সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
আত্মসম্মানের সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার এই প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্যের পথে চেতনা বিকাশের আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বতঃস্ফূর্ততাকে হালকা আবেগ ভাবা ঠিক হবে না। আবেগ ছাড়া বড় কোনো কাজ করা যায় না। ভালোবাসাও আবেগ।
মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা পবিত্র আবেগ। আবেগের প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। এ শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্প চুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী স্বউদ্যোগে সেতু নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই ঘোষণায় দু'রকমের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য নিজেদের খরচ থেকে ছয় হাজার টাকা বাঁচিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের কাছে জমা দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একদিনের বেতন প্রদানের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। বীমা কোম্পানির মালিক সমিতি এগারো হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বিন্দু বিন্দু সঞ্চয় তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। 'যার যা আছে, তাই নিয়ে' পদ্মা সেতু গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত হচ্ছে নিত্যদিন। একাত্তরে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে জনগণ যেমন একাট্টা হয়েছিল, আজ ৪১ বছর পর পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনির্ভর হওয়ার এক প্রচণ্ড প্রত্যয় যেন জনগণকে উদ্বেলিত করে তুলেছে।
নিন্দুকেরা তো হেসেই কুটিকুটি। তাদের প্রতিক্রিয়া হলো, স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের চিন্তা হলো কল্পনাবিলাস। উপহাস করে বলছে, ছাত্রদের ছয় হাজার টাকা দিয়ে খেলনা কেনা যায়, সেতু বানানো যায় না। একদিনের বেতনদান একটা স্টান্টবাজি, উন্নত প্রযুক্তির এ সেতু নির্মাণের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া অর্থায়নের সাধ্য এ গরিব দেশের নেই। এক নেতা (যিনি জিয়া, এরশাদ, খালেদা সব আমলেই মন্ত্রী ছিলেন) তো বলেই বসলেন, 'যান, বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। পুনরায় সাহায্য প্রার্থনা করুন। আমরা সহযোগিতা করবা।' ধিক! তার হীনমন্যতাকে। তার ধৃষ্টতাকে ঘৃণা জানাই। বাঙালি অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায় না। ক্ষমা চায় না। অন্যায়কে রুখে দাঁড়ায়। ক্ষমা প্রার্থনা ওই মেরুদণ্ডহীন নেতাদের স্বভাব। কবির ভাষায় তাকে বলতে ইচ্ছা হয়, 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।' অবশ্য আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোনো নেতা অমন উচ্চারণ করতে পারতেন না।
মনে পড়ছে একাত্তরের ২৫ মার্চের পরের কথা। রাজাকার, মুসলিম লীগার, জামায়াতি আর কিছু মেরুদণ্ডহীন 'সুশীল' বলতে লাগলেন, 'শেখ মুজিবের জন্য আমাদের এই দুর্দশা। বাঁশের লাঠি দিয়ে কি যুদ্ধ করা যায়? যত্ত সব বেকুব। এখন পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত।' তাদের এই অনুশোচনা শাহ আজিজ বহির্বিশ্বে বহন করলেন। কিন্তু বাঙালি ঠিকই জানবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা হারজিতের হিসাব করল না। মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার্থে জীবনদানের শপথ নিল। আজ যারা বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নসিহত করছেন, তারা রাজাকারের উত্তরসূরি। নব্য রাজাকার। বাঙালির মতো মাতৃমুক্তিপণ ওদের নেই। ওই পরগাছাদের স্বাধীন দেশের মিডিয়া কেন এত কভারেজ দেয়, ভেবে পাওয়া ভার। নিরপেক্ষতা? না, এটা হীনমন্যতা।
এখন হিসাব-নিকাশে আসা যাক। অঙ্ক কষে দেখি, পদ্মা সেতু নির্মাণের টাকা আমাদের আছে কিনা। শুধু আবেগ দিয়ে তো হবে না। টাকাও লাগবে। মোটা দাগের হিসাবে পদ্মা সেতুর মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা আছে সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকা। বিলম্বজনিত কারণে প্রাইস এসকেলেশন হবে। চবি্বশ হাজার কোটি টাকা ধরা যাক। চার বছরে কাজ শেষ করতে হলে বছরে গড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রথম বছর চার হাজার কোটি টাকা লাগবে। পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর সাত থেকে দশ হাজার কোটি টাকার জোগান দিতে হবে। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে পিপিপি খাতে যে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, সেটি পদ্মা সেতু খাতে ট্রান্সফার করলেই চলবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কিছু ব্যয় হবে, যা রিজার্ভ থেকে মেটানো যাবে। পরবর্তী তিন বছরের হিসাবটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এ তিন বছরে প্রতিবছর গড়ে এডিপি বরাদ্দ কমবেশি ষাট হাজার কোটি টাকা থাকবে। এর ১০% অর্থাৎ ছয় হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু খাতে বরাদ্দ রাখা সম্ভব হবে। বাজেটের পরিপূরক হিসেবে কিছু সারচার্জ (যমুনা সেতু আদলে) আদায় করা হলে অর্থ ঘাটতির আশঙ্কা নেই। পরনির্ভরতা পরিহার করে স্বউদ্যোগে সেতু নির্মাণে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাচ্ছে, তাতে অর্থ ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমস্যাটা অন্যত্র। ব্যয়ের একটি বড় অংশ লাগবে বৈদেশিক মুদ্রায়, যা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা দরকার। দেশের স্বাভাবিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বর্তমানে দশ বিলিয়ন ডলার) থেকে বছরে দেড়-দুই বিলিয়ন ডলার দেওয়া সম্ভব। বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালির সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৭০ লাখ হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা এক কোটি। গড়ে জনপ্রতি বছরে মাত্র একশ' ডলার দিলে পরিমাণ দাঁড়ায় একশ' কোটি ডলার। এ হলো একেবারেই নিজস্ব অর্থায়ন। স্বউদ্যোগে অর্থায়ন বলতে বোঝাতে চাইছি যে উদ্যোগটা নিজেদের হলেও বন্ধুরা পাশে দাঁড়াবে। যেমনটা ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধে। স্বউদ্যোগে যুদ্ধ শুরু করার পর পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত, রাশিয়াসহ অনেক বন্ধুরাষ্রদ্ব, এমনকি বৈরী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও। পদ্মা সেতু স্বউদ্যোগে শুরু করলে প্রাচ্য পাশে দঁাঁড়াবে। পাশ্চাত্যের বিশ্বব্যাংক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার ফলে প্রাচ্য হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠ হবে। আইডিবি, এডিবি, জাইকাসহ চীন ও কোনো কোনো রাষ্ট্র বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে। তেমনটা হলে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সংকট থাকবে না।
কেউ কেউ প্রযুক্তির প্রশ্ন তুলেছেন। কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কোম্পানি যেমন বিশ্বের সেরাদের মধ্য থেকে নিয়োজিত হবে, তেমনি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও বিশ্বখ্যাত কোম্পানিই নিযুক্তি পাবে। তারাই প্রযুক্তি আনবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সেতুর ক্ষেত্রে। তবে কর্মপরিচালনা ও তদারকির জন্য সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হবে। 'যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষে'র আদলে 'পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ' গঠন করা যেতে পারে, যারা নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকবে। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা ও প্রফেশনাল বাছাই করে এ সংস্থায় নিয়োগ দিতে হবে। সার্বিক উপদেশনার জন্য একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
আত্মসম্মানের সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার এই প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্যের পথে চেতনা বিকাশের আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বতঃস্ফূর্ততাকে হালকা আবেগ ভাবা ঠিক হবে না। আবেগ ছাড়া বড় কোনো কাজ করা যায় না। ভালোবাসাও আবেগ। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা পবিত্র আবেগ। আবেগের প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। এ শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, বিশ্বব্যাংক সরে গেল কেন? বাংলাদেশ কি দুর্নীতি করেছে? সোজাসাপটা জবাব, 'না'। বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি সিএসসি বা কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কোম্পানি হিসেবে নিযুক্তির জন্য দরখাস্ত করেছিল। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের বাদ দিয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে বিশ্বব্যাংক ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য মূল্যায়ন কমিটির কাছে তদবির শুরু করে। যদিও বিশ্বব্যাংক তদবির করে অনৈতিক কাজ করেছিল, তথাপি মূল্যায়ন কমিটি পুনর্মূল্যায়নে অধিকতর তদন্ত করে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসে। কোম্পানিটি তাদের কাজ হিসেবে একটি ব্রিজের ফটোগ্রাফ দাখিল করেছে মূল্যায়ন কমিটির কাছে। কমিটি তদন্ত করে দেখেছে যে, ওই ব্রিজটি নির্মাণে ওই কোম্পানির সম্পৃক্ততা নেই। কোম্পানিটি প্রতারক। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, প্রতারক কোম্পানির পক্ষে বিশ্বব্যাংক কেন তদবির করল? তাহলে দুর্নীতি কি বিশ্বব্যাংকেই হয়েছে? তাদের দুর্নীতির মুখোশটিই কি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর চাপাচ্ছে? এ তো এক হীন মানসিকতা।
বিশ্বব্যাংকসহ কোনো সহযোগীই সেতু প্রকল্পে এক পয়সাও ছাড় করেনি। কাজ শুরু হয়নি। খরচও হয়নি। তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতিটা হলো কেমন করে? কানাডার লাভালিন কোম্পানি নাকি ঘুষ সেধেছিল। লাভালিন কোম্পানিকে তো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কাজ না পেলেও কি ঘুষ দেবে? ঘুষ সাধলেই কি ঘুষ নেওয়া হয়? অপরাধ সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধ হয় না। এটা আইনের কথা। তাছাড়া 'ঘুষ সাধা'র অভিযোগ হয়েছে কানাডায় লাভালিনের বিরুদ্ধে, যা প্রমাণিত হয়নি। ওই মামলার রায় পেতে চার-পাঁচ বছর কেটে যাবে। কারণ, শুনানির প্রথম তারিখ পড়েছে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। কানাডার আইনে ঘুষ সাধাও অপরাধ। কিন্তু প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এটা অভিযোগ মাত্র, অপরাধ নয়।
বিশ্বব্যাংকের এসব অনৈতিক কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে, দুর্নীতি বাহানা মাত্র। বড় রকমের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকে অনেক মহলের লবি রয়েছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির লবিও আছে। তাদের আন্তর্জাতিক মুরবি্বদের লবি আছে। একজন বাঙালি বিশ্ব নাগরিকের গোসাও নাকি যোগ হয়েছে। ওই বিশ্ব নাগরিক বিশ্বের রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। অথচ দেশের কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে কোনো সরকারের আমলেই তাকে দেখা যায়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৫ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি চেতনা_ এসব বিষয়ে কোনো সময়েই তার কোনো বক্তব্য ছিল না। আমন্ত্রণ জানালেও তিনি কোনো অনুষ্ঠানে আসেন না। বিরোধীদলীয় কোনো কোনো নেতা পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি করতে নেমেছেন। তাদের কাছে দেশের সম্মানের চেয়ে বিশ্বব্যাংকের সম্মান বেশি। জাতীয় ঐক্যের খাতিরে তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। আশার কথা, বিরোধী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আত্মপ্রতারণায় শামিল হয়নি। দেশদ্রোহী ও ধান্ধাবাজদের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার রোখার জন্য মুক্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সুশীল সমাজের উচিত সত্য প্রকাশ করা। এদেশীয় গোয়েবলসদের মুখে লাগাম থাকে না। নিরন্তর সত্য প্রকাশ ও মুক্ত তথ্যপ্রবাহ ওদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে দেবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ :ব্যাংকার ও কলাম লেখক
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্প চুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী স্বউদ্যোগে সেতু নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই ঘোষণায় দু'রকমের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য নিজেদের খরচ থেকে ছয় হাজার টাকা বাঁচিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের কাছে জমা দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একদিনের বেতন প্রদানের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। বীমা কোম্পানির মালিক সমিতি এগারো হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বিন্দু বিন্দু সঞ্চয় তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। 'যার যা আছে, তাই নিয়ে' পদ্মা সেতু গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত হচ্ছে নিত্যদিন। একাত্তরে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে জনগণ যেমন একাট্টা হয়েছিল, আজ ৪১ বছর পর পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনির্ভর হওয়ার এক প্রচণ্ড প্রত্যয় যেন জনগণকে উদ্বেলিত করে তুলেছে।
নিন্দুকেরা তো হেসেই কুটিকুটি। তাদের প্রতিক্রিয়া হলো, স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের চিন্তা হলো কল্পনাবিলাস। উপহাস করে বলছে, ছাত্রদের ছয় হাজার টাকা দিয়ে খেলনা কেনা যায়, সেতু বানানো যায় না। একদিনের বেতনদান একটা স্টান্টবাজি, উন্নত প্রযুক্তির এ সেতু নির্মাণের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়া অর্থায়নের সাধ্য এ গরিব দেশের নেই। এক নেতা (যিনি জিয়া, এরশাদ, খালেদা সব আমলেই মন্ত্রী ছিলেন) তো বলেই বসলেন, 'যান, বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। পুনরায় সাহায্য প্রার্থনা করুন। আমরা সহযোগিতা করবা।' ধিক! তার হীনমন্যতাকে। তার ধৃষ্টতাকে ঘৃণা জানাই। বাঙালি অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায় না। ক্ষমা চায় না। অন্যায়কে রুখে দাঁড়ায়। ক্ষমা প্রার্থনা ওই মেরুদণ্ডহীন নেতাদের স্বভাব। কবির ভাষায় তাকে বলতে ইচ্ছা হয়, 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।' অবশ্য আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোনো নেতা অমন উচ্চারণ করতে পারতেন না।
মনে পড়ছে একাত্তরের ২৫ মার্চের পরের কথা। রাজাকার, মুসলিম লীগার, জামায়াতি আর কিছু মেরুদণ্ডহীন 'সুশীল' বলতে লাগলেন, 'শেখ মুজিবের জন্য আমাদের এই দুর্দশা। বাঁশের লাঠি দিয়ে কি যুদ্ধ করা যায়? যত্ত সব বেকুব। এখন পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত।' তাদের এই অনুশোচনা শাহ আজিজ বহির্বিশ্বে বহন করলেন। কিন্তু বাঙালি ঠিকই জানবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা হারজিতের হিসাব করল না। মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার্থে জীবনদানের শপথ নিল। আজ যারা বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নসিহত করছেন, তারা রাজাকারের উত্তরসূরি। নব্য রাজাকার। বাঙালির মতো মাতৃমুক্তিপণ ওদের নেই। ওই পরগাছাদের স্বাধীন দেশের মিডিয়া কেন এত কভারেজ দেয়, ভেবে পাওয়া ভার। নিরপেক্ষতা? না, এটা হীনমন্যতা।
এখন হিসাব-নিকাশে আসা যাক। অঙ্ক কষে দেখি, পদ্মা সেতু নির্মাণের টাকা আমাদের আছে কিনা। শুধু আবেগ দিয়ে তো হবে না। টাকাও লাগবে। মোটা দাগের হিসাবে পদ্মা সেতুর মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা আছে সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকা। বিলম্বজনিত কারণে প্রাইস এসকেলেশন হবে। চবি্বশ হাজার কোটি টাকা ধরা যাক। চার বছরে কাজ শেষ করতে হলে বছরে গড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা লাগবে। প্রথম বছর চার হাজার কোটি টাকা লাগবে। পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর সাত থেকে দশ হাজার কোটি টাকার জোগান দিতে হবে। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে পিপিপি খাতে যে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, সেটি পদ্মা সেতু খাতে ট্রান্সফার করলেই চলবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কিছু ব্যয় হবে, যা রিজার্ভ থেকে মেটানো যাবে। পরবর্তী তিন বছরের হিসাবটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এ তিন বছরে প্রতিবছর গড়ে এডিপি বরাদ্দ কমবেশি ষাট হাজার কোটি টাকা থাকবে। এর ১০% অর্থাৎ ছয় হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু খাতে বরাদ্দ রাখা সম্ভব হবে। বাজেটের পরিপূরক হিসেবে কিছু সারচার্জ (যমুনা সেতু আদলে) আদায় করা হলে অর্থ ঘাটতির আশঙ্কা নেই। পরনির্ভরতা পরিহার করে স্বউদ্যোগে সেতু নির্মাণে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যাচ্ছে, তাতে অর্থ ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমস্যাটা অন্যত্র। ব্যয়ের একটি বড় অংশ লাগবে বৈদেশিক মুদ্রায়, যা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা দরকার। দেশের স্বাভাবিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বর্তমানে দশ বিলিয়ন ডলার) থেকে বছরে দেড়-দুই বিলিয়ন ডলার দেওয়া সম্ভব। বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালির সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৭০ লাখ হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা এক কোটি। গড়ে জনপ্রতি বছরে মাত্র একশ' ডলার দিলে পরিমাণ দাঁড়ায় একশ' কোটি ডলার। এ হলো একেবারেই নিজস্ব অর্থায়ন। স্বউদ্যোগে অর্থায়ন বলতে বোঝাতে চাইছি যে উদ্যোগটা নিজেদের হলেও বন্ধুরা পাশে দাঁড়াবে। যেমনটা ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধে। স্বউদ্যোগে যুদ্ধ শুরু করার পর পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত, রাশিয়াসহ অনেক বন্ধুরাষ্রদ্ব, এমনকি বৈরী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও। পদ্মা সেতু স্বউদ্যোগে শুরু করলে প্রাচ্য পাশে দঁাঁড়াবে। পাশ্চাত্যের বিশ্বব্যাংক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার ফলে প্রাচ্য হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠ হবে। আইডিবি, এডিবি, জাইকাসহ চীন ও কোনো কোনো রাষ্ট্র বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে। তেমনটা হলে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সংকট থাকবে না।
কেউ কেউ প্রযুক্তির প্রশ্ন তুলেছেন। কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কোম্পানি যেমন বিশ্বের সেরাদের মধ্য থেকে নিয়োজিত হবে, তেমনি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও বিশ্বখ্যাত কোম্পানিই নিযুক্তি পাবে। তারাই প্রযুক্তি আনবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সেতুর ক্ষেত্রে। তবে কর্মপরিচালনা ও তদারকির জন্য সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হবে। 'যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষে'র আদলে 'পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ' গঠন করা যেতে পারে, যারা নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকবে। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা ও প্রফেশনাল বাছাই করে এ সংস্থায় নিয়োগ দিতে হবে। সার্বিক উপদেশনার জন্য একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
আত্মসম্মানের সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার এই প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্যের পথে চেতনা বিকাশের আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বতঃস্ফূর্ততাকে হালকা আবেগ ভাবা ঠিক হবে না। আবেগ ছাড়া বড় কোনো কাজ করা যায় না। ভালোবাসাও আবেগ। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা পবিত্র আবেগ। আবেগের প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। এ শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, বিশ্বব্যাংক সরে গেল কেন? বাংলাদেশ কি দুর্নীতি করেছে? সোজাসাপটা জবাব, 'না'। বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি সিএসসি বা কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কোম্পানি হিসেবে নিযুক্তির জন্য দরখাস্ত করেছিল। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের বাদ দিয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে বিশ্বব্যাংক ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য মূল্যায়ন কমিটির কাছে তদবির শুরু করে। যদিও বিশ্বব্যাংক তদবির করে অনৈতিক কাজ করেছিল, তথাপি মূল্যায়ন কমিটি পুনর্মূল্যায়নে অধিকতর তদন্ত করে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসে। কোম্পানিটি তাদের কাজ হিসেবে একটি ব্রিজের ফটোগ্রাফ দাখিল করেছে মূল্যায়ন কমিটির কাছে। কমিটি তদন্ত করে দেখেছে যে, ওই ব্রিজটি নির্মাণে ওই কোম্পানির সম্পৃক্ততা নেই। কোম্পানিটি প্রতারক। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, প্রতারক কোম্পানির পক্ষে বিশ্বব্যাংক কেন তদবির করল? তাহলে দুর্নীতি কি বিশ্বব্যাংকেই হয়েছে? তাদের দুর্নীতির মুখোশটিই কি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর চাপাচ্ছে? এ তো এক হীন মানসিকতা।
বিশ্বব্যাংকসহ কোনো সহযোগীই সেতু প্রকল্পে এক পয়সাও ছাড় করেনি। কাজ শুরু হয়নি। খরচও হয়নি। তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতিটা হলো কেমন করে? কানাডার লাভালিন কোম্পানি নাকি ঘুষ সেধেছিল। লাভালিন কোম্পানিকে তো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কাজ না পেলেও কি ঘুষ দেবে? ঘুষ সাধলেই কি ঘুষ নেওয়া হয়? অপরাধ সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত অপরাধ হয় না। এটা আইনের কথা। তাছাড়া 'ঘুষ সাধা'র অভিযোগ হয়েছে কানাডায় লাভালিনের বিরুদ্ধে, যা প্রমাণিত হয়নি। ওই মামলার রায় পেতে চার-পাঁচ বছর কেটে যাবে। কারণ, শুনানির প্রথম তারিখ পড়েছে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে। কানাডার আইনে ঘুষ সাধাও অপরাধ। কিন্তু প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এটা অভিযোগ মাত্র, অপরাধ নয়।
বিশ্বব্যাংকের এসব অনৈতিক কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে, দুর্নীতি বাহানা মাত্র। বড় রকমের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকে অনেক মহলের লবি রয়েছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির লবিও আছে। তাদের আন্তর্জাতিক মুরবি্বদের লবি আছে। একজন বাঙালি বিশ্ব নাগরিকের গোসাও নাকি যোগ হয়েছে। ওই বিশ্ব নাগরিক বিশ্বের রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। অথচ দেশের কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে কোনো সরকারের আমলেই তাকে দেখা যায়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৫ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি চেতনা_ এসব বিষয়ে কোনো সময়েই তার কোনো বক্তব্য ছিল না। আমন্ত্রণ জানালেও তিনি কোনো অনুষ্ঠানে আসেন না। বিরোধীদলীয় কোনো কোনো নেতা পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি করতে নেমেছেন। তাদের কাছে দেশের সম্মানের চেয়ে বিশ্বব্যাংকের সম্মান বেশি। জাতীয় ঐক্যের খাতিরে তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। আশার কথা, বিরোধী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আত্মপ্রতারণায় শামিল হয়নি। দেশদ্রোহী ও ধান্ধাবাজদের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার রোখার জন্য মুক্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সুশীল সমাজের উচিত সত্য প্রকাশ করা। এদেশীয় গোয়েবলসদের মুখে লাগাম থাকে না। নিরন্তর সত্য প্রকাশ ও মুক্ত তথ্যপ্রবাহ ওদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে দেবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ :ব্যাংকার ও কলাম লেখক
No comments