বৃক্ষরোপণ সাদকায়ে জারিয়া by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সবিশেষ সওয়াবের কাজ হিসেবে ‘সাদকায়ে জারিয়া’ বা অবিরত দানরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানুষ মৃত্যুর পরও সাদকায়ে জারিয়ার সওয়াব অব্যাহতভাবে পেতে থাকবে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, শুধু তিনটি ব্যতীত। ১. যদি সে কোনো সাদকায়ে জারিয়া রেখে যায়, ২. অথবা এমন জ্ঞান রেখে যায়, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, ৩. অথবা কোনো সৎ সন্তান রেখে যায়, যে তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করে। এ তিনটি ভালো কাজের ফল সে পেতে থাকে।’
সুতরাং, কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যা করেন, তাহলে ওই বৃক্ষ যত দিন বেঁচে থাকবে এবং মানুষ ও জীবজন্তু যত দিন এর ফল বা উপকার ভোগ করতে থাকবে, তত দিন ওই ব্যক্তির আমলনামায় পুণ্যের সওয়াব লেখা হতে থাকবে। এমনকি বৃক্ষরোপণকারী যদি মারা যান, তাহলেও তাঁর আমলনামায় সওয়াব লেখা হতে থাকবে, যত দিন বৃক্ষটি বেঁচে থাকবে। কোনো মানুষ যদি ওই বৃক্ষ থেকে কোনো উপকার বা ফল ভোগ নাও করে, তা হলেও সংশ্লিষ্ট বৃক্ষরোপণকারীর আমলনামায় সওয়াব লেখা হতে থাকবে। ইসলামে বৃক্ষরোপণের ওপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা অনুধাবন করার জন্য নবী করিম (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীটিই যথেষ্ট। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায় বা শস্য বোনে এবং এ থেকে মানুষ, পাখি বা পশু তাদের আহার গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারীর) পক্ষে একটি সাদকা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) অন্য হাদিসে আছে, ‘গাছ থেকে যা চুরি হয়ে যায়, তা-ও তার পক্ষে একটি সাদকারূপে গণ্য হয়।’ (মুসলিম)
সৃষ্টিজগতের অপরূপ সৌন্দর্যলীলার মধ্যে বৃক্ষ অন্যতম। গাছপালা ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। মানুষ না থাকলে বৃক্ষের কোনো অসুবিধা হতো না, কিন্তু বৃক্ষ না থাকলে এ পৃথিবীতে আদম সন্তানের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেত। বৃক্ষ যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক, তেমনি আবার পরিবেশ সংরক্ষণেরও সজীব প্রতীক। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ বনভূমি দ্বারা একে সুশোভিত করেছেন। ধরণিতে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে চিরকাল বৃক্ষের ওপর নির্ভর করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা আমি সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদ্গম করি, অনন্তর তা হতে সবুজ পাতা উদ্গত করি, পরে তা হতে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্য-দানা উৎপাদন করি এবং খেজুরগাছের মাথি হতে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি আর আঙুরের উদ্যান সৃষ্টি করি এবং জলপাই ও দাড়িম্বও; এরা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও; লক্ষ করো! এর ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং এর পরিপক্বতা প্রাপ্তির প্রতি। বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত-৯৯)
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবজাতি ও সৃষ্টিকুলের সঙ্গে বৃক্ষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৃক্ষের মধ্যে নিহিত রয়েছে পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার উপকরণ অক্সিজেন। আল্লাহ তাআলা বৃক্ষের অক্সিজেনের মাধ্যমে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেন। মানুষ বৃক্ষ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে, আর বৃক্ষ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পৃথিবীতে দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই বৃক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। জন্মের পর মানুষের মুখে মধু দেওয়া হয়, সেই মধু বৃক্ষ থেকেই আসে। সুতরাং, গাছপালা মানবজাতির পরিচিত প্রতিবেশী ও সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী। গাছপালা মানুষের রান্নাবান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনে বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করার জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যও বৃক্ষ রোপণ করা দরকার। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা থেকে আগুন প্রজ্বলিত করো।’ (সূরা ইয়াছিন, আয়াত: ৮০)
ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরের একটি বিশেষ অঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করেন। ওইসব এলাকার গাছপালা কাটা এবং সেখানে বন্য পশুপাখি শিকার করা আজও নিষিদ্ধ। রাসুলে করিম (সা.) জনগণকে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে বিশেষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি নিজ হাতে বৃক্ষ রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও এর পরিচর্যা করেছেন। বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্তে তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে তা রোপণ করে যাও।’ (আদাবুল মুফরাদ)
আল্লাহ তাআলা বন-জঙ্গল ও বৃক্ষরাজির মাধ্যমেই বায়ু সঞ্চালন করেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এবং জীবজগৎকে বাঁচিয়ে রাখেন। মানবজাতির জীবনধারণের জন্য সর্বাবস্থাতেই বৃক্ষরাজির বিশেষ প্রয়োজন। ব্যাপক বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক বনায়ন না করে কেবল কেটে কেটে কাজে ব্যবহার করায় ধরণিতে বৃষ্টির অভাব, পৃথিবীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। যেহেতু পারিবারিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিকভাবে দৈনন্দিন কাজে এবং আসবাবপত্রের জন্য গাছপালা ব্যবহূত হয়ে থাকে, সেহেতু একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলাম কাউকে ফলবান বৃক্ষ নিধন বা কর্তনের অনুমতি দেয় না। কারণ, এতে অন্যরা বৃক্ষের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। তাই অকারণে বৃক্ষ ছেদন বা কর্তন করা যাবে না। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অকারণে একটি কুলগাছ কর্তন করবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’
ইসলামে বৃক্ষরোপণের বিষয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই দেশের ধর্মীয় নেতা, মসজিদের ইমাম-খতিব, বিশেষ করে, আলেম-ওলামারা সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রাখতে পারেন। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সাদকায়ে জারিয়া’ বা অবিরত দানরূপে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা সবার সামনে তুলে ধরে বৃক্ষের পরিচর্যায় গণসচেতনতা সৃষ্টি সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.