কল্পকথার গল্প-এক জোড়া গল্প ও দুই জোড়া প্রশ্ন by আলী হাবিব

সম্প্রতি কাগজে একটি সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছে। ঘটনাটি যশোরের। যশোর সদর থানার সদ্য প্রত্যাহার করে নেওয়া ওসি এক সাংবাদিকের গলা টিপে ধরেছেন। সংবাদ পড়ে যেটা জানা গেল, খবর হিসেবে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওই ওসি সাহেব গলা টিপে ধরতে অভ্যস্ত। এর আগেও এই কর্মটি তিনি করেছেন।


এ বছরের গত ১২ মে হরতালের সময় যশোরে তিনি এক যুবনেতার গলা টিপে ধরেছিলেন। কী দুর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে লিখতে পারতেন, 'থানাতে এসেছে এক গলা টেপা ওসি!' সচিত্র এ প্রতিবেদনটি দেখে মনের মধ্যে দুটো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দুটো করার আগে দুটো গল্প শোনানো যাক। প্রথম গল্পটির শিরোনাম শার্দুলের শিক্ষা।
গল্পই যখন, তখন ধরেই নেওয়া যাক, এ গল্পটা যে সময়ের, তখন বনের বাঘদেরও একটা নাম থাকত। তা ছাড়া নাম না থাকার কোনো কারণও তো নেই। বাঘদেরও তো একটা সমাজ আছে। না, শুধু বাঘের কথাই বা বলি কেন? প্রাণিকুলে সমাজ তো একটা থাকতেই পারে। তো, যা-ই হোক, সেই সময়, অর্থাৎ যখন প্রমথনাশ বিশী নামের এক ভদ্রলোক বাংলা সাহিত্যে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন- তখন সুন্দরবনে এক ব্যাঘ্র শাবকের জন্ম হলো। তার নাম রাখা হলো রক্তমুখ। বাঘ সম্পর্কে আমরা কমবেশি জ্ঞাত। যদিও বাঘের মাসি বিড়াল আমাদের অনেকের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে দুধে-মাছে কিংবা লাথি-ঝাঁটায় আছে। কিন্তু বাঘের ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা। চোরা শিকারিরা বাঘের বাচ্চা নিয়ে পালাচ্ছে। আমরা অনেক সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকছি। কিন্তু বয়সকালে এই বাঘ যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা জানি। সে যাক গে! আমরা গল্পে ফিরে আসি। রক্তমুখ ছোটবেলা থেকেই ছিল একটু নিরীহ প্রকৃতির। সে শিকার করতে পারত না। ছোটবেলায় তার মা তাকে শিকার ধরে এনে দিত। সে ঘরে বসে বসে খেত। কিছুদিন পর মা মারা গেলে রক্তমুখ পড়ল বিপদে। এখন তাকে খাওয়াবে কে? রক্তমুখ ভাবল, নিরামিষ খাবে। কিন্তু সুন্দরবনে খাওয়ার মতো নিরামিষ সে কোথায় পাবে? এমন অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে হাজির শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালার সামনে। শিয়াল পণ্ডিত তাকে পাঠশালায় ভর্তি করে নিল। আবাসিক ছাত্র। পড়াশোনায় রক্তমুখের খুব একটা মন ছিল না। তিনবেলা আহার জুটছিল, এতেই সে খুশি ছিল। যেহেতু তার মা ছিল না, তাই সে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। শিয়াল পণ্ডিত একদিন তাকে পাঠশালা থেকে বের করে দিতেই অথৈ পাথারে পড়ল রক্তমুখ। কারণ সে শিকার করতে জানে না। বাঘের কৃষ্টি সে শেখেনি। অনাহারে তার শরীর শুকিয়ে গেল। প্রায় শক্তিহীন হয়ে পড়ল সে। এ অবস্থায় একদিন গলিতনখ নামের এক বৃদ্ধ বাঘের সঙ্গে তার দেখা হলো। রক্তমুখ তাকে তার মনের দুঃখ খুলে বলল। গলিতনখ তাকে পরামর্শ দিল কলকাতায় যেতে। সেখানে গেলে নাকি হত্যা ও প্রাণী শিকারের ট্রেনিং পাওয়া যায়। তো আমাদের গল্পের বাঘ রক্তমুখ চলে এলো কলকাতায়। এসে মহা ফাঁপরে পড়ে গেল বাঘটি। এরপর নানা ঘটনা। একসময় কলকাতা ছেড়ে সে সুন্দরবনে ফিরে গেল। ফিরে যাওয়ার পর থেকে সে সেখানে সবচেয়ে প্রবল শার্দুল। সুন্দরবনের ওই অঞ্চলের পশু-জগৎ তার ভয়ে প্রকম্পিত। কলকাতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পশুদের জগতে প্রবেশ করায় তার নাম হয়েছে 'মানবিক অত্যাচার'।
এবার আবার ওই খবর প্রসঙ্গে আসা যাক। যশোর সদর থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি সাহেব এই গলা টিপে ধরার কৌশল কোত্থেকে শিখলেন? এই গলা টিপে ধরাকে কোন জাতীয় অত্যাচার বলে?
দ্বিতীয় প্রশ্নের আগে দ্বিতীয় গল্প। গল্পটির নাম 'শৃগালের মনুষ্যত্ব বর্জন'। শিরোনাম পড়ে অনেকের মনে হতে পারে, শিয়াল আবার কেমন করে কোথা থেকে মনুষ্যত্ব অর্জন করল? আর অর্জন যদি করল, সেটা আবার বর্জন করা কেন? গল্পের ভেতরে প্রবেশ করা যাক। সে আমলে শিয়ালদেরও একটা সমাজ ছিল। সেই শিয়াল সমাজের অধিপতির নাম দধিকর্ণ। তার এ রকম নাম হওয়ার পেছনে অনেক কথা আছে। নিন্দুকদের মতে, লোকালয়ে দই চুরি করে খেতে গিয়ে ভাণ্ড গলায় বাঁধিয়ে ফিরে আসায় তার এমন নাম হয়েছে। নামে কী-ই বা আসে যায়? দধিকর্ণ শিয়াল সমাজের নেতা (নেতাদের একটু কানকাটা না হলে মানায় না)। যা হোক, এই দধিকর্ণ কিন্তু খুবই সাহসী ছিল। রাতে জনপদে ঢুকে মানুষের ক্ষেতের বেগুন, আখ, ফুটি, তরমুজ- যা পেত চুরি করত। কৃষকের বাড়ি থেকে তৈজসপত্র চুরি করে আনত। একদিন এক কৃষকের ক্ষেতে চুরি করতে গেলে কৃষক বল্লম ছুড়ে মারলে সেটা এসে দধিকর্ণের পিঠে বিদ্ধ হয়। দধিকর্ণ অনেক কষ্টে সেটা নিয়েই বনে ফিরে আসে। বনে ফিরে শিয়ালদের ডেকে সে বলে, 'দেখো, তোমাদের জন্য আমি কী সংগ্রহ করে এনেছি।' শিয়ালরা জানতে চায়, জিনিসটা কী? দধিকর্ণ তো আর বল্লমের নাম জানে না। সে বলল, এটার নাম মনুষ্যত্ব। শিয়ালদের মধ্যে দধিকর্ণের আদেশ জারি হয়ে গেল, সবাইকে মনুষ্যত্ব সংগ্রহ করতে হবে। শিয়ালরা সবাই অস্ত্র চুরি করা শুরু করল।
ওদিকে শিয়ালদের মধ্যে হানাহানি শুরু হয়ে গেল। প্রতিদিন একটা না একটা শিয়ালের মৃতদেহ পাওয়া যেতে লাগল। দধিকর্ণ গোয়েন্দা লাগিয়ে দিল। গোয়েন্দারা খবর দিল, শিয়ালরা মনুষ্যত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে। পরদিনই জারি হয়ে গেল রাজার আদেশ- যার কাছে যা মনুষ্যত্ব অর্থাৎ তলোয়ার, বল্লম, বন্দুক আছে, তা জমা দিতে হবে। রাজার আদেশ না মেনে তো উপায় নেই! মানতেই হবে। সবাই অস্ত্র জমা দিল। কিন্তু পরদিন সকালেই খবর এলো, দুই শিয়ালের মরদেহ পড়ে রয়েছে। দধিকর্ণ বলল, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সবাই তো মনুষ্যত্ব বর্জন করেছে। কে একজন গণনা করে জানাল, ওরা নিজেদের নখরের আঘাতে মারা গেছে। দধিকর্ণ অবাক হয়ে ভাবল, এটা তো হওয়ার কথা নয়, কেন এমন হলো? গল্পটি এখানেই শেষ নয়। এবার প্রশ্নটি করা যাক। কী অর্জন করলে ওভাবে মানুষের গলা টিপে ধরা যায়? যেমনটি ধরেছিলেন যশোরের সদ্য প্রত্যাহার হয়ে যাওয়া ওসি সাহেব। আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, এই অভ্যাস কি বদলানো যায়?
গল্পের ইতি টানা যাক। দধিকর্ণ তো খুবই চিন্তিত। এ অবস্থায় তার এক সভাপণ্ডিত জানাল, মনুষ্যত্বের প্রধান আশ্রয় হচ্ছে মন। সেখান থেকে দূর করতে না পারলে হত্যাকাণ্ড দূর করা যাবে না। যেমন পুলিশের 'মাইন্ডসেট' পরিবর্তন করতে না পারলে ওসি সাহেবরা গলা টিপে ধরা থেকে বিরত থাকতে পারবেন না।
লেখক : সাংবাদিক, habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.