বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩০২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবুল হাসেম, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সফল যোদ্ধা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে আবুল হাসেম ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। প্রবল আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে পাইকারিহারে হতাহত হতে থাকল তারা। ঘণ্টা দেড়েক পর পাকিস্তানি সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকল।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সে সুযোগ দিলেন না। এ ঘটনা কানাইঘাটে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে।
কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত উপজেলা। জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সড়কে। সুরমা নদীর তীরে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম দখল করার পর দ্রুত এগোতে থাকেন সিলেটের দিকে। তাঁরা বাধাপ্রাপ্ত হন কানাইঘাটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী এই প্রতিরক্ষা অবস্থান দখলের দায়িত্ব ছিল নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সের ওপর। শেষ পর্যন্ত সে দায়িত্ব বর্তায় মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর।
১ ডিসেম্বর ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একযোগে কানাইঘাটে অভিযান শুরু করে। একটি দল দরবস্ত-কানাইঘাট সড়কে আর অন্য দল চরঘাট-কানাইঘাট সড়কে কাট অব পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। এর ফলে দুই দিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য সাহায্য আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। দুটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর ওই দলে ছিলেন আবুল হাসেম।
২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে যার অবস্থানে অবস্থান নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাপক আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু করে। বিরামহীন ছিল সেই গোলাবর্ষণ। এসব উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যান। সকাল হওয়ার আগেই তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। দেড় ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে থাকে। তখন আনুমানিক সকাল সাতটা, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের সে সুযোগ দেননি। তাঁরা উপর্যুপরি আক্রমণ চালাতে থাকেন। ১৫ মিনিট পর তাঁরা সরাসরি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিদের কিছু পালিয়ে যায় সুরমা নদীর তীরে। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাদের শরীর। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই মুক্ত হয়ে যায় কানাইঘাট। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অসংখ্য সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ ও ২০ জন আহত হন। এই যুদ্ধে আবুল হাসেম অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
আবুল হাসেম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবুল হাসেমকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৬৫।
আবুল হাসেম দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ২০১১ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলার চাপরাশির হাট ইউনিয়নের চর ফকিরা গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখানেই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম আলী আজম। স্ত্রী আরবের নেছা। তাঁর পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত উপজেলা। জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সড়কে। সুরমা নদীর তীরে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম দখল করার পর দ্রুত এগোতে থাকেন সিলেটের দিকে। তাঁরা বাধাপ্রাপ্ত হন কানাইঘাটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী এই প্রতিরক্ষা অবস্থান দখলের দায়িত্ব ছিল নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সের ওপর। শেষ পর্যন্ত সে দায়িত্ব বর্তায় মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর।
১ ডিসেম্বর ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল একযোগে কানাইঘাটে অভিযান শুরু করে। একটি দল দরবস্ত-কানাইঘাট সড়কে আর অন্য দল চরঘাট-কানাইঘাট সড়কে কাট অব পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। এর ফলে দুই দিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য সাহায্য আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। দুটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর ওই দলে ছিলেন আবুল হাসেম।
২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে যার অবস্থানে অবস্থান নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাপক আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু করে। বিরামহীন ছিল সেই গোলাবর্ষণ। এসব উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যান। সকাল হওয়ার আগেই তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। দেড় ঘণ্টা পর পাকিস্তানি সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে থাকে। তখন আনুমানিক সকাল সাতটা, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের সে সুযোগ দেননি। তাঁরা উপর্যুপরি আক্রমণ চালাতে থাকেন। ১৫ মিনিট পর তাঁরা সরাসরি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিদের কিছু পালিয়ে যায় সুরমা নদীর তীরে। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাদের শরীর। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই মুক্ত হয়ে যায় কানাইঘাট। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অসংখ্য সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ ও ২০ জন আহত হন। এই যুদ্ধে আবুল হাসেম অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
আবুল হাসেম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবুল হাসেমকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৬৫।
আবুল হাসেম দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ২০১১ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলার চাপরাশির হাট ইউনিয়নের চর ফকিরা গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এখানেই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম আলী আজম। স্ত্রী আরবের নেছা। তাঁর পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments