কালান্তরের কড়চা-ভারতের হবু রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে আরো কিছু কথা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে (১৯ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি প্রণব মুখার্জির জয়লাভ প্রায় নিশ্চিত জেনে ঢাকার একটি দৈনিকে (কালের কণ্ঠে নয়) আমি নিজের কলামে একটু আলোচনা করেছি। তাতে প্রণববাবু সম্পর্কে কিছু অপ্রিয় সত্যও তুলে ধরেছি। ভারত আমাদের নিকট ও বৃহৎ প্রতিবেশী।
তা ছাড়া আমাদের মিত্রদেশ হওয়ারও দাবিদার। ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালোমন্দও অনেক বেশি জড়িত। সুতরাং এত বড় নিকট প্রতিবেশীর রাষ্ট্রপতি কে হবেন বা কে হতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করা স্বাভাবিক। বিশেষ করে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের 'বিশেষ বন্ধু' হিসেবে খ্যাত। তাঁর সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবেও পরিচিত। সুতরাং তিনি 'প্রথম বাঙালি' হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে বসতে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে আগেভাগেই আমার নিজের মতামত ব্যক্ত করাটা সঠিক কাজ মনে করেছি।
প্রণববাবু সম্পর্কে অনেকের ধারণার সঙ্গেই আমার ধারণাটা মিলবে না। তিনি ভারতের মতো একটি সাব-সুপার পাওয়ারের রাষ্ট্রপতি হলে বিশ্বে বাঙালি পরিচয়ের মেকি মর্যাদা কিছু বাড়তে পারে, কিন্তু সর্ববাঙালির স্বার্থ, সুবিধা, ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা কিছুমাত্র বাড়বে, তা আমি মনে করি না। তাঁর সম্পর্কে আমার এই ধারণাটি তাঁর অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক চরিত্র পর্যবেক্ষণ দ্বারা গড়ে উঠেছে। আমার মনে হয়েছে, তাঁর কাছে বাঙালি পরিচয় এহবাহ্য। তিনি নিজের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য গুজরাটিও হয়ে যেতে পারেন (একবার হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন)। ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়া পরিচয় ও আদর্শের আর কোনো মূল্য তাঁর কাছে নেই। তিনি নিজের স্বার্থ-সুবিধার জন্য অতিদ্রুত পুরনো মিত্রকে ত্যাগ ও নতুন মিত্র গ্রহণ করতে পারেন।
এর সদ্য প্রমাণ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। ইন্দিরা গান্ধী যেমন ক্ষমতায় থাকাকালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে, তেমনি পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের তত্ত্বাবধায়ক নেতা বানিয়েছিলেন। প্রণববাবু অনেকটা আমাদের ড. কামাল হোসেনের মতো। রাজনীতিক হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিতি আছে, কিন্তু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। জনগণ দুজনকেই নির্বাচনে ভোট দেয় না। প্রণববাবুও একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গে তৎকালে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পরম বান্ধব হয়ে দাঁড়ান এবং তাদের সাহায্যে পার্লামেন্টের সদস্য হন। দিল্লির সোনিয়া-মনমোহন সরকার বামদের বিরুদ্ধে চলে গেলে ও মমতার তৃণমূলের সঙ্গে মৈত্রী পাতালে প্রণববাবুর রাজনীতিতেও ইউটার্ন আসে। তিনি রাতারাতি বৈরী মমতার মিত্র হয়ে দাঁড়ান। এই সুযোগে গত রাজ্য নির্বাচনে মমতার সাহায্য ও সহযোগিতায় নিজের ছেলেকে রাজ্যের বিধানসভায় সদস্য করে আনেন।
দিল্লির হুকুমে ও নিজের স্বার্থ-সুবিধার জন্য প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য নির্বাচনের সময় মমতার মিত্র এবং বামদের বৈরী হয়ে দাঁড়ালেও মমতার জনপ্রিয়তাকে তিনি ঈর্ষা করেন এবং তাঁর বিশাল নির্বাচন-বিজয়কে ভয় করেন। ফলে মমতা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতেই তিনি মমতার সরকার যাতে তাদের নির্বাচন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো সফল করতে না পারে, সে জন্য রাজ্যকে কেন্দ্রের অর্থ সাহায্যদানে অর্থমন্ত্রী হিসেবে গড়িমসি শুরু করেন। এখানে প্রণব-মমতার বিরোধ আবার শুরু এবং প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি করার ব্যাপারে মমতার এত আপত্তি ও বাধাদান। এই বাধাদানে মমতা ভুল কৌশল গ্রহণ ও জেদ দেখানোর ফলে প্রণববাবু এবার জিতে যাচ্ছেন।
ঢাকার একটি দৈনিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জির নিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমি এই অপ্রিয় সত্যটিই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম যে তিনি দিল্লির তখতে তাউসে নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টির ইচ্ছা ও স্বার্থে তাদের ক্রীড়নক হিসেবে বসবেন; প্রকৃত নিরপেক্ষ নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়। গণতন্ত্রের আদর্শে তাঁর নিষ্ঠাও কম। সুতরাং তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ায় ভারতের গণতান্ত্রিক মানুষের আশাবাদী হওয়ার যেমন কিছু নেই, তেমনি প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষেরও উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এই সেদিন ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে ছুটে এসে ঢাকার সঙ্গে সম্পাদিত তাঁদের কোটি কোটি ডলারের ঋণ-সাহায্যের প্যাকেজ ডিলটির বর্তমান অবস্থা কি সন্দেহবাদীদের সন্দেহের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে না?
ঢাকায় একটি দৈনিকে আমার এই সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধটি পাঠ করে ঢাকার এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। নাম প্রকাশ করে তাঁকে আর বিব্রত করতে চাই না। তিনিও আমার মতো প্রণববাবুকে প্রণবদা বলে ডাকেন। আমার লেখাটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ঢাকা থেকে আমাকে হঠাৎ টেলিফোন করেছেন ও বলেছেন, 'প্রণবদা সম্পর্কে এমন দায়িত্বহীন লেখা আপনার উচিত হয়নি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধর হত্যার পর জার্মানিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সুনিশ্চিত নিরাপত্তাদান এবং দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ ভূমিকার কথা আপনি জানেন। বাংলাদেশ ও বাঙালির এমন বন্ধু সম্পর্কে আপনার লেখাটি আমাদের মনে দুঃখ দিয়েছে।'
প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে ঢাকার কাগজে সাম্প্রতিক নিবন্ধটি লেখার পর তাঁর সম্পর্কে অধিক কিছু লেখার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার এই টেলিফোনটি পেয়ে দায়িত্বহীনভাবে নয়, সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের তাগিদেই আবার এই লেখাটি আমাকে লিখতে হলো। এ জন্য প্রণবদা ও আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার কাছে ক্ষমা চাই।
১৯৭১ সালে প্রণব মুখার্জি ৩৫ বছর বয়সের যুবক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ কিংবা কেন্দ্রীয় কংগ্রেস রাজনীতিতেও তেমন কেউকেটা ছিলেন না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোনো বড় ভূমিকা ছিল না এবং বড় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগও ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর যেসব মন্ত্রী, সচিব ও পরামর্শদাতা অব্যাহত সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণ মেনন, জগজীবন রাম, ডিপি ধর, হাকসার প্রমুখ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নামও উল্লেখযোগ্য। প্রণববাবুর সেখানে বড় ভূমিকা নেওয়ার অবকাশ কোথায়? আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার মতো ১৯৭১ সালে আমিও ভারতে ছিলাম এবং কলকাতা ও দিল্লিতে ছোটাছুটি করেছি। তখন প্রণববাবুর গুরুত্ব কোথায়?
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হাসিনা-রেহানা দুই বোনকে জার্মানি থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রণববাবুর একটা বড় ভূমিকা ছিল। তাও তাঁর নিজের ভূমিকা নয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে ডেকে নিয়ে দায়িত্বটি দিয়েছিলেন। প্রণববাবু বাঙালি বলেই তাঁকে এই দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল, অন্য কোনো কারণে নয়। জার্মানি থেকে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও জামাতাকে লন্ডন হয়ে নিরাপদে দিল্লি নিয়ে আসার তত্ত্বাবধানই ছিল প্রণববাবুর একমাত্র কাজ। তারপর দায়িত্ব মুক্তি। হাসিনা ও রেহানার দিল্লি অবস্থানের সময় তাঁরা প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। আর ছিলেন তাঁর নির্দেশে নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারা। পরবর্তীকালে প্রণববাবু তাঁর এটুকু ভূমিকার জন্যই বাংলাদেশে আমাদের অনেকের কাছে দাদা হয়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুযোগ পেলেই দাদাগিরি ফলাতে শুরু করেন। কিছুদিন আগে তিনি দিল্লির হুকুমে ও স্বার্থে বাংলাদেশের বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়ারও মন জয় করার চেষ্টা করে গেছেন। রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির একমাত্র দক্ষতা এই যে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের নামে তিনি ডানে-বামে যে কোনোদিকে হেলতে-দুলতে পারেন। নীতি-নৈতিকতা এখানে অবান্তর।
ভারতের এই ভাবী 'মহামান্য রাষ্ট্রপতির' জীবনেতিহাসের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে সেখানে নীতি-নৈতিকতার স্থান কতটুকু। বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বতন্ত্র বাংলা কংগ্রেস বিলুপ্ত করার সময় তাঁর তরুণ অনুসারী প্রণব মুখার্জিকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রগাঢ় চাটুকারিতার জোরে তিনি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দেহরক্ষীর গুলির আঘাতে ইন্দিরার নির্মম মৃত্যুর পর তাঁর ভক্তির মুখোশ খুলে গিয়েছিল। তিনি রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতেই নিজের প্রধানমন্ত্রী পদে বসার খায়েশ ব্যক্ত করেন। রাজীব বিরক্ত হয়ে তাঁকে দূরে সরিয়ে দেন এবং প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনে দুর্দিন শুরু হয়।
তাঁর অচলা দিল্লিভক্তিতে এবার চিড় ধরল। তিনি তখন 'সমাজবাদী কংগ্রেস' নামে একটি পাল্টা কংগ্রেস খাড়া করার চেষ্টা করেন। তাঁর ডাকা জনসভায় কোনো শ্রোতা-দর্শক না আসায় তিনি আবার রাজীব গান্ধীর কাছে ধরনা দেন এবং কংগ্রেসে ফিরে আসেন। রাজীব তাঁকে আর দিল্লিতে ঢুকতে দেননি। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস দেখভাল করার দায়িত্ব দেন। এই দায়িত্ব পালনেও প্রণববাবু ক্যারিশমা ও জনপ্রিয়তার অভাবে কোনো কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। বরং তাঁর আমলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস একটি একঘরে ও কোণঠাসা এবং কোন্দল জর্জরিত পার্টিতে পরিণত হয়।
দিল্লির সেবাদাস হওয়া ও নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টির প্রতি 'অচলাভক্তি' সত্ত্বেও তিনি যে দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী ও একবার রাষ্ট্রপতি (২০০৭) হতে চেয়েও হতে পারেননি, তার কারণ হয়তো বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে সুবিধাবাদিতা যুক্ত থাকা। ফলে রাজীবের পর তিনি দীর্ঘকাল সোনিয়া গান্ধীরও আস্থা অর্জন করতে পারেননি। রাজীব হত্যার পর যখন তাঁর স্ত্রী সোনিয়ার কাছে ডাক এলো কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের, তখন প্রণববাবু তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছেন নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে- রাওকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর জন্য। সোনিয়া তখন পরিবারের নিরাপত্তাজনিত কারণেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসেননি; কিন্তু চিরভক্তের আসল চেহারাটা দেখে নিয়েছিলেন।
এরপর সীতারাম কেশরি যখন কংগ্রেসের নেতা হয়ে বসলেন, তখন প্রণববাবু তাঁর খাস মুনশি হয়ে দাঁড়ান। কিছুদিনের মধ্যে কংগ্রেস প্রধানের পদ থেকে সীতারাম কেশরি হলেন বিতাড়িত। সোনিয়া গান্ধী একচ্ছত্র নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে এলেন। আমাদের প্রণব দাদাও ভোল পাল্টে সোনিয়া ভক্ত হয়ে গেলেন। তাঁর অবস্থা তখন 'দেহিপদপল্লব মুদরম'। সোনিয়া গান্ধী তাঁকে গ্রহণ করেছেন, বিভিন্ন মন্ত্রীপদে বসতেও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আকাঙ্ক্ষিত প্রধানমন্ত্রী পদটির ধারে কাছেও তাঁকে ঘেঁষতে দেননি। বরং রাজনীতিতে যাঁর ক্রেডিবিলিটি প্রায় শূন্য ও সাবেক ব্যুরোক্র্যাট মনমোহন সিংকে এনে তাঁর মাথার ওপর প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে দিয়েছেন।
২০০৭ সালেও প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাতে সোনিয়া রাজি হননি। এবার যে তিনি প্রণববাবুর প্রতি হঠাৎ সদয় হলেন, তার কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, পুত্র রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে প্রণববাবু যাতে বাগড়া হয়ে না দাঁড়াতে পারেন, সে জন্যই তাঁকে নখদন্তবিহীন রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ প্রণববাবুর মতো একজন সক্রিয় ও সক্ষম রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটানো হলো। তিনি রাইসিনা হিলসে বসে খাবেন-দাবেন, ফুর্তি করবেন, সেনাবাহিনীর স্যালুট নেবেন, কিন্তু তাঁর ভূমিকা হবে ঠুঁটো জগন্নাথের।
ভারতের রাজনীতির অনেকের কাছে প্রণব মুখার্জি এখন 'বঙ্গ বিভীষণ' নামে আখ্যাত। কারণ তাঁর সম্পর্কে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় সম্প্রতি একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির ইংরেজি শিরোনামের বাংলা তরজমা হলো 'নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য চাপা দিতে চেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।' সর্ববাঙালি, এমন কি সর্বভারতীয়দের মনেও বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর একটি সুউচ্চ শ্রদ্ধার আসন আছে। প্রণববাবুর বিরুদ্ধে সেই নেতাজীবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ ওঠায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি যদি এ কাজটা করে থাকেন, তাহলে কাদের স্বার্থে করেছেন?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও কংগ্রেস রাজনীতিতে জওহরলাল নেহরু প্রকাশ্যে সুভাষ বসুর বন্ধু হলেও মনে মনে ছিলেন তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর এবং তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। সুভাষ বসু বিদেশে চলে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার পর নেহরু এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাননি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিকে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ বসুর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু খবরটির যথার্থতা প্রমাণিত হয়নি। স্বাধীন ভারতের নেহরু সরকার ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই খবরটি সঠিক বলে মেনে নেন। অনেকের মতে, সুভাষ বসুর মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনে নেহরু সরকার কোনো ধরনের চেষ্টা করেনি; বরং প্রতিটি চেষ্টায় বাধা দিয়েছে। এখন অভিযোগ উঠেছে, একজন বাঙালি হয়েও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে প্রণববাবুও এ কাজটি করেছেন এবং করেছেন নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টিকে খুশি করে নিজের রাজনৈতিক ফায়দা উদ্ধারের জন্য।
এই অভিযোগটি করা হয়েছে 'ইন্ডিয়াস বিগেস্ট কভার আপ' নামের একটি বইয়ে। বইটি এই মাসেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটি লিখেছেন সাংবাদিক অনুজ ধর। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া বইটি সম্পর্কে আগাম তথ্য প্রকাশ করেছে। এই বইয়ে সুভাষ বসুর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে প্রচারিত ভারতের সরকারি ভাষ্য সঠিক নয় দাবি করা হয়েছে। ভারত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৫ সালে তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়।
ব্রিটেন, আমেরিকা ও ভারতের কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সূত্রের গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতেই বইটি লিখেছেন অনুজ ধর। এই নথিপত্রগুলো নেতাজীর অন্তর্ধানের পর টানা ৬৫ বছর গোপন রাখা হয়েছিল। বইয়ে অনুজ ধর অভিযোগ করেছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব ও তথ্য বাতিল হওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ থাকলেও পরবর্তীকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি এই প্রমাণগুলো চাপা দেওয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যান। এই ব্যাপারে তাঁর অতি আগ্রহ দেখাতেও তিনি দ্বিধা করেননি।
অনুজ ধর ১৯৯৬ সালের এক ঘটনার সূত্র ধরে তাঁর বইতে লিখেছেন, 'ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের এক যুগ্ম সচিব গোপনীয় এক চিরকুটে সুভাষ বসুর ঘটনাটি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ অনুসন্ধান চালানোর জন্য ভারত সরকারকে প্রস্তাব দেন। তিনি ভারতের সরকারি কর্তৃপক্ষকে রুশ ফেডারেশনের সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সোভিয়েত আমলের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির আর্কাইভে অনুসন্ধান চালানোর পরামর্শ দেন।'
অনুজ ধর দৃঢ়ভাবে দাবি জানিয়েছেন, প্রণব মুখার্জি ওই চিরকুটটি দেখার পর পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দারকে ওই যুগ্মসচিবের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। সালমান হায়দার কথা বলার পর ওই যুগ্মসচিব রাশিয়ার সঙ্গে সুভাষ বসু সম্পর্কে যৌথ অনুসন্ধানের প্রস্তাবটি তুলে নেন। তাইওয়ানে নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে- ভারতে এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রচারক প্রণব মুখার্জি। এই দাবি অনুজ ধরের। কেন প্রণববাবুর এই রহস্যজনক ভূমিকা, তা এখনো নির্ণয় করতে পারেননি 'ইন্ডিয়াস্ বিগেস্ট কভার আপ' বইয়ের লেখক।
ভারতের হবু রাষ্ট্রপতি ও আমাদের অনেকের প্রণব দাদা সম্পর্কে অধিক কিছু লিখতে চাই না। লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকার (২৩ জুনের প্রতিবেদন) মতে 'মনমোহন সিং ও প্রণব মুখার্জি দুজনেই ডায়নেস্টির বশংবদ সেবক। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা মনমোহন সিংয়ের বেশি।' আমারও ধারণা, নিজের সুবিধাবাদী চরিত্রের জন্যই ডায়নেস্টির আস্থা অর্জনে প্রণববাবুর দেরি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত মুকুট ও ক্ষমতাবিহীন সিংহাসনে Kicked high হয়েছেন।
তবু ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে বসতে যাওয়া প্রণব মুখার্জিকে আগাম অভিনন্দন জানাই। শত হোক তাঁর বাঙালি পরিচয়টা আছে তো!
লন্ডন, ১৬ জুলাই, সোমবার, ২০১২
প্রণববাবু সম্পর্কে অনেকের ধারণার সঙ্গেই আমার ধারণাটা মিলবে না। তিনি ভারতের মতো একটি সাব-সুপার পাওয়ারের রাষ্ট্রপতি হলে বিশ্বে বাঙালি পরিচয়ের মেকি মর্যাদা কিছু বাড়তে পারে, কিন্তু সর্ববাঙালির স্বার্থ, সুবিধা, ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা কিছুমাত্র বাড়বে, তা আমি মনে করি না। তাঁর সম্পর্কে আমার এই ধারণাটি তাঁর অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক চরিত্র পর্যবেক্ষণ দ্বারা গড়ে উঠেছে। আমার মনে হয়েছে, তাঁর কাছে বাঙালি পরিচয় এহবাহ্য। তিনি নিজের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য গুজরাটিও হয়ে যেতে পারেন (একবার হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন)। ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়া পরিচয় ও আদর্শের আর কোনো মূল্য তাঁর কাছে নেই। তিনি নিজের স্বার্থ-সুবিধার জন্য অতিদ্রুত পুরনো মিত্রকে ত্যাগ ও নতুন মিত্র গ্রহণ করতে পারেন।
এর সদ্য প্রমাণ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। ইন্দিরা গান্ধী যেমন ক্ষমতায় থাকাকালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে, তেমনি পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে রাজীব গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের তত্ত্বাবধায়ক নেতা বানিয়েছিলেন। প্রণববাবু অনেকটা আমাদের ড. কামাল হোসেনের মতো। রাজনীতিক হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিতি আছে, কিন্তু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই। জনগণ দুজনকেই নির্বাচনে ভোট দেয় না। প্রণববাবুও একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গে তৎকালে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পরম বান্ধব হয়ে দাঁড়ান এবং তাদের সাহায্যে পার্লামেন্টের সদস্য হন। দিল্লির সোনিয়া-মনমোহন সরকার বামদের বিরুদ্ধে চলে গেলে ও মমতার তৃণমূলের সঙ্গে মৈত্রী পাতালে প্রণববাবুর রাজনীতিতেও ইউটার্ন আসে। তিনি রাতারাতি বৈরী মমতার মিত্র হয়ে দাঁড়ান। এই সুযোগে গত রাজ্য নির্বাচনে মমতার সাহায্য ও সহযোগিতায় নিজের ছেলেকে রাজ্যের বিধানসভায় সদস্য করে আনেন।
দিল্লির হুকুমে ও নিজের স্বার্থ-সুবিধার জন্য প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গের গত রাজ্য নির্বাচনের সময় মমতার মিত্র এবং বামদের বৈরী হয়ে দাঁড়ালেও মমতার জনপ্রিয়তাকে তিনি ঈর্ষা করেন এবং তাঁর বিশাল নির্বাচন-বিজয়কে ভয় করেন। ফলে মমতা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতেই তিনি মমতার সরকার যাতে তাদের নির্বাচন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো সফল করতে না পারে, সে জন্য রাজ্যকে কেন্দ্রের অর্থ সাহায্যদানে অর্থমন্ত্রী হিসেবে গড়িমসি শুরু করেন। এখানে প্রণব-মমতার বিরোধ আবার শুরু এবং প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি করার ব্যাপারে মমতার এত আপত্তি ও বাধাদান। এই বাধাদানে মমতা ভুল কৌশল গ্রহণ ও জেদ দেখানোর ফলে প্রণববাবু এবার জিতে যাচ্ছেন।
ঢাকার একটি দৈনিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জির নিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমি এই অপ্রিয় সত্যটিই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম যে তিনি দিল্লির তখতে তাউসে নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টির ইচ্ছা ও স্বার্থে তাদের ক্রীড়নক হিসেবে বসবেন; প্রকৃত নিরপেক্ষ নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নয়। গণতন্ত্রের আদর্শে তাঁর নিষ্ঠাও কম। সুতরাং তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ায় ভারতের গণতান্ত্রিক মানুষের আশাবাদী হওয়ার যেমন কিছু নেই, তেমনি প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষেরও উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এই সেদিন ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে ছুটে এসে ঢাকার সঙ্গে সম্পাদিত তাঁদের কোটি কোটি ডলারের ঋণ-সাহায্যের প্যাকেজ ডিলটির বর্তমান অবস্থা কি সন্দেহবাদীদের সন্দেহের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে না?
ঢাকায় একটি দৈনিকে আমার এই সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধটি পাঠ করে ঢাকার এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। নাম প্রকাশ করে তাঁকে আর বিব্রত করতে চাই না। তিনিও আমার মতো প্রণববাবুকে প্রণবদা বলে ডাকেন। আমার লেখাটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ঢাকা থেকে আমাকে হঠাৎ টেলিফোন করেছেন ও বলেছেন, 'প্রণবদা সম্পর্কে এমন দায়িত্বহীন লেখা আপনার উচিত হয়নি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধর হত্যার পর জার্মানিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সুনিশ্চিত নিরাপত্তাদান এবং দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ ভূমিকার কথা আপনি জানেন। বাংলাদেশ ও বাঙালির এমন বন্ধু সম্পর্কে আপনার লেখাটি আমাদের মনে দুঃখ দিয়েছে।'
প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে ঢাকার কাগজে সাম্প্রতিক নিবন্ধটি লেখার পর তাঁর সম্পর্কে অধিক কিছু লেখার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার এই টেলিফোনটি পেয়ে দায়িত্বহীনভাবে নয়, সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের তাগিদেই আবার এই লেখাটি আমাকে লিখতে হলো। এ জন্য প্রণবদা ও আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার কাছে ক্ষমা চাই।
১৯৭১ সালে প্রণব মুখার্জি ৩৫ বছর বয়সের যুবক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ কিংবা কেন্দ্রীয় কংগ্রেস রাজনীতিতেও তেমন কেউকেটা ছিলেন না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কোনো বড় ভূমিকা ছিল না এবং বড় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগও ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর যেসব মন্ত্রী, সচিব ও পরামর্শদাতা অব্যাহত সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণ মেনন, জগজীবন রাম, ডিপি ধর, হাকসার প্রমুখ, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নামও উল্লেখযোগ্য। প্রণববাবুর সেখানে বড় ভূমিকা নেওয়ার অবকাশ কোথায়? আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতার মতো ১৯৭১ সালে আমিও ভারতে ছিলাম এবং কলকাতা ও দিল্লিতে ছোটাছুটি করেছি। তখন প্রণববাবুর গুরুত্ব কোথায়?
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হাসিনা-রেহানা দুই বোনকে জার্মানি থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রণববাবুর একটা বড় ভূমিকা ছিল। তাও তাঁর নিজের ভূমিকা নয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে ডেকে নিয়ে দায়িত্বটি দিয়েছিলেন। প্রণববাবু বাঙালি বলেই তাঁকে এই দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল, অন্য কোনো কারণে নয়। জার্মানি থেকে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও জামাতাকে লন্ডন হয়ে নিরাপদে দিল্লি নিয়ে আসার তত্ত্বাবধানই ছিল প্রণববাবুর একমাত্র কাজ। তারপর দায়িত্ব মুক্তি। হাসিনা ও রেহানার দিল্লি অবস্থানের সময় তাঁরা প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। আর ছিলেন তাঁর নির্দেশে নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তারা। পরবর্তীকালে প্রণববাবু তাঁর এটুকু ভূমিকার জন্যই বাংলাদেশে আমাদের অনেকের কাছে দাদা হয়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুযোগ পেলেই দাদাগিরি ফলাতে শুরু করেন। কিছুদিন আগে তিনি দিল্লির হুকুমে ও স্বার্থে বাংলাদেশের বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়ারও মন জয় করার চেষ্টা করে গেছেন। রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির একমাত্র দক্ষতা এই যে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের নামে তিনি ডানে-বামে যে কোনোদিকে হেলতে-দুলতে পারেন। নীতি-নৈতিকতা এখানে অবান্তর।
ভারতের এই ভাবী 'মহামান্য রাষ্ট্রপতির' জীবনেতিহাসের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে সেখানে নীতি-নৈতিকতার স্থান কতটুকু। বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বতন্ত্র বাংলা কংগ্রেস বিলুপ্ত করার সময় তাঁর তরুণ অনুসারী প্রণব মুখার্জিকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রগাঢ় চাটুকারিতার জোরে তিনি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দেহরক্ষীর গুলির আঘাতে ইন্দিরার নির্মম মৃত্যুর পর তাঁর ভক্তির মুখোশ খুলে গিয়েছিল। তিনি রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতেই নিজের প্রধানমন্ত্রী পদে বসার খায়েশ ব্যক্ত করেন। রাজীব বিরক্ত হয়ে তাঁকে দূরে সরিয়ে দেন এবং প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনে দুর্দিন শুরু হয়।
তাঁর অচলা দিল্লিভক্তিতে এবার চিড় ধরল। তিনি তখন 'সমাজবাদী কংগ্রেস' নামে একটি পাল্টা কংগ্রেস খাড়া করার চেষ্টা করেন। তাঁর ডাকা জনসভায় কোনো শ্রোতা-দর্শক না আসায় তিনি আবার রাজীব গান্ধীর কাছে ধরনা দেন এবং কংগ্রেসে ফিরে আসেন। রাজীব তাঁকে আর দিল্লিতে ঢুকতে দেননি। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস দেখভাল করার দায়িত্ব দেন। এই দায়িত্ব পালনেও প্রণববাবু ক্যারিশমা ও জনপ্রিয়তার অভাবে কোনো কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। বরং তাঁর আমলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস একটি একঘরে ও কোণঠাসা এবং কোন্দল জর্জরিত পার্টিতে পরিণত হয়।
দিল্লির সেবাদাস হওয়া ও নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টির প্রতি 'অচলাভক্তি' সত্ত্বেও তিনি যে দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী ও একবার রাষ্ট্রপতি (২০০৭) হতে চেয়েও হতে পারেননি, তার কারণ হয়তো বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে সুবিধাবাদিতা যুক্ত থাকা। ফলে রাজীবের পর তিনি দীর্ঘকাল সোনিয়া গান্ধীরও আস্থা অর্জন করতে পারেননি। রাজীব হত্যার পর যখন তাঁর স্ত্রী সোনিয়ার কাছে ডাক এলো কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের, তখন প্রণববাবু তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছেন নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে- রাওকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর জন্য। সোনিয়া তখন পরিবারের নিরাপত্তাজনিত কারণেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসেননি; কিন্তু চিরভক্তের আসল চেহারাটা দেখে নিয়েছিলেন।
এরপর সীতারাম কেশরি যখন কংগ্রেসের নেতা হয়ে বসলেন, তখন প্রণববাবু তাঁর খাস মুনশি হয়ে দাঁড়ান। কিছুদিনের মধ্যে কংগ্রেস প্রধানের পদ থেকে সীতারাম কেশরি হলেন বিতাড়িত। সোনিয়া গান্ধী একচ্ছত্র নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে এলেন। আমাদের প্রণব দাদাও ভোল পাল্টে সোনিয়া ভক্ত হয়ে গেলেন। তাঁর অবস্থা তখন 'দেহিপদপল্লব মুদরম'। সোনিয়া গান্ধী তাঁকে গ্রহণ করেছেন, বিভিন্ন মন্ত্রীপদে বসতেও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আকাঙ্ক্ষিত প্রধানমন্ত্রী পদটির ধারে কাছেও তাঁকে ঘেঁষতে দেননি। বরং রাজনীতিতে যাঁর ক্রেডিবিলিটি প্রায় শূন্য ও সাবেক ব্যুরোক্র্যাট মনমোহন সিংকে এনে তাঁর মাথার ওপর প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে দিয়েছেন।
২০০৭ সালেও প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাতে সোনিয়া রাজি হননি। এবার যে তিনি প্রণববাবুর প্রতি হঠাৎ সদয় হলেন, তার কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, পুত্র রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে প্রণববাবু যাতে বাগড়া হয়ে না দাঁড়াতে পারেন, সে জন্যই তাঁকে নখদন্তবিহীন রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ প্রণববাবুর মতো একজন সক্রিয় ও সক্ষম রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটানো হলো। তিনি রাইসিনা হিলসে বসে খাবেন-দাবেন, ফুর্তি করবেন, সেনাবাহিনীর স্যালুট নেবেন, কিন্তু তাঁর ভূমিকা হবে ঠুঁটো জগন্নাথের।
ভারতের রাজনীতির অনেকের কাছে প্রণব মুখার্জি এখন 'বঙ্গ বিভীষণ' নামে আখ্যাত। কারণ তাঁর সম্পর্কে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় সম্প্রতি একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির ইংরেজি শিরোনামের বাংলা তরজমা হলো 'নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য চাপা দিতে চেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।' সর্ববাঙালি, এমন কি সর্বভারতীয়দের মনেও বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর একটি সুউচ্চ শ্রদ্ধার আসন আছে। প্রণববাবুর বিরুদ্ধে সেই নেতাজীবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ ওঠায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি যদি এ কাজটা করে থাকেন, তাহলে কাদের স্বার্থে করেছেন?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও কংগ্রেস রাজনীতিতে জওহরলাল নেহরু প্রকাশ্যে সুভাষ বসুর বন্ধু হলেও মনে মনে ছিলেন তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর এবং তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। সুভাষ বসু বিদেশে চলে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার পর নেহরু এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাননি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিকে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ বসুর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু খবরটির যথার্থতা প্রমাণিত হয়নি। স্বাধীন ভারতের নেহরু সরকার ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই খবরটি সঠিক বলে মেনে নেন। অনেকের মতে, সুভাষ বসুর মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনে নেহরু সরকার কোনো ধরনের চেষ্টা করেনি; বরং প্রতিটি চেষ্টায় বাধা দিয়েছে। এখন অভিযোগ উঠেছে, একজন বাঙালি হয়েও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে প্রণববাবুও এ কাজটি করেছেন এবং করেছেন নেহরু-গান্ধী ডায়নেস্টিকে খুশি করে নিজের রাজনৈতিক ফায়দা উদ্ধারের জন্য।
এই অভিযোগটি করা হয়েছে 'ইন্ডিয়াস বিগেস্ট কভার আপ' নামের একটি বইয়ে। বইটি এই মাসেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটি লিখেছেন সাংবাদিক অনুজ ধর। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া বইটি সম্পর্কে আগাম তথ্য প্রকাশ করেছে। এই বইয়ে সুভাষ বসুর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে প্রচারিত ভারতের সরকারি ভাষ্য সঠিক নয় দাবি করা হয়েছে। ভারত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৫ সালে তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়।
ব্রিটেন, আমেরিকা ও ভারতের কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সূত্রের গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতেই বইটি লিখেছেন অনুজ ধর। এই নথিপত্রগুলো নেতাজীর অন্তর্ধানের পর টানা ৬৫ বছর গোপন রাখা হয়েছিল। বইয়ে অনুজ ধর অভিযোগ করেছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব ও তথ্য বাতিল হওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ থাকলেও পরবর্তীকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি এই প্রমাণগুলো চাপা দেওয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যান। এই ব্যাপারে তাঁর অতি আগ্রহ দেখাতেও তিনি দ্বিধা করেননি।
অনুজ ধর ১৯৯৬ সালের এক ঘটনার সূত্র ধরে তাঁর বইতে লিখেছেন, 'ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের এক যুগ্ম সচিব গোপনীয় এক চিরকুটে সুভাষ বসুর ঘটনাটি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ অনুসন্ধান চালানোর জন্য ভারত সরকারকে প্রস্তাব দেন। তিনি ভারতের সরকারি কর্তৃপক্ষকে রুশ ফেডারেশনের সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সোভিয়েত আমলের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির আর্কাইভে অনুসন্ধান চালানোর পরামর্শ দেন।'
অনুজ ধর দৃঢ়ভাবে দাবি জানিয়েছেন, প্রণব মুখার্জি ওই চিরকুটটি দেখার পর পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দারকে ওই যুগ্মসচিবের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। সালমান হায়দার কথা বলার পর ওই যুগ্মসচিব রাশিয়ার সঙ্গে সুভাষ বসু সম্পর্কে যৌথ অনুসন্ধানের প্রস্তাবটি তুলে নেন। তাইওয়ানে নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে- ভারতে এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রচারক প্রণব মুখার্জি। এই দাবি অনুজ ধরের। কেন প্রণববাবুর এই রহস্যজনক ভূমিকা, তা এখনো নির্ণয় করতে পারেননি 'ইন্ডিয়াস্ বিগেস্ট কভার আপ' বইয়ের লেখক।
ভারতের হবু রাষ্ট্রপতি ও আমাদের অনেকের প্রণব দাদা সম্পর্কে অধিক কিছু লিখতে চাই না। লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকার (২৩ জুনের প্রতিবেদন) মতে 'মনমোহন সিং ও প্রণব মুখার্জি দুজনেই ডায়নেস্টির বশংবদ সেবক। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা মনমোহন সিংয়ের বেশি।' আমারও ধারণা, নিজের সুবিধাবাদী চরিত্রের জন্যই ডায়নেস্টির আস্থা অর্জনে প্রণববাবুর দেরি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত মুকুট ও ক্ষমতাবিহীন সিংহাসনে Kicked high হয়েছেন।
তবু ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে বসতে যাওয়া প্রণব মুখার্জিকে আগাম অভিনন্দন জানাই। শত হোক তাঁর বাঙালি পরিচয়টা আছে তো!
লন্ডন, ১৬ জুলাই, সোমবার, ২০১২
No comments