কথা সামান্যই-লেখকের বিড়ম্বনা by ফজলুল আলম
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই লেখা প্রকাশ করার সুবিধা সব লেখক পান না। এই সুবিধা না পাওয়া লেখকরা অনেক সময়ই বই প্রকাশক না পেলে নিজেরা প্রকাশক হন অথবা প্রকাশককে অর্থ দিয়ে নিজেদের বই ছাপানোর উদ্যোগ নেন। এই লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক প্রতিভাবান লেখক যেমন আছেন, তেমনি অলেখকও আছেন।
আমার মনে পড়ে, বর্তমানের সুপ্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ 'ব্যর্থ লেখক' আখ্যা দিয়েছিলেন। কথাটি উত্থাপন করার উদ্দেশ্য যেকোনো লেখক সম্পর্কে বিচার দেওয়া যায় না ('অ্যাডভান্স' মন্তব্য তো নয়ই)।
যে যাই বলুক আশা করতে দোষ নেই যে সুলেখকরা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবেন। ইউরোপে এমনো দৃষ্টান্ত আছে যে কালজয়ী রচনা লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়ে তাঁকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে (যেমন- হেনরি মিলার-এর 'ট্রপিক অব ক্যান্সার')।
খ্যাতির কথা যখন এসে গেল তখন একটা প্রশ্ন মনে আসে, এই খ্যাতির জন্যই কি লেখক লিখতে আগ্রহী হন? হয়তো তাই অথবা তা নয়। যদি না হয় তবে অন্য কারণের মধ্যে থাকতে পারে- লেখক লেখেন নিজের আনন্দের জন্য, কোনো ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করার জন্য, কোনো মতবাদ প্রচারের জন্য, প্রেমিকের জন্য, কাছের কারো জন্য, নিজের কল্পনাশক্তি চর্চার জন্য ইত্যাদি। খ্যাতি না পেলেও লেখক লিখে যেতে পারেন। অধিকাংশ লেখকের ভাগ্যে খ্যাতি আসে না। তবে এ কথাটি সত্য যে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ ব্যক্তির সংখ্যা মোটেই কম নয়।
তাহলে লেখালেখির পেছনে চালিকাশক্তি অনেক কিছু হতে পারে। খ্যাতির আশা অবশ্যই একটা, কিন্তু এই খ্যাতি অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য নয়। অনেকের কপালে অর্থনৈতিক সম্পদ জোটে এবং তারা লিখেই ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন- তারা সংখ্যায় খুবই কম। আমার এক বন্ধু ঢাকার 'বইমেলা'য় আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে 'এলোপাতাড়ি সাক্ষাৎকার' (র্যান্ডমাইজড ইন্টারভিউ) নিয়ে জানিয়েছিলেন যে তাঁদের মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তিই লেখক হওয়ার বাসনা পোষণ করেন, ১০ পার্সেন্ট নিজের খরচে বই ছাপিয়েছেন, ১৫ পার্সেন্ট প্রকাশককে পয়সা দিয়ে বই ছাপিয়েছেন। বাকিরা নানা চিন্তাভাবনা করছেন। ইংল্যান্ডে 'রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস ইয়ারবুক' নামে একটা বার্ষিকীর এ বছরে ১০৫ বছর পূর্তি হলো। জে কে রাওলিং (হ্যারি পটার খ্যাত) পর্যন্ত এই বার্ষিকী ব্যবহার করে প্রকাশক পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় ' ... এই ইয়ারবুকটি আমার লেখক হওয়ার পথে যত প্রশ্ন আমার মনে ছিল সবেরই উত্তর জুগিয়েছিল।' এই ইয়ারবুকে তালিকাভুক্ত প্রকাশকের কাছ থেকে ক্রমাগত 'না' উত্তর পেতে পেতে শেষে এক অ্যাজেন্ট তাঁকে নিয়েছিল। এই ইয়ারবুক লেখক হওয়ার বাসনা পোষণ করা ব্যক্তিদের জন্য তো একটা বাইবেল এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকদের জন্যও অপরিহার্য তথ্যভাণ্ডার। লিখিত বই ছাপানোর জন্য একজন লেখকের কী কী করণীয় তা পরিষ্কার করে 'ইয়ারবুকে' যেমন আছে, তেমনি কী কী করা উচিত না তাও সেটাতে আছে। এই ইয়ারবুক বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়, তা সত্ত্বেও লেখকের লেখার ও প্রকাশ করার তাগিদকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই 'লেখক ঠকানো' ব্যবসা হচ্ছে। আমাদের দেশেও লেখকের অর্থের বিনিময়ে বই ছাপানো এবং লেখককে ঠকানো (কত সংখ্যা ছাপা হয়েছে সেটা সত্যি না বলে) হরদম চলছে। আমাদের দেশে প্রকাশক নিজেই বই বাজারজাত করেন। তাঁরা নিজেদের লেখকের প্রকাশনা প্রচার-প্রসারে বা প্রবর্ধনায় বেশি উৎসাহী। যাঁদের বই ছাপানোর খরচ লেখক দিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ যেসব বই প্রকাশের খরচ উঠে গেছে, সেসব বইয়ের প্রচার তাঁরা করেন না। আবার অনেক প্রকাশনা নিজেদের লেখকের 'রয়ালটি' যথাযথভাবে মিটিয়ে দেবে সেটাও করে না।
বিলাত ও আমেরিকায় এখন এই 'সেলফ পাবলিশিং'-এর বিকল্প মেইনস্ট্রিম পাবলিশিং হাউসও গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপন দিয়ে অপ্রকাশিত লেখকদের আহ্বান করে; তাঁদের মধ্যে অনেকেই সৎভাবে প্রকাশনার ব্যবসা করেন। তাঁরা অধিকাংশই রিডিং ফি (পাণ্ডুলিপি পড়ার জন্য) চান এবং মনোনীত হলে বিস্তারিত কনট্রাক্ট পাঠান। এই কনট্রাক্টে বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা স্টাইল (পেপারব্যাক, সফটব্যাক, লাইব্রেরি বাইন্ডিং, চিত্রাঙ্কন, কাভার ইত্যাদি), কপি সংখ্যা, লেখক কত সংখ্যা বিনা মূল্যে পাবেন, বিক্রি হলে লেখকের রয়ালটি কত হবে ইত্যাদি খরচের বিবরণ থাকে এবং লেখককে কত দিতে হবে তার হিসাব থাকে। দুই পক্ষ রাজি হলে ও টাকা আগাম দিলে বই প্রকাশিত হয়। এই সিস্টেমের মধ্যে অনেক অসৎ প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে উঠেছে, এবং তারা অপ্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করার নামে বেশি পয়সা চার্জ করে এবং অন্যভাবেও লেখককে ঠকায়। ছাপা প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অসৎ বইব্যবসারও প্রসার হয়েছে। যেমন- এক টেকনোলজিতে কম্পিউটারে পেজ মেকআপ করা ম্যাটার থেকে এক-দুই কপি বই সহজেই রেডি করে কেস বাইন্ডিং করে প্রকাশিত হয়েছে বলা যায়। এই প্রযুক্তির নাম 'পিওডি'- প্রিন্ট অন ডিমান্ড; এটা শুরু হয়েছিল আউট অব প্রিন্ট বইয়ের স্বল্পসংখ্যক কপি তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করার জন্য। এ প্রযুক্তিকে অসৎ বই ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে নতুন লেখকদের কাছ থেকে পুরো 'রান' ছাপানোর পয়সা নিয়ে। ধরে নিই এক রানে ৫০০ বা ১০০০ কপির কথা বলা হয়েছে এবং লেখক সেই পরিমাণ কপির পয়সা দিল। কিন্তু বাস্তবে পিওডি টেকনোলজি ব্যবহার করে অসৎ বই ব্যবসায়ী মাত্র কয়েকটি কপি ছাপিয়ে বাকি টাকা মেরে দিচ্ছে।
আরো একটা প্রযুক্তি আমাদের দেশে এসেছে, সেটা হলো 'ই-বুক'। বিদেশ থেকে আমাদের লেখকদের কাছে আহ্বান আসছে পাণ্ডুলিপি পাঠানোর। যদিও কাগজে ছাপানো বইয়ের চেয়ে এই পদ্ধতিতে খরচ অনেক কম হয়, তবু এটা এখনো জনপ্রিয় হয়নি। আমাদের দেশেও পিডিএফ ফর্ম্যাট ব্যবহার করে কম্পিউটারে পেজ মেকআপ করা পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু ই-বুক বলতে টেকনিক্যালি যা বোঝায় পিডিএফে তা পাওয়া যায় না। অনলাইন ডিজিটাল পাবলিশিং এবং ই-বুক এক নয়। যথাযথ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ই-বুক প্রস্তুত হলে এবং তা ই-বুক রিডারের মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পেলে মনেই হবে না যে বইটি যন্ত্রের মাধ্যমে আসছে। পপুলার রিডিং ছাড়া রেফারেন্স বইয়ের ক্ষেত্রে ই-বুক সময় বাঁচায় প্রচুর। কিন্তু ই-বুক রিডার এখনো বাজার ধরতে পারেনি। ফলে নতুন লেখকের জন্য এ ব্যবস্থায় প্রকাশনা করা সুবিধাজনক নয়।
তাহলে আমাদের নতুন লেখকরা কি যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকবে?
আমি আশাবাদী, অবস্থা বদলে যাবে। নতুন লেখকরা এখন বুঝতে পেরেছেন যে তাঁদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশযোগ্য করতে হলে অনেক খাটতে হবে। খেটে নির্ভুল বানানে, আকর্ষণীয় বিষয়ে, যথাযথ বাক্যে সুন্দর ঝকঝকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে হবে। প্রকারে তো বটেই, আকারেও প্রকাশকের মনোরঞ্জন করতে হবে। লেখক শুধু লেখবেন না, তাঁকেও প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ইতিমধ্যে অসৎ প্রকাশকদের বিরুদ্ধে একটা তৎপরতা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবেই না নতুন লেখকের বিড়ম্বনা ঘুচবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
যে যাই বলুক আশা করতে দোষ নেই যে সুলেখকরা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবেন। ইউরোপে এমনো দৃষ্টান্ত আছে যে কালজয়ী রচনা লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়ে তাঁকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে (যেমন- হেনরি মিলার-এর 'ট্রপিক অব ক্যান্সার')।
খ্যাতির কথা যখন এসে গেল তখন একটা প্রশ্ন মনে আসে, এই খ্যাতির জন্যই কি লেখক লিখতে আগ্রহী হন? হয়তো তাই অথবা তা নয়। যদি না হয় তবে অন্য কারণের মধ্যে থাকতে পারে- লেখক লেখেন নিজের আনন্দের জন্য, কোনো ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করার জন্য, কোনো মতবাদ প্রচারের জন্য, প্রেমিকের জন্য, কাছের কারো জন্য, নিজের কল্পনাশক্তি চর্চার জন্য ইত্যাদি। খ্যাতি না পেলেও লেখক লিখে যেতে পারেন। অধিকাংশ লেখকের ভাগ্যে খ্যাতি আসে না। তবে এ কথাটি সত্য যে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ ব্যক্তির সংখ্যা মোটেই কম নয়।
তাহলে লেখালেখির পেছনে চালিকাশক্তি অনেক কিছু হতে পারে। খ্যাতির আশা অবশ্যই একটা, কিন্তু এই খ্যাতি অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য নয়। অনেকের কপালে অর্থনৈতিক সম্পদ জোটে এবং তারা লিখেই ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন- তারা সংখ্যায় খুবই কম। আমার এক বন্ধু ঢাকার 'বইমেলা'য় আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে 'এলোপাতাড়ি সাক্ষাৎকার' (র্যান্ডমাইজড ইন্টারভিউ) নিয়ে জানিয়েছিলেন যে তাঁদের মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তিই লেখক হওয়ার বাসনা পোষণ করেন, ১০ পার্সেন্ট নিজের খরচে বই ছাপিয়েছেন, ১৫ পার্সেন্ট প্রকাশককে পয়সা দিয়ে বই ছাপিয়েছেন। বাকিরা নানা চিন্তাভাবনা করছেন। ইংল্যান্ডে 'রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস ইয়ারবুক' নামে একটা বার্ষিকীর এ বছরে ১০৫ বছর পূর্তি হলো। জে কে রাওলিং (হ্যারি পটার খ্যাত) পর্যন্ত এই বার্ষিকী ব্যবহার করে প্রকাশক পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় ' ... এই ইয়ারবুকটি আমার লেখক হওয়ার পথে যত প্রশ্ন আমার মনে ছিল সবেরই উত্তর জুগিয়েছিল।' এই ইয়ারবুকে তালিকাভুক্ত প্রকাশকের কাছ থেকে ক্রমাগত 'না' উত্তর পেতে পেতে শেষে এক অ্যাজেন্ট তাঁকে নিয়েছিল। এই ইয়ারবুক লেখক হওয়ার বাসনা পোষণ করা ব্যক্তিদের জন্য তো একটা বাইবেল এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকদের জন্যও অপরিহার্য তথ্যভাণ্ডার। লিখিত বই ছাপানোর জন্য একজন লেখকের কী কী করণীয় তা পরিষ্কার করে 'ইয়ারবুকে' যেমন আছে, তেমনি কী কী করা উচিত না তাও সেটাতে আছে। এই ইয়ারবুক বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়, তা সত্ত্বেও লেখকের লেখার ও প্রকাশ করার তাগিদকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই 'লেখক ঠকানো' ব্যবসা হচ্ছে। আমাদের দেশেও লেখকের অর্থের বিনিময়ে বই ছাপানো এবং লেখককে ঠকানো (কত সংখ্যা ছাপা হয়েছে সেটা সত্যি না বলে) হরদম চলছে। আমাদের দেশে প্রকাশক নিজেই বই বাজারজাত করেন। তাঁরা নিজেদের লেখকের প্রকাশনা প্রচার-প্রসারে বা প্রবর্ধনায় বেশি উৎসাহী। যাঁদের বই ছাপানোর খরচ লেখক দিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ যেসব বই প্রকাশের খরচ উঠে গেছে, সেসব বইয়ের প্রচার তাঁরা করেন না। আবার অনেক প্রকাশনা নিজেদের লেখকের 'রয়ালটি' যথাযথভাবে মিটিয়ে দেবে সেটাও করে না।
বিলাত ও আমেরিকায় এখন এই 'সেলফ পাবলিশিং'-এর বিকল্প মেইনস্ট্রিম পাবলিশিং হাউসও গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপন দিয়ে অপ্রকাশিত লেখকদের আহ্বান করে; তাঁদের মধ্যে অনেকেই সৎভাবে প্রকাশনার ব্যবসা করেন। তাঁরা অধিকাংশই রিডিং ফি (পাণ্ডুলিপি পড়ার জন্য) চান এবং মনোনীত হলে বিস্তারিত কনট্রাক্ট পাঠান। এই কনট্রাক্টে বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা স্টাইল (পেপারব্যাক, সফটব্যাক, লাইব্রেরি বাইন্ডিং, চিত্রাঙ্কন, কাভার ইত্যাদি), কপি সংখ্যা, লেখক কত সংখ্যা বিনা মূল্যে পাবেন, বিক্রি হলে লেখকের রয়ালটি কত হবে ইত্যাদি খরচের বিবরণ থাকে এবং লেখককে কত দিতে হবে তার হিসাব থাকে। দুই পক্ষ রাজি হলে ও টাকা আগাম দিলে বই প্রকাশিত হয়। এই সিস্টেমের মধ্যে অনেক অসৎ প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে উঠেছে, এবং তারা অপ্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করার নামে বেশি পয়সা চার্জ করে এবং অন্যভাবেও লেখককে ঠকায়। ছাপা প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অসৎ বইব্যবসারও প্রসার হয়েছে। যেমন- এক টেকনোলজিতে কম্পিউটারে পেজ মেকআপ করা ম্যাটার থেকে এক-দুই কপি বই সহজেই রেডি করে কেস বাইন্ডিং করে প্রকাশিত হয়েছে বলা যায়। এই প্রযুক্তির নাম 'পিওডি'- প্রিন্ট অন ডিমান্ড; এটা শুরু হয়েছিল আউট অব প্রিন্ট বইয়ের স্বল্পসংখ্যক কপি তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করার জন্য। এ প্রযুক্তিকে অসৎ বই ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে নতুন লেখকদের কাছ থেকে পুরো 'রান' ছাপানোর পয়সা নিয়ে। ধরে নিই এক রানে ৫০০ বা ১০০০ কপির কথা বলা হয়েছে এবং লেখক সেই পরিমাণ কপির পয়সা দিল। কিন্তু বাস্তবে পিওডি টেকনোলজি ব্যবহার করে অসৎ বই ব্যবসায়ী মাত্র কয়েকটি কপি ছাপিয়ে বাকি টাকা মেরে দিচ্ছে।
আরো একটা প্রযুক্তি আমাদের দেশে এসেছে, সেটা হলো 'ই-বুক'। বিদেশ থেকে আমাদের লেখকদের কাছে আহ্বান আসছে পাণ্ডুলিপি পাঠানোর। যদিও কাগজে ছাপানো বইয়ের চেয়ে এই পদ্ধতিতে খরচ অনেক কম হয়, তবু এটা এখনো জনপ্রিয় হয়নি। আমাদের দেশেও পিডিএফ ফর্ম্যাট ব্যবহার করে কম্পিউটারে পেজ মেকআপ করা পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু ই-বুক বলতে টেকনিক্যালি যা বোঝায় পিডিএফে তা পাওয়া যায় না। অনলাইন ডিজিটাল পাবলিশিং এবং ই-বুক এক নয়। যথাযথ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ই-বুক প্রস্তুত হলে এবং তা ই-বুক রিডারের মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পেলে মনেই হবে না যে বইটি যন্ত্রের মাধ্যমে আসছে। পপুলার রিডিং ছাড়া রেফারেন্স বইয়ের ক্ষেত্রে ই-বুক সময় বাঁচায় প্রচুর। কিন্তু ই-বুক রিডার এখনো বাজার ধরতে পারেনি। ফলে নতুন লেখকের জন্য এ ব্যবস্থায় প্রকাশনা করা সুবিধাজনক নয়।
তাহলে আমাদের নতুন লেখকরা কি যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকবে?
আমি আশাবাদী, অবস্থা বদলে যাবে। নতুন লেখকরা এখন বুঝতে পেরেছেন যে তাঁদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশযোগ্য করতে হলে অনেক খাটতে হবে। খেটে নির্ভুল বানানে, আকর্ষণীয় বিষয়ে, যথাযথ বাক্যে সুন্দর ঝকঝকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে হবে। প্রকারে তো বটেই, আকারেও প্রকাশকের মনোরঞ্জন করতে হবে। লেখক শুধু লেখবেন না, তাঁকেও প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ইতিমধ্যে অসৎ প্রকাশকদের বিরুদ্ধে একটা তৎপরতা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবেই না নতুন লেখকের বিড়ম্বনা ঘুচবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments