বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও নেতৃত্ব আত্মজীবনী থেকে পুনর্পাঠ by ড. হারুন-অর-রশিদ

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। তিনি বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম সন্তান। ইতিহাসের মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি আমাদের জাতির জনক ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।


সম্প্রতি দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই আকারে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রকাশ করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও অন্যান্য ঘটনা এতে স্থান পেয়েছে। বইটি পাঠ থেকে জানা যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বঙ্গবন্ধু এটি লেখা শুরু করেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের ৩৭ বছর পর এটি প্রকাশিত হলো। ৪টি খাতায় বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লেখা স্মৃতিকথা ২০০৪ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছে। সেও এক অলৌকিক ঘটনা, যা বইয়ে তাঁর (শেখ হাসিনা) ভূমিকা থেকে জানা যায়।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী গ্রন্থে, অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে, তাঁর নেতৃত্ব, নেতৃত্বের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ, বাঙালীর ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতি-কৃষ্টির প্রতি বঙ্গবন্ধুর একাগ্রচিত্ত, তাঁর রাষ্ট্রভাবনা, ইতিহাস চেতনা, কারাস্মৃতি, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে প্রভেদ ও বৈষম্য, ভাষা-আন্দোলন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও সংগঠন বিস্তার, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে চার বিশিষ্টজন যথা- স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পিতা শেখ লুৎফর রহমান, তাঁর রাজনীতির প্রাণপুরুষ হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও বাংলার কৃষক-জনতার নন্দিত নেতা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এঁদের প্রভাব বা ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর সদ্য প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর আলোকে তাঁর নীতি-আদর্শ ও নেতৃত্বের স্বরূপ তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালী। বাংলার নদী, বাংলার জল, বাঙালীর খাবার, বাংলার ফল, বাংলার গান, বাংলার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা উর্বর জমি আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁকে সর্বদা মুগ্ধ করত। একবার এক অনুষ্ঠান শেষে ঢাকার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বাংলার বরণীয় লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিনসহ নৌকাযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আশুগঞ্জ আসছিলেন। পথে আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে ভাটিয়ালী গান শুনে তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পরবর্তীতে তিনি লিখেন, “নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গান গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তাঁর গান শুনছে। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম” (পৃ. ১১১)। শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে একবার মাও সে তুং-এর দেশ গণচীনে গিয়ে (১৯৫২) লেকে নৌকা বাওয়ার অনুভূতি তিনি এভাবে ব্যক্ত করেন, “হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারদিকে ... নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নেই ... আমি নৌকা বাইতে জানি, আমি পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম” (পৃ. ২৩৩)। অপরদিকে, একই বছর পাকিস্তানের রাজধানী করাচি ভ্রমণকালে সেখানকার ভূ-প্রকৃতি দেখে তাঁর মনে যে ভিন্ন অনুভূতি হয়েছিল, সে সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন, “আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম... আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যে দিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাঠান বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন?” (পৃ. ২১৪)।
অনুরূপভাবে, বাঙালী খাবারের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আসক্তির কথা তাঁর বিভিন্ন ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা বর্ণনা থেকে জানা যায়। ১৯৪৯ সালে একবার সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান যান এবং এক মাসের মতো সেখানে ছিলেন। একটি মামলা পরিচালনার জন্য সোহরাওয়ার্দী তখন পাঞ্জাবের লাহোরে অবস্থান করছিলেন। ‘ঢাকায় ফিরে এলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করবে, আর লাহোরে থাকলে নাও করতে পারে’ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে এমন কথা বললে, উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “.... যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক, পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যাবে, পাঞ্জাবে রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। রুটি আর মাংস খেতে খেতে আমার আর সহ্য হচ্ছে না” (পৃ. ১৪২)। তিনি তাঁর আত্মজীবনীর অন্যত্র লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের খাবার না খেলে আমার তৃপ্তি কোনদিনই হয় নাই’ (পৃ. ২২৮)।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস সচেতনতা ছিল খুবই তীক্ষè ও সুগভীর। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতিতে এর প্রকাশ ঘটত। ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ ও অগণিত মানুষের মৃত্যু সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন, “যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালী; যে বাঙালীর কোন কিছুরই অভাব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলায় এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত” (পৃ. ১৮)। আত্মজীবনীর অন্যত্র লিখেছেন, “সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দেশে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না” (পৃ. ৪৮)।
রাজনৈতিক চেতনা বা বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই ছিলেন অসম্প্রদায়িক। হিন্দু প্রধান গোপালগঞ্জ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শহরে তাঁর বাল্যকাল কাটে। সেখানকার মিশন স্কুলে ৭ম শ্রেণী থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত (১৯৩৭-১৯৪২) তিনি লেখাপড়া করেন। সহপাঠী, খেলাধুলার সাথীদের মধ্যে অনেকে ছিল হিন্দু । বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘...আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না’ (পৃ. ১১)। তবে কৈশরের অন্তত দু’টি ঘটনা তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে, যার উল্লেখ তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে করেছেন। একটি ১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এঁদের গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য তাঁর নেতৃত্ব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছিল। কংগ্রেস থেকে নির্দেশ আসায় হিন্দু ছাত্ররা এক এক করে সেটি থেকে সরে পড়ে। এমনকি বিরূপ সংবর্ধনারও তারা চেষ্টা করে। অপরটি হলো, তাঁর এক বন্ধু ননীর কাকার বাসার ঘটনা। একদিন ননী বঙ্গবন্ধুকে তার কাকার বাসার ভেতরে থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। বঙ্গবন্ধু চলে আসার পর ননীর কাকীমা মুসলমান সন্তানকে অন্দরমহলে নিয়ে আসার জন্য ওকে বকাবকি করে এবং পানি দিয়ে ঘর ধৌত করতে বাধ্য করে। এ ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, পরবর্তীতে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি এভাবে তা তুলে ধরেন, ‘এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালী মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে’ (পৃ. ২৩)।
অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ও নেতৃত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজী সুভাষ বসুর ভক্ত হয়েছিলেন (আত্মজীবনী, পৃ. ২৪, ৩৫-৩৬)। মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে ব্রিটিশবিরোধী ত্যাগী ও কারা নির্যাতন ভোগকারী হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ টেনে লিখেন, “জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজ তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না” (পৃ. ২৩-২৪)।
একথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে দেখেছেন বাংলা ও ভারতের শোষিত-বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায় হিসেবে। অসাম্প্রদায়িক আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন বলে ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গার সময় (এৎবধঃ ঈধষপঁঃঃধ করষষরহম) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন রক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন (আত্মজীবনী, পৃ. ৬৪-৬৮)। ভারত বিভাগের পর অন্যান্য অনেকের মতো সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে না এসে, মহাত্মা গান্ধী ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কলকাতার আশপাশে তাঁদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখার প্রচেষ্টায় গৃহীত শান্তি মিশনে যোগ দেন (পৃ. ৮১)। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এ দু’টো সংগঠনের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি যুক্ত করাটা ছিল বিদ্যমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কৌশল মাত্র। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু লিখেন, “...এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না” (পৃ. ৮৯)। উল্লেখ্য, তাঁরই উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগ ও ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দু’টো প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক নামকরণ করা হয়।
অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু যে সর্বদা অবিচল ছিলেন, ১৯৫০ সালের শেষের দিকে ফরিদপুর কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় গোপালগঞ্জের সহবন্দী, সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে’ দেখার চন্দ্র বাবুর উপদেশের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ” (পৃ. ১৯১)।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিশ্বাসের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, জনগণের শোষণ মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ সে বিশ্বাসকে ধারণ করে স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি ‘সমাজতন্ত্র’কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। পূর্ব কোন নীতিগত অবস্থান ছাড়া হঠাৎ করে এ নীতি অবলম্বন করা হয়েছে বলে কেউ কেউ সেদিন সামালোচনা করেন। তবে এ সমালোচনা যে ভিত্তিহীন ছিল, বঙ্গবন্ধুর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী-তে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, পশ্চিমের অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নয়। নয়া চীন ভ্রমণ উপলক্ষে তিনি তাঁর এ আদর্শিক অবস্থান এভাবে ব্যক্ত করেন, “... আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদ সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না” (পৃ. ২৩৪)। আর এই বিশ্বাসের কারণে বঙ্গবন্ধু দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, ‘বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’
ত্যাগের ব্রত নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজনীতিকে দেখেছেন দেশ ও জনগণের কল্যাণ হিসেবে। এ সম্বন্ধে তিনি আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাইএ বিশ্বাস আমার ছিল’ (পৃ. ১২৮)।
একবার পাকিস্তানে এক মাস কাটানোর পর গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে বহু কষ্টে বঙ্গবন্ধু বাড়িতে এসে পৌঁছেন। সপ্তাহ দুই সেখানে থেকে ঢাকা আসার পর পর তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। এমনটি যে ঘটবে তিনি তা পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। বাড়ি ছেড়ে ঢাকা আসার মুহূর্ত ও সে সময়কার তাঁর অনুভূতি বঙ্গবন্ধু এভাবে প্রকাশ করেন, “...ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়ামায়া করে লাভ কি ? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে” (পৃ. ১৬৪)। (চলবে)

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সাবেক প্রো-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.