মানুষের মুখ-পাখিদের এক স্বর্গরাজ্য by মৃত্যুঞ্জয় রায়

মেঘ, রোদ আর বাদল। এসব মাথায় নিয়েই ঢাকা থেকে আগের দিন বিকেল পাঁচটায় লঞ্চে রওনা দিয়ে পরদিন সকাল সাতটায় দেশের দক্ষিণে ভোলার এক দ্বীপ মনপুরায় হাজির হলাম। কেউ কেউ মনপুরাকে বলেন স্বপ্নের দ্বীপ। কী সেই স্বপ্ন? বিপুল জলরাশির মধ্যে জেগে থাকা একখণ্ড পলিজমা দ্বীপে কী এমন স্বপ্ন লুকিয়ে আছে? আসার পথে মেঘনা ও


শাহবাজপুর চ্যানেলের বিস্তীর্ণ আদিগন্ত জলরাশি আর মেঘমাখা আকাশ ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। মনপুরা লঞ্চঘাটের নাম রামনেওয়াজ। সেখানে পৌঁছাতেই বর্ষার ঢল ঢল নদীতে চরের ভাঙন দেখে আহত হলাম। চরের নবীন ঘাসগুলো জলে ডুবুডবু। সকালে একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম মনপুরার স্বপ্ন-সন্ধানে। শুনেছি, সাকুচিয়ার কেওড়া বনে গেলে অনেক হরিণের দেখা মেলে, সেই সঙ্গে অনেক পাখিও। এই হদিস করতে চরগোয়ালিয়ার কৃষক ছাকু মিয়ার দ্বারস্থ হলাম, কীভাবে সেখানে যাওয়া যায়, তারও খোঁজ নিলাম। পাখির কথা শুনে ছাকু মিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, ‘দুইন্যার পাখি মনে লয় মনপুরায় বাসা বানছে। আমগো ধান খাইয়া শ্যাষ করছে।’
আসলেই দ্বীপ মনপুরায় খুব পাখির উপদ্রব। ধান পাকতেই পাখি এসে খেতে পড়ে। পাকা ধানের শিষ থেকে ধানের দানা খুঁটে খেয়ে ফেলে। শেষে দানাশূন্য শিষ নিয়ে ধানগাছ দাঁড়িয়ে থাকে। সে জন্য মনপুরার অনেক ধানচাষি পাখিদের হাত থেকে ধান রক্ষার জন্য ধান পাকার সময় হলে খেতের সব ধানগাছ জাল দিয়ে ঢেকে রাখেন। তার পরও ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে কিছু পাখি খেতে ঢুকে পড়ে, কিছু চাষিদের হাতে মারাও পড়ে। চরগোয়ালিয়া গ্রামের কৃষক ছাকু মিয়া এবার বোরো ধানের চাষ করে এ রকম বিপদেই পড়েছেন। মনপুরায় বোরোর আবাদ নেই বললেই চলে। তাই যে দু-চারজন কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছেন, তাঁদের খেতে রাজ্যের পাখিরা এসে হানা দিচ্ছে। চড়ুই, বুলবুলি, ময়না, শালিক প্রভৃতি পাখি এসে ধান খেয়ে যাচ্ছে। কথা বলতেই কৃষক ছাকু মিয়া তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘ভাই, পাখি মারার কোনো বিষ আছে? ধানে পোকার চেয়ে এখন পাখিরাই বেশি ক্ষতি করছে।’ ছাকু মিয়ার কথা শুনে চমকে উঠলাম, বলেন কী? পাখিরা আমাদের পরিবেশের এক বড় সম্পদ। ওদের মারাও নিষেধ; বরং এসব পাখির সংখ্যা আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সবার সে চেষ্টাই করা উচিত। আমার কথা শুনে ছাকু মিয়া মহাবিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন, আমিও পাখি আর হরিণের সন্ধানে মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে ছুটলাম সাকুচিয়া আর বাংলাবাজারের কেওড়া বনের দিকে।
মনপুরার মতো এত পাখি এ দেশের আর কোনো দ্বীপে নেই। অন্যান্য জীববৈচিত্র্যেও মনপুরা অনেক সমৃদ্ধ। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ‘জার্নাল অব সায়েন্স ফাউন্ডেশন’-এ প্রকাশিত এম এল হোসেন ও অন্যদের এক গবেষণাপত্র থেকে মনপুরার বন্য প্রাণী সম্পর্কে একটা পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা এরই মধ্যে দ্বীপটিতে ১৪৭ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে ৪৩ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী, অন্য ১০৪টি প্রজাতি ওই দ্বীপেরই বাসিন্দা। সচরাচর যেসব পাখির দেখা পাওয়া যায় সেগুলো হলো: পাতিকাক, ফিঙে, ভাত শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, বাবুই, সুঁইচোরা, আবাবিল, জালালি কবুতর, জলকবুতর, গঙ্গা কউতর, লাল লতিকা হট-টি-টি, খুদে গাঙচিল, গাঙচিল, মাছরাঙা, কানি বক, গো-বক, ছোট বক, মৌটুসি, ফুলঝুরি প্রভৃতি। অন্যান্য পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পাহাড়ি তিতির, বড় সরালি, সরালি, পাতিহাঁস, বালিহাঁস, রাজহাঁস, কাঠঠোকরা, বসন্ত বৌরী, হুদুদ, মেঘ-হাও, চাতক, পাপিয়া, বউ কথা কও, চোখ গেল, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খুড়ুলে পাঁচা, হুতুম প্যাঁচা, জংলি প্যাঁচা, ভুতুম প্যাঁচা, তিলা ঘুঘু, রাজ ঘুঘু, কুড়া, রঙিলা চ্যাগা, লাল-পা ঢ্যাঙ্গা, হট-টি-টি, তুর্কিবাজ, তিলাবাজ, পানকৌড়ি, ধূসর বক, বেগুনি বক, মাইঝলা বক, নীলপক্ষিয়া, হাঁড়িচাঁচা, তৌফিক, হলদে পাখি, ছোট ফিঙে, সাতশৈলী, লেজ নাচুনে, সাদা সিপাহি, দোয়েল, ফুটফুটি, ঝুঁট শালিক, গাঙ শালিক, ভাত শালিক, কথা শালিক, বামন শালিক, সিপাহি বুলবুলি, শ্বেত আঁখি, টুনি/টুনটুনি, সাত ভাই, বালু চাটা, ভরত পাখি, নীলটুনি, কালো মাথা মুনিয়া, তিলা মুনিয়া, মুনিয়া, খঞ্জন ইত্যাদি। পরিযায়ী পাখির মধ্যে গিরিয়া হাঁস, রাঙামুড়ি, চোখাচোখি, কাদখোচা, গাঙচিল, চিল ইত্যাদি অন্যতম।
সারা দিন ঘুরে দেখে-শুনে মনপুরার পাখিবৈচিত্র্যের একটা ফিরিস্তি তৈরি করে ফেললাম। তবে শোনা ও গবেষণাপত্রে পড়া অনেক পাখিরই সেখানে দেখা পেলাম না। তা ছাড়া সব পাখি চিনিও না। তাই একটা ভাবনা এসে ভর করল। ভাবনাটা এ জন্য যে ধীরে ধীরে জলবায়ু বদলে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে মনপুরার অনেক ভূমি। সে সঙ্গে বিপন্ন হয়ে পড়েছে মনপুরার অনেক জীববৈচিত্র্য। এরই মধ্যে দ্বীপটি থেকে অনেক প্রজাতির জীব হারিয়ে গেছে এবং দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের আশঙ্কা, কদিন পর হয়তো মনপুরার শোভা, অনিন্দ্যসুন্দর গাঙচিলকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। কেননা, গবেষকেরা এরই মধ্যে মনপুরার গাঙচিলকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে মনপুরা দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় আমার তা মনে হলো না। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশে রোদের ঝিলিক এসে পড়ল অসংখ্য সাদা ডানার গাঙচিলের গায়ে। তখনই মনে হলো, মনপুরা আসলে পাখিদের এক স্বর্গরাজ্য। পাখিশিকারি নয়, বার্ড ওয়াচাররা এখানে শীতে এলে এ সত্য হয়তো আরও ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন।

No comments

Powered by Blogger.