ইস্টার হামলার পর কেমন আছে শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা
মাত্র কয়েক মাস আগেও পশ্চিম
শ্রীলঙ্কায় মোহাম্মদ ইলিয়াসের ব্যবসা রমরমা ছিল। রাজধানী কলম্বো থেকে
মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে কত্তারামুল্লা গ্রামে একটি দোকান চালান তিনি।
কিন্তু ইস্টার সানডের হামলার পর তার ব্যবসা এতোই খারাপ হয়ে গেছে যে তিনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন।
রং
এর কৌটা থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক বাতি সবই আছে তার দোকানে। গ্রামের সবাই
দোকানটির কথা জানে। ঘরের কোন জিনিসের দরকার হলে মোটামুটি সবাই এখানে
কেনাকাটাও করতে আসে।
কত্তারামুল্লা গ্রামে মোহাম্মদ ইলিয়াসের মতো
মুসলমানের সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগ অধিবাসীই সিংহলি। কিন্তু এই দুই
বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের লোকেরা সেখানে বহু বছর ধরেই শান্তিতে বসবাস করে
আসছেন।
এই দোকানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকেরাই আসেন কেনাকাটা
করতে। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে কয়েকটি গির্জা ও হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার
পর এসব কিছুই যেন বদলে গেছে।
মুসলিমদের দোকান বয়কট
"ইস্টার
সানডের হামলার পর থেকে আমার প্রায় ৯০% সিংহলি কাস্টমার দোকানে আসা বন্ধ
করে দিয়েছে। গত কয়েক মাসে আমার ব্যবসা এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আমাকে
লাখ লাখ রুপি লোকসান গুনতে হচ্ছে," বলেন মি. ইলিয়াস।
স্বল্প-পরিচিত
স্থানীয় একটি ইসলামপন্থী গ্রুপের সাথে জড়িত কয়েকজন যুবক রাজধানী
কলম্বোসহ পূবের একটি শহরে কয়েকটি গির্জা ও দামি হোটেলে সকালে বোমা হামলা
চালায় যাতে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
মোহাম্মদ ইলিয়াস বলছেন, তার দোকানে সিংহলি বৌদ্ধ ক্রেতার সংখ্যা ৯০% কমে গেছে। |
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট
দাবি করেছে যে তারা এই ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। খ্রিস্টানদের এরকম একটি
ধর্মীয় উৎসবের দিনে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হামলা সারা দেশের মানুষকে
কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
"তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছি যে কিছু কিছু
ক্রেতা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যে
তাদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে আমি বড় ধরনের
সমস্যায় পড়বো," বলেন মি. ইলিয়াস।
কলম্বো থেকে বিবিসির সাংবাদিক
আনবারাসান এথিরাজান জানাচ্ছেন, শ্রীলংকায় মুসলিমদের অনেকেই বিশ্বাস করেন
যে ওই হামলার পর থেকে বহু সিংহলি তাদেরকে খারাপ মানুষ হিসেবে বিবেচনা
করেছে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা যেন প্রতিশোধের লক্ষ্য হয়ে উঠেছেন।
এর
পরে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের বাড়ি ঘর, দোকানপাট ও ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে ইস্টার
সানডের হামলার পরের মে মাসেই।
বৌদ্ধ একজন ভিক্ষু গত জুন মাসে সিংহলি লোকজনের প্রতি প্রকাশ্যে আহবান জানিয়েছে মুসলিমদের দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা না করতে।
অর্থমন্ত্রী
মাঙ্গালা সামারাভিরা এধরনের আহবানের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
"সত্যিকারের যারা বৌদ্ধ তাদেরকে ধর্মের এই তালেবানিকরণের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়াতে হবে।"
মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষ
এই
দ্বীপরাষ্ট্রটিতে বিভিন্ন জাতি, বিশ্বাস ও ধর্মের লোকেরা বহু বছর ধরে
একসাথে বসবাস করছে। দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটিতে মুসলিমদের সংখ্যা
প্রায় ১০ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সিংহলি বৌদ্ধ।
তাদের ১২% হিন্দু, বেশিরভাগই জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তামিল এবং ৭% খ্রিস্টান।
দেশটিতে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে বহু বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয়েছে ২০০৯ সালে।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাত ও সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।
রাজধানী কলম্বোর পেত্তা বাজারে একজন মুসলিম বিক্রেতা। |
সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে প্রায় ১০ বছর হলো। কিন্তু ইস্টার সানডের হামলায় আপাত ওই শান্তি যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
বর্বরোচিত
এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার সব মুসলমানই। কিন্তু তাদের এই
নিন্দা কট্টরপন্থী কিছু সিংহলিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
হামলার পরপরই তাদের রোষ গিয়ে পড়েছিল কট্টরপন্থী ওহাবি মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু
এখন মুসলিম নেতারা বলছেন যে তাদের পুরো সমাজই যেন প্রতিশোধের শিকার হচ্ছে।
তারা মনে করছেন, তাদের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চলছে তাতে শ্রীলঙ্কার মূলধারার
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী কেউই চিন্তিত নন।
সরকার বলছে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সেজন্য সারাদেশেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
মুসলিমদের উপর হামলা
"এবছরের
জুন মাসে সিংহলিরা মুসলিমদের বাড়িঘরের উপর হামলা চালায়। তখনই তারা ঠিক
বাড়ির বাইরে আমার ভাইকে হত্যা করেছে। আমরা ঠিক নিশ্চিত করে জানি না যে এই
হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবো কিনা," বলেন মোহাম্মদ নাজিম, যিনি উত্তর-পশ্চিম
শ্রীলঙ্কার পুত্তালামে বসবাস করেন।
পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে তারা দুজনকে গ্রেফতার করেছে। এই খুনের ঘটনায় এখনও তদন্ত চলছে।
মুসলিম নারীদের, বিশেষ করে যারা বোরকা, নিকাব ও হিজাবের মতো ইসলামিক পোশাক পরেন, তাদের উপরেও হামলা চালানো হচ্ছে।
হামলার
পরপরই অবশ্য সরকার নিরাপত্তার কারণে দেখিয়ে নারীদের মুখ ঢেকে রাখার পোশাক
নিকাব ও বোরকা পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে সরকার এই দুটো পোশাকের
নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি।
শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার
সংগঠনগুলো বলছে, এমনকি যেসব মুসলিম নারী মাথায় স্কার্ফ বা হিজাব পরেন
তারাও বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন।
কলম্বোর একটি মসজিদে প্রবেশের আগে দুজন মুসলিম নারীর শরীরে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। |
মুসলিম নারী উন্নয়ন
ট্রাস্টের একজন পরিচালক জুয়াওয়াইরা মোহিদেন বলছেন, "যেসব মুসলিম নারী
সরকারি অফিসে কাজ করছেন তারা নানা রকমের সমস্যায় পড়ছেন। কোথাও কোথাও কোন
নারী যদি মাথায় স্কার্ফ পরেন, তাহলেও তাকে বাড়িতে চলে যেতে বলা হচ্ছে।
তারপর তাকে বলা হচ্ছে শাড়ি পরে ফিরে আসার জন্য।"
তিনি জানান, যখন
কোন মুসলিম নারী আবায়া (পুরো শরীর ঢেকে রাখার পোশাক) পরে বাসে চড়েন, এরকম
ঘটনাও ঘটেছে যে সিংহলি নারীরা তার পাশে বসতে অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয় বৌদ্ধ নেতাদের ভূমিকা
স্থানীয় বৌদ্ধ নেতাদের আহবানে মুসলিমদের দোকানপাট বর্জন করা হচ্ছে। কখনও কখনও তারা তাদের ঊর্ধ্বতন নেতাদের দ্বারাও উৎসাহিত হন।
অতীতে
এধরনের মুসলিম-বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরির জন্যে অভিযোগ তোলা হয়েছে
জাতীয়তাবাদী একটি গ্রুপ বদু বালা সেনা বা বিবিএসের নেতা গালাগোদা আত্থে
গানানাসারা থেরোর বিরুদ্ধে।
তিনি বলেছেন, "মুসলিম দোকানপাট থেকে
জিনিসপত্র না কেনার কথা কোন সংস্থা বলেনি। লোকজন নিজে থেকেই এসব দোকান
পরিহার করছে। এনিয়ে আমাদের কিছু করার নেই।"
প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা
সিরিসেনা এবছরের মে মাসে এই ভিক্ষুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আদালত অবমাননার
জন্যে তার ছ'বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তাকে এক বছরও জেল খাটতে হয়নি।
"মুসলমানদেরকে
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে হবে। এর উত্তর তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।
আমরা বলছি না সব মুসলিমই সহিংসতার সাথে জড়িত। কিন্তু মুসলিম
ব্যবসায়ীদেরকে খুঁজে বের করতে হবে কারা কট্টর ইসলামপন্থী। তারপর তাদের
পরিচয় প্রকাশ করতে হবে," বলেন বিবিএসের এই নেতা।
কিন্তু একজন মুসলিম নেতা রউফ হাকিম এই বৌদ্ধ ভিক্ষুকে উদ্দেশ্য করে
বলছেন, "মুসলমানদেরকে এভাবে দোষারোপ করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তার নিজের
ভেতরেই আগে আলো জ্বালাতে হবে।"
বৌদ্ধ ভিক্ষু গালাগোদা আত্থে গানানাসারা থেরোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি মুসলিম-বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরিতে উস্কানি দিচ্ছেন। |
রউফ হাকিম শ্রীলঙ্কা মুসলিম
কংগ্রেসের নেতা এবং সরকারের একজন মন্ত্রী। তিনি বলেন, কোথায় সমস্যা হচ্ছে
সেটা খুঁজে বের করতে মুসলিমরা আগ্রহী। এবং এনিয়ে তারা ইতোমধ্যেই সমাজের
ভেতরে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে।
স্বাভাবিক হচ্ছে পরিস্থিতি
তবে গত কয়েক সপ্তাহে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
গোটা
মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলার পর এর আগে
সরকারের কয়েকজন মুসলিম মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তারা আবারও শপথ
নিয়ে সরকারের মন্ত্রীসভায় ফিরে এসেছেন।
একজন মুসলিম গাইনোকোলজিস্ট
মোহাম্মদ শফির বিরুদ্ধে একটি সিনহালা সংবাদপত্রে অভিযোগ উঠেছিলো যে তিনি
কয়েক হাজার বৌদ্ধ নারীকে তাদের অনুমতি না নিয়েই বন্ধ্যা করে দিয়েছেন।
তারপর
তাকে আটক করে কয়েক সপ্তাহ ধরে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছিল। তার
বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি- অপরাধ তদন্ত
দপ্তরের পক্ষ থেকে এধরনের রিপোর্ট দেয়া সত্ত্বেও তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
রাজধানী কলম্বোতে
ব্যস্ত পেত্তা বাজারের মুসলিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের সিংহলি ক্রেতারাও
ধীরে ধীরে তাদের দোকানে ফিরে আসতে শুরু করেছেন।
তবে আগামীতে, বিশেষ
করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কী হয়, সে বিষয়ে তারা কিছুটা উদ্বিগ্ন।
৯ই ডিসেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হবে জাতীয় নিরাপত্তা।
মুসলিম
নেতারা আশঙ্কা করছেন, ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার লক্ষ্যে
নির্বাচনের আগে মুসলিম-বিরোধী বহু কথাবার্তা শোনা যাবে যা সমাজকে আরো
বিভক্ত করবে।
"তাদেরকে বুঝতে হবে যে এধরনের বিভক্তিকরণের চেষ্টা
কট্টরপন্থীদেরকে আরো উস্কানি দেবে ও তাদের পক্ষে পরিবেশ সৃষ্টি করবে,"
সতর্ক করে দিয়েছেন মি. হাকিম।
শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা এখন আশা করছেন তারা যেন দেশটির বৃহত্তর রাজনৈতিক খেলায় কোন ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত না হন।
ইস্টার সানডের হামলায় ২৫০ জনেরও বেশি নিহত হয়। |
No comments