যেভাবে গণতন্ত্র জিতেছে by আনোয়ার ইব্রাহিম
এটা
সম্ভবত আমাদের সময়ের নির্দেশক হতে পারে যে, একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের
মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের অর্থ হলো ‘ডিজরাপশন অব দ্য
ইয়ার’ বা বিঘ্নতার বিরুদ্ধে বিজয়। মে মাসে মালয়েশিয়ায় জাতীয় নির্বাচনে যে
ফল আসে তাতে বিশ্বজুড়ে যে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদ, শরণার্থী, অভিবাসী ও
অন্যান্য ইস্যুতে প্রবণতা, সেদিকেই আশা করা হয়েছিল।
মালয়েশিয়া একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানে সব গ্রুপের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহযোগিতা এই পরিবর্তনকে সম্ভব করেছে। নির্বাচনী বাধাটা ছিল তীব্র, যেমনটা বিশ্ব প্রত্যাশা করেছে অথবা এ খাতের পণ্ডিতরা পূর্বাভাষ করেছেন। ফলে মালয়েশিয়ার ভোটাররা কি অর্জনের জন্য ভোট দিয়েছেন সে বিষয়ে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে নোট নিতে হবে।
শুরুতেই, মালয়েশিয়ানরা ভোট দিয়েছেন বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) জোটের শাসনের ইতি ঘটাতে। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) আধিপত্য করা এই জোট মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ছিল ১৯৫৭ সালে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই।
সাম্প্রদায়িক জাতিভিত্তিক রাজনীতির কারণে ইতি ঘটে বিএন-এর। উপরন্তু ভোটাররা ওই সরকার ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যারা সরকারি পণ্য স্থানান্তরের মাধ্য হিসেবে, সুবিধা দিয়েছে ব্যক্তিবিশেষকে এবং গ্রুপকে।
বিগত সরকার ব্যবস্থায় ব্যবসায় ও সামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বিরাজমান ফ্যাক্টর ছিল সরকার। তারা যা দিয়েছিল তার বিনিময়ে প্রত্যাশা করেছিল ভোটারদের অবিচল সমর্থন। এক্ষেত্রে তাদের প্রার্থীদের অবস্থা ও পারদর্শিতাকে আমলে নেয়া হয় নি। দীর্ঘ কয়েক দশকে ইউএনএমও শাসনে নির্বাচনী বিরোধ বা সামন্ততন্ত্র ছিল মালয়েশিয়ার অঙ্গ। এতে ভোটারদেরকে তাদের রাজনৈতিক মাস্টারদের কাছে জিম্মি রাখা হয়েছিল।
ব্যাপক দুর্নীতি, যা মালয়েশিয়ার শাসন ব্যবস্থায় মহামারী আকার ধারণ করেছিল তার কারণে ২০১৮ সালের মে মাসে জনগণের মন পাল্টে দেয়। পরিসংখ্যানটা ভয়াবহ। ১ মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ (১এমডিবি) তহবিল স্ক্যান্ডালে জনগণের বিলিয়নস রিঙ্গিত অদৃশ্য হয়ে যায়। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোতে খরচ করা হয়েছে নোংরাভাবে।
দুর্নীতির দাম্ভিকতা এতটাই উন্মুক্ত ছিল যে, তা যেকোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডের চেয়ে বেশি কার্যকর ও ব্যাপক ছিল। যখন ধনীরা নিজেদেরকে আরো ধনী করছেন, তখন এটা খুব কম বিস্ময়ের বিষয় যে, যারা এর নিচে রয়েছেন, যাদের জীবনধারায় ক্রমাবনতি ঘটছে, তাদেরকে পথ অনুসরণ করতে হয়েছে। পুরো মালয়েশিয়ান সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ধারণাটি ভোটারদের আশ্বস্ত করেছে যে, শুধু কিছু র্যাডিকেল পরিবর্তন করা হবে।
নির্বাচনী বৃত্তের চেয়ে আরো অনেক গভীরে পরিবর্তনের শিকড় নিহিত। মালয়েশিয়ায় গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের মূল নিহিত রয়েছে ২০ বছরের সংস্কার বিষয়ক প্রচারণার মধ্যে। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই এটি একটি অংশ ছিল। ওই সময়ে আমাকে সরকার থেকে বরখাস্ত করা হলো এবং বানোয়াট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো।
পারতি কেডিলান রাকায়েত (পিকেআর) যে সংস্কারমুলক এজেন্ড হাতে নিয়েছে আস্তে আস্তে তা-ই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করেছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আমাদের বিরোধী জোট কিন্তু পপুলার ভোটে বিজয়ী হয়েছিল।
মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে অবসর ভেঙে বেরিয়ে এলেন। এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, মাহাথির ও আমাদের মধ্যে অতীতে এক ঝড়ো সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন জেলে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন এবং বিরোধী জোটে আমাদের যোগ দেয়া নিয়ে আলোচনা করলেন তখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আমরা বড় ধরনের অর্জন করেছি।
পূর্বে যে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধী ছিল তারা একত্রিত হচ্ছে এর মধ্যে কোনো নেতিবাচক কিছু নেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু মন থেকে সব কালিমা মুছে ফেলা, ক্ষমা করে দেয়া এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বড় পরিবর্তন, যাতে দেশের জন্য রাজনীতিকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। ২০ বছর পরে নির্বাচনে বিজয়ী হয় হাকাতান হারাপান জোট। নির্বাচনে পিকেআর একক বৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আমাদের নির্বাচন পূর্ববর্তী চুক্তি অনুযায়ী, মাহাথির মোহাম্মদ হওয়ার কথা আমাদের নতুন প্রধানমন্ত্রী।
নতুন জোট সরকারের সামনে একটি সংস্কারমূলক এজেন্ডা আছে। তা বাস্তবায়নে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এতে মালয়েশিয়াকে একটি পরিপক্ব, সমতাভিত্তিক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বপ্ন সাজানো হয়েছে। আমাদের অনেক এজেন্ডার মধ্যে দুর্নীতি বন্ধ করা অন্যতম। অবাধ, সুষ্ঠু ও বাধাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সরকারি পণ্য ও সেবার সম বন্টন নিশ্চিত করতে একটি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, অবাধ মিডিয়া, সক্রিয় নাগরিক-সামাজিক সংগঠনকে লালন করার কথা বলা হয়।
গণতান্ত্রিক আরো একটি উদ্যোগ হলো সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে প্রকৃত মেধার কাছে সরে আসা, যেখানে মালয়েশিয়ার সব নাগরিক সুবিধা পাবেন। আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক অবজ্ঞার ফলে উত্তরাধিকারে যে অবহেলার শিকার হয়েছে মালয় ও বুমিপুতেরা সম্প্রদায় তাদেরকে সহায়তার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইউএনএমও-এর শাসনের অধীনে অনেক সময় ধরে ইতিবাচক বৈষম্য পরিণত হয়েছে এমন একটি ব্যবস্থায় যাকে দেখা হয় উদ্দোক্তা ও উচ্চাভিলাষীদের বোকা বানানো হিসেবে। প্রশান্তি ও দুর্নীতির জন্য ইতিবাচক কর্মকান্ড হয়ে ওঠে একটি অবলম্বন। তবে তা সহায়ক হাত নয়।
জাতিগত মূল পরিচয়ের দিকে না তাকিয়ে অভাবী মানুষকে এখন সহায়তা দিয়ে যাবে মালয়েশিয়া। গ্রামে বসবাস করা মালয়দের প্রয়োজনের বিষয়টি পছন্দ বা অপছন্দের বিষয় নয়। অভাবীদের যোগ্যতা সম্পন্ন করতে হবে। দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায়গত ভিত্তি কোনো পার্থক্য হতে পারে না।
মালয়েশিয়ার শক্তি হলো এর বহুত্ববাদ। বহু সংস্কৃতির এই সমাজে আরো উন্মুক্ত ও প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনে আমাদেরকে আরো অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের ‘রিচনেস’ বা বিত্তশীলতা শেয়ার করার মধ্য দিয়ে এবং বিভিন্ন রকম প্রচলিত রীতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধারণাকে আরো কার্যকর করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে আরো অনেক কিছু অর্জন করেতে হবে। সংস্কার ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়া হয়ে উঠবে অধিক গতিশীল, উৎপাদনশীল সমাজ এবং শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের দেশ। বিশ্বের জন্য এটাই প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। ২০১৮ সালের শুরুতে আমি জেলে ছিলাম। আমাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সরকার ছিল দৃঢ় অবস্থানে। তাই আমার জন্য ২০১৮ সালটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
জেলে থাকা অবস্থায় আমরা যে সমঝোতা করেছিলাম জোটের বিষয়ে সেই জোট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ও অপ্রত্যাশিত বিজয় পায়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি জেল থেকে মুক্তি পাই এবং আমাকে রাজকীয় ক্ষমা করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যে আমি নির্বাচনে দাঁড়াই এবং একটি উপনির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে ফিরেছি। এখন আমি সংস্কারমুলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করছি। কয়েক দশকে বাস্তব পরিবর্তনের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
যদি এটা ‘ডিজরাপশন’ হয় তাহলে আমি এর জন্য ২০১৯ ও তারপরের দিকেও তাকিয়ে থাকবো।
(আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির পার্লামেন্টের একজন সদস্য। তিনি পারতি কেদিলান রাকায়াত দলের সভাপতি ও পাকাতান হারাপান কোয়ালিশনের নেতা। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টারে। সেখান থেকে অনুবাদ)
মালয়েশিয়া একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানে সব গ্রুপের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহযোগিতা এই পরিবর্তনকে সম্ভব করেছে। নির্বাচনী বাধাটা ছিল তীব্র, যেমনটা বিশ্ব প্রত্যাশা করেছে অথবা এ খাতের পণ্ডিতরা পূর্বাভাষ করেছেন। ফলে মালয়েশিয়ার ভোটাররা কি অর্জনের জন্য ভোট দিয়েছেন সে বিষয়ে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে নোট নিতে হবে।
শুরুতেই, মালয়েশিয়ানরা ভোট দিয়েছেন বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) জোটের শাসনের ইতি ঘটাতে। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) আধিপত্য করা এই জোট মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ছিল ১৯৫৭ সালে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই।
সাম্প্রদায়িক জাতিভিত্তিক রাজনীতির কারণে ইতি ঘটে বিএন-এর। উপরন্তু ভোটাররা ওই সরকার ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যারা সরকারি পণ্য স্থানান্তরের মাধ্য হিসেবে, সুবিধা দিয়েছে ব্যক্তিবিশেষকে এবং গ্রুপকে।
বিগত সরকার ব্যবস্থায় ব্যবসায় ও সামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বিরাজমান ফ্যাক্টর ছিল সরকার। তারা যা দিয়েছিল তার বিনিময়ে প্রত্যাশা করেছিল ভোটারদের অবিচল সমর্থন। এক্ষেত্রে তাদের প্রার্থীদের অবস্থা ও পারদর্শিতাকে আমলে নেয়া হয় নি। দীর্ঘ কয়েক দশকে ইউএনএমও শাসনে নির্বাচনী বিরোধ বা সামন্ততন্ত্র ছিল মালয়েশিয়ার অঙ্গ। এতে ভোটারদেরকে তাদের রাজনৈতিক মাস্টারদের কাছে জিম্মি রাখা হয়েছিল।
ব্যাপক দুর্নীতি, যা মালয়েশিয়ার শাসন ব্যবস্থায় মহামারী আকার ধারণ করেছিল তার কারণে ২০১৮ সালের মে মাসে জনগণের মন পাল্টে দেয়। পরিসংখ্যানটা ভয়াবহ। ১ মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ (১এমডিবি) তহবিল স্ক্যান্ডালে জনগণের বিলিয়নস রিঙ্গিত অদৃশ্য হয়ে যায়। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোতে খরচ করা হয়েছে নোংরাভাবে।
দুর্নীতির দাম্ভিকতা এতটাই উন্মুক্ত ছিল যে, তা যেকোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডের চেয়ে বেশি কার্যকর ও ব্যাপক ছিল। যখন ধনীরা নিজেদেরকে আরো ধনী করছেন, তখন এটা খুব কম বিস্ময়ের বিষয় যে, যারা এর নিচে রয়েছেন, যাদের জীবনধারায় ক্রমাবনতি ঘটছে, তাদেরকে পথ অনুসরণ করতে হয়েছে। পুরো মালয়েশিয়ান সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ধারণাটি ভোটারদের আশ্বস্ত করেছে যে, শুধু কিছু র্যাডিকেল পরিবর্তন করা হবে।
নির্বাচনী বৃত্তের চেয়ে আরো অনেক গভীরে পরিবর্তনের শিকড় নিহিত। মালয়েশিয়ায় গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের মূল নিহিত রয়েছে ২০ বছরের সংস্কার বিষয়ক প্রচারণার মধ্যে। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই এটি একটি অংশ ছিল। ওই সময়ে আমাকে সরকার থেকে বরখাস্ত করা হলো এবং বানোয়াট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো।
পারতি কেডিলান রাকায়েত (পিকেআর) যে সংস্কারমুলক এজেন্ড হাতে নিয়েছে আস্তে আস্তে তা-ই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করেছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আমাদের বিরোধী জোট কিন্তু পপুলার ভোটে বিজয়ী হয়েছিল।
মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে অবসর ভেঙে বেরিয়ে এলেন। এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, মাহাথির ও আমাদের মধ্যে অতীতে এক ঝড়ো সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন জেলে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন এবং বিরোধী জোটে আমাদের যোগ দেয়া নিয়ে আলোচনা করলেন তখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আমরা বড় ধরনের অর্জন করেছি।
পূর্বে যে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধী ছিল তারা একত্রিত হচ্ছে এর মধ্যে কোনো নেতিবাচক কিছু নেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু মন থেকে সব কালিমা মুছে ফেলা, ক্ষমা করে দেয়া এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বড় পরিবর্তন, যাতে দেশের জন্য রাজনীতিকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। ২০ বছর পরে নির্বাচনে বিজয়ী হয় হাকাতান হারাপান জোট। নির্বাচনে পিকেআর একক বৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আমাদের নির্বাচন পূর্ববর্তী চুক্তি অনুযায়ী, মাহাথির মোহাম্মদ হওয়ার কথা আমাদের নতুন প্রধানমন্ত্রী।
নতুন জোট সরকারের সামনে একটি সংস্কারমূলক এজেন্ডা আছে। তা বাস্তবায়নে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এতে মালয়েশিয়াকে একটি পরিপক্ব, সমতাভিত্তিক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বপ্ন সাজানো হয়েছে। আমাদের অনেক এজেন্ডার মধ্যে দুর্নীতি বন্ধ করা অন্যতম। অবাধ, সুষ্ঠু ও বাধাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সরকারি পণ্য ও সেবার সম বন্টন নিশ্চিত করতে একটি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, অবাধ মিডিয়া, সক্রিয় নাগরিক-সামাজিক সংগঠনকে লালন করার কথা বলা হয়।
গণতান্ত্রিক আরো একটি উদ্যোগ হলো সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে প্রকৃত মেধার কাছে সরে আসা, যেখানে মালয়েশিয়ার সব নাগরিক সুবিধা পাবেন। আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক অবজ্ঞার ফলে উত্তরাধিকারে যে অবহেলার শিকার হয়েছে মালয় ও বুমিপুতেরা সম্প্রদায় তাদেরকে সহায়তার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইউএনএমও-এর শাসনের অধীনে অনেক সময় ধরে ইতিবাচক বৈষম্য পরিণত হয়েছে এমন একটি ব্যবস্থায় যাকে দেখা হয় উদ্দোক্তা ও উচ্চাভিলাষীদের বোকা বানানো হিসেবে। প্রশান্তি ও দুর্নীতির জন্য ইতিবাচক কর্মকান্ড হয়ে ওঠে একটি অবলম্বন। তবে তা সহায়ক হাত নয়।
জাতিগত মূল পরিচয়ের দিকে না তাকিয়ে অভাবী মানুষকে এখন সহায়তা দিয়ে যাবে মালয়েশিয়া। গ্রামে বসবাস করা মালয়দের প্রয়োজনের বিষয়টি পছন্দ বা অপছন্দের বিষয় নয়। অভাবীদের যোগ্যতা সম্পন্ন করতে হবে। দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায়গত ভিত্তি কোনো পার্থক্য হতে পারে না।
মালয়েশিয়ার শক্তি হলো এর বহুত্ববাদ। বহু সংস্কৃতির এই সমাজে আরো উন্মুক্ত ও প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনে আমাদেরকে আরো অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের ‘রিচনেস’ বা বিত্তশীলতা শেয়ার করার মধ্য দিয়ে এবং বিভিন্ন রকম প্রচলিত রীতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধারণাকে আরো কার্যকর করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে আরো অনেক কিছু অর্জন করেতে হবে। সংস্কার ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়া হয়ে উঠবে অধিক গতিশীল, উৎপাদনশীল সমাজ এবং শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের দেশ। বিশ্বের জন্য এটাই প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। ২০১৮ সালের শুরুতে আমি জেলে ছিলাম। আমাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সরকার ছিল দৃঢ় অবস্থানে। তাই আমার জন্য ২০১৮ সালটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
জেলে থাকা অবস্থায় আমরা যে সমঝোতা করেছিলাম জোটের বিষয়ে সেই জোট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ও অপ্রত্যাশিত বিজয় পায়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি জেল থেকে মুক্তি পাই এবং আমাকে রাজকীয় ক্ষমা করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যে আমি নির্বাচনে দাঁড়াই এবং একটি উপনির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে ফিরেছি। এখন আমি সংস্কারমুলক এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করছি। কয়েক দশকে বাস্তব পরিবর্তনের জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
যদি এটা ‘ডিজরাপশন’ হয় তাহলে আমি এর জন্য ২০১৯ ও তারপরের দিকেও তাকিয়ে থাকবো।
(আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির পার্লামেন্টের একজন সদস্য। তিনি পারতি কেদিলান রাকায়াত দলের সভাপতি ও পাকাতান হারাপান কোয়ালিশনের নেতা। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য ডেইলি স্টারে। সেখান থেকে অনুবাদ)
No comments