প্রশ্নের মুখে পিডিবির বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব by অরুণ কর্মকার

বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) যে যুক্তি তুলে ধরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পিডিবি বলেছে, লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে রাখায় সারা বছর তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দিনের ৮০ ভাগ সময় (৮০% প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) চালু রাখতে হবে। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য পড়বে ছয় টাকা ৮৭ পয়সা।


এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পিডিবির দেওয়া ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিকসহ দেশে তরল জ্বালানিচালিত যে কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলো ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো কারিগরি বিবেচনাতেই সম্ভব নয়। কারণ, এই কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশ দীর্ঘক্ষণ চালানোর উপযোগী নয়। আবার ঋতুভেদে, বিশেষ করে শীতকালে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো দিনের ৮০ ভাগ সময় চালানোর প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চললে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তার হিসাব পিডিবির প্রস্তাবে নেই। ফলে এই যুক্তিতে ভোক্তাদের ওপর দামের বোঝা চাপানো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
উন্মুক্ত সভা না করেই পিডিবির ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ওই প্রস্তাব বিবেচনার জন্য গ্রহণ করেছে বিইআরসি। গতকাল সোমবার প্রস্তাবটির ওপর গণ শুনানিও করেছে তারা।
পিডিবির ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বিতরণ কোম্পানিগুলো (ডিপিডিসি, ডেসকো, আরইবি, ওজোপাডিকো এবং পিডিবির বিতরণ অঞ্চল) গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী চলতি জুলাই মাস থেকেই দাম বাড়া কার্যকর হওয়ার কথা।
পিডিবির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) আবুল কাশেম দাবি করেছেন, তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো অসম্ভব নয়।
পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও তেলচালিত কেন্দ্র ৭০ শতাংশের বেশি প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর নজির নেই বললেই চলে। আর সারা বছর ধরে ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো তো সম্ভবই নয়। তিনি বলেন, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে গত দুই বছরে তেলচালিত কোনো কেন্দ্র কত প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে, আর কতটুকু বিদ্যুৎ দিয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখলেই আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।
শামসুল ইসলাম বলেন, শীতকালে চাহিদা কম থাকায় তো অনেক কেন্দ্র কখনো কখনো বন্ধও রাখতে হয়। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কম রাখার জন্য পিডিবি কিছু করছে কি না, সেই তথ্য তাদের প্রস্তাবে নেই। বিইআরসিও তা জানতে চায় না। এটা দেশবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
পিডিবির আরেকজন সাবেক চেয়ারম্যান এস এ মঈদ প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, বছরজুড়ে সব তেলচালিত কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সরবরাহ করাই সম্ভব হবে না। কারণ, এত তেল আমদানি করতে গেলেও অর্থনীতির ওপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হবে।
পিডিবির মালিকানাধীন তেলচালিত কেন্দ্রগুলোর অবস্থা একেবারে জরাজীর্ণ। খুলনায় পিডিবির তেলচালিত কেন্দ্র তো বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধই থাকে। বরিশাল, রংপুর, সৈয়দপুরের ১০/২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রগুলোও অতি পুরোনো। এগুলোতে তেল ব্যবহারের পরিমাণ স্বাভাবিক কেন্দ্রগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তাই এগুলো বিশেষ প্রয়োজনে দু-চার ঘণ্টা ছাড়া চালানোই হয় না।
বর্তমান সরকারের আমলে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক যে কেন্দ্রগুলো করা হয়েছে, সেগুলোতেও তেলের ব্যবহার চুক্তিতে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি। তার ওপর তিন-চারটি কেন্দ্র নির্ধারিত ক্ষমতার ৪০ শতাংশ হারে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এখন পর্যন্ত সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। এসব কেন্দ্র বছরজুড়ে ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর প্রস্তাব শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি তৈরি করা ছাড়া কিছু নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেছেন, ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ধরে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এ ধরনের প্রস্তাব করা হচ্ছে একতরফাভাবে। এই কেন্দ্রগুলো যাঁরা করেছেন, তাঁরাই সব হিসাবনিকাশ করছেন। এগুলো তো খতিয়ে দেখা বা চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে না। কিন্তু বাড়তি দাম ঠিকই সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপছে। তিনি বলেন, ‘বিইআরসির দায়িত্ব কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখা। তা তারা করছে বলে তো জানি না।’
ইজাজ হোসেনের প্রশ্ন, তেলচালিত বেশির ভাগ কেন্দ্র সাময়িক। তাহলে বিদ্যুতের যে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেটা কি সাময়িক?
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কোনো কারিগরি নিরীক্ষা হয় না। তাই কোন কেন্দ্র কত ফ্যাক্টরে চলবে, চলছে বা চলেছে, তার কোনো হিসাব আমরা জানি না। পিডিবি যা বলে তা-ই সই। আগে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও পিডিবি এক রকম হিসাব দিয়েছে। বাস্তবে সেটা করেছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।’
গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে পিডিবি বলেছিল, সেচ ও গ্রীষ্মকালীন চাহিদার কারণে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো ৩০ শতাংশ এবং ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রগুলো ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালাতে হবে। গত মার্চ-এপ্রিল মাসে সারা দেশে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং করার সময় সেটা চালানো হয়েছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের।
আবার তখন বলা হলো, সেচ ও গ্রীষ্মকালীন চাহিদার কারণে ৩০ ও ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর কথা। এবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, বছরজুড়ে সব কটি কেন্দ্র ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর কথা। দুয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এসব বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি বিবেচনায় পিডিবির ওই প্রস্তাব যেমন অবাস্তব, তেমনি ওই হিসাবকে ভিত্তি ধরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও অযৌক্তিক।

No comments

Powered by Blogger.