্ত মামলা রাঙামাটি ও বান্দরবানে মাত্র তিনটি। এ ছাড়া ২১৫টি মামলার মধ্যে ১৬৬টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, রায় হয়েছে মাত্র নয়টির। আর রায় হওয়া মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের সংখ্যা শূন্য! প্রাপ্ত মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি মামলার সংখ্যা বেশি হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যই প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্ত বক্তিরা শাস্তির আওতায় আসে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত ৯ মে ১১ বছরের সুজাতা চাকমার হত্যাকারী ঘাতক মো. ইব্রাহিম সুজাতাকে ধর্ষণ ও হত্যার এক বছর আগে সুজাতার মামাতো বোনকে ধর্ষণ করার অপরাধে কয়েক মাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়েছিল। এর পরই সুজাতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। যদি প্রথম অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে এই ঘাতক দ্বারা শিশু সুজাতার জীবনহানি ঘটত না। আমরা চাই, বর্তমানে আটক এই ঘাতকের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন নির্মম ঘটনা সংঘটনের আগে কয়েকবার ভাবতে বাধ্য হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারাও আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আমরা কেবল নথিভুক্ত ২১৫টি মামলার তথ্য জানতে পেরেছি। কিন্তু পাহাড়ে প্রায়ই এমন অনেক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, যেগুলো অনেকে সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে প্রকাশ করতে চান না। কখনো কখনো নিরাপত্তা হুমকির কারণে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলাও করতে পারেন না। যেমন: গত ৩০ মে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের চাকমাপল্লিতে ভূমিগ্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে এবং নারীদের ওপর হামলা চালায়। আজ অবধি এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানা যায়নি; বরং নিরাপত্তার অভাবে ওই গ্রামের পুরুষ সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভূমির সঙ্গে আদিবাসী নারীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আদিবাসীরা মাটি বা পাহাড়কে যেভাবে মা বা দেবী মানে, তেমনি নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা বজায় রাখাও আদিবাসীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আজ পাহাড় ও সমতলে ভূমিগ্রাসীদের কাছে ভূমির সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নারীরাও লোভের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। যে ভূমির ওপর ভূমিদস্যুদের দৃষ্টি পড়ে, ওই ভূমি থেকে আদিবাসী পরিবারগুলো উচ্ছেদ করতে প্রথমে তারা যে কৌশলটি বেছে নেয় তা হলো, নারীর মর্যাদার ওপর আঘাত হানা। পরে ভয়ভীতি প্রদর্শন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ও হামলা করে তাদের ভিটেছাড়া করা হয়। আদিবাসীদের ভূমি বেদখলের ঘটনা পাহাড় ও সমতলে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এই বেদখল কেবল ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর অধিগ্রহণের মাধ্যমেও আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে।
নিজের ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ভূমিহারা নিঃস্ব মানুষের মিছিল দিনে দিনে দীর্ঘতরই হচ্ছে। সম্প্রতি বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের আমতলীপাড়ার ১৩টি ম্রো পরিবার ভূমিদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। ঢাকার ‘মুহম্মদিয়া জামিয়া শরিফ’ গোষ্ঠী (যারা স্থানীয়দের কাছে ‘লাদেন গ্রুপ’ নামে পরিচিত) এই ম্রো পরিবারগুলোর ভূমি বেদখল করে নিয়েছে (সূত্র: ৮ জুলাই, প্রথম আলো)। এই গোষ্ঠীর কী এমন অদৃশ্য ক্ষমতা আছে, যার জন্য প্রশাসনের নির্দেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভূমি বেদখল অব্যাহত রেখেছে!
সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের হেডম্যানদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার পাহাড়িদের ভূমির অধিকার রক্ষা করবে। পার্বত্য এলাকায় ভূমির মালিকানা যাতে পাহাড়িরাই পায়, তা নিশ্চিত করা হবে’ (সূত্র: ৭ জুলাই, সমকাল)। আমরাও চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত প্রথাগত ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনা হোক।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
ilira.dewan@gmail.com
No comments