বর্জনেও অর্জন দেখছে বিএনপি by হাবিবুর রহমান খান
নিতান্ত
বাধ্য হয়েই ভোট চলাকালে তিন সিটি নির্বাচন বর্জন করলেও এরমধ্যে অনেক অর্জন
দেখছে বিএনপি। প্রথমত, নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের
জন্য বিএনপি জোট এতদিন ধরে যে আন্দোলন করে আসছিল তার যৌক্তিকতা জনগণের কাছে
প্রমাণিত হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন
কমিশনের অধীনে যে আদৌ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত
সিটি নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। ভোট কেন্দ্র দখলসহ ব্যাপক কারচুপির ভয়াবহ
চিত্র গণমাধ্যমে দেখাসহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেই সাধারণ জনগণের অনেকের কাছে
পুরো বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে- এমনটি মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারক
মহল। তিন সিটি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের কী অর্জন হয়েছে-
এমন প্রশ্নের জবাবে তারা যুগান্তরের কাছে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
অপরদিকে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি যেমন সঞ্চারিত হয়েছে, তেমনি নেতৃত্বের ধাপে ধাপে কিছু দুর্বল দিকও বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে তারা এখন দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সত্যিকারার্থে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ পাবেন।
এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন বর্জন নিয়ে দলের মধ্যে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। বর্জনের পরও তিন সিটিতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট দেখে অনেকেই মনে করছেন, বর্জনের সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি। বর্জনের পেছনে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের গন্ধও খুঁজছেন কেউ কেউ। তবে দলটির নীতিনির্ধারক ও চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের মতামত নিয়ে খালেদা জিয়া নিজেই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন মেয়র প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
ভোট বর্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, দল সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থীর মতামতের ওপর ভিত্তি করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, কারচুপির যেসব অভিযোগে তারা ভোট বর্জন করেছেন তা যে সঠিক ছিল তা আজ (বুধবার) প্রত্যেকটি গণমাধ্যম বিশেষ করে জাতীয় পত্রিকায় খবর দেখলেই তো স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
বর্জনের মধ্য দিয়ে কি অর্জন হল- জানতে চাইলে মওদুদ বলেন, ‘আমরা ভোটাধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এটা বারবার বলে আসছি। মঙ্গলবারের সিটি নির্বাচনে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। সিটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ফলে সরকারই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।’ বর্জনের পরও তিন সিটিতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের এত ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটাও সরকারের নীলনকশার অংশ। তারা যে ভোট ডাকাতি করেনি বা বিএনপির ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত পূর্বপরিকল্পিত তা প্রমাণ করার জন্যই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই কাজ করেছে।’
তিন সিটিতে ভোট বর্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছি আওয়ামী লীগ সরকার এবং এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা আরও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি, বর্তমান প্রশাসন সরকারের আজ্ঞাবহ। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে দীর্ঘদিন যে দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি তাও সঠিক।
নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সকাল নয়টার মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসে দক্ষিণের প্রায় সব কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছামতো ব্যালটে সিল মারছে। সাড়ে নয়টার দিকে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস আমাকে ফোন করে জানান, ‘হান্নান ভাই দয়া করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে থেকে কোনো লাভ হবে না।’ পরে বিষয়টি দলের চেয়ারপারসনকে অবহিত করি। চেয়ারপারসনের পরামর্শেই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিই।
হান্নান শাহ বলেন, এই নির্বাচনে থেকে আমরা সরকারের ভোট ডাকাতির বৈধতা দিতে চাইনি। তাই সরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তিনি বলেন, ভোটে কারচুপি করে সরকারের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে। এই কারণে তারা বিএনপির ওপর দায় চাপাতে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, ভোট গ্রহণের কিছু সময় পরেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার নীলনকশার নির্বাচন করছে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার কাছে অসংখ্য অভিযোগ আসতে থাকে। তিনি নিজেও অনেক কেন্দ্রে গিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখেন। প্রার্থী হওয়ার পরও তাকে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হয়। ভোট কেন্দ্রের এমন অবস্থা বিএনপির হাইকমান্ডকে অবহিত করি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে থাকা ঠিক হবে কিনা সে ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধও জানাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগারটার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা প্রভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়নি। ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা গণমাধ্যমের খবর দেখলেই তো বোঝা যায়। এই নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো দুঃখজনক।
জানা গেছে, ভোট বর্জনের পর এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন বিএনপি নেতারা। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মনে করেন, ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের যৌক্তিকতা আরও পোক্ত হয়েছে। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তবে জয়-পরাজয় দুটোতেই লাভ হতে পারে, এমন রোডম্যাপকে সামনে রেখে বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৃণমূলের কয়েকজন নেতা বলেন, সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি কিছুই হারায়নি। বরং প্রকাশ্যে এভাবে ভোট ডাকাতি করে দেশ-বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সকাল থেকেই গুলশানের বাসায় বসে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে মির্জা আব্বাস, তাবিথ আউয়াল ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি মনিটরিং টিম কাজ করে। নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বিশেষ টিমও রাখা হয়। কিন্তু সকালেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে মনিটরিং সেলে খবর আসতে থাকে যে, একে একে সব কেন্দ্র দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সকালে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস কেন্দ্র পরিদর্শন ও ভোট দিতে গিয়ে নিজেই এসব অভিযোগের চিত্র দেখতে পান। কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথও একই চিত্র দেখেন। গোপনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও ভোট কারচুপির বিভিন্ন তথ্য জানাতে থাকেন। এ ছাড়া বেশ কিছু কেন্দ্রে নির্বাচন শুরু হওয়ার এক/দেড় ঘণ্টা পর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে প্রথমে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি সরাসরি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর একই অনুভূতি জানিয়ে দলীয় চেয়ারপারসনকে ফোন করেন দক্ষিণের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ।
উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পিতা আবদুল আউয়াল মিন্টুও দলের চেয়ারপারসনকে ফোন করে জানান, ভোট ডাকাতির এই নির্বাচনে থেকে কোনো লাভ হবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়া উচিত। সকাল ১০টার কিছু পরে খালেদা জিয়া ফোন করেন আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের সদস্য সচিব শওকত মাহমুদকে। নির্বাচন সম্পর্কে তার মতামতও জানতে চান তিনি। শওকত মাহমুদ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘ম্যাডাম নির্বাচনে থাকা ঠিক হবে না। সরকার নীলনকশার নির্বাচন করছে। প্রায় সবগুলো কেন্দ্রই ক্ষমতাসীনরা দখলে নিয়ে নিয়েছে।’
এরপর খালেদা জিয়া কথা বলেন দুই সিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আসম হান্নান শাহর সঙ্গে। সবার পরামর্শ নিয়ে সবশেষে খালেদা জিয়া ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার দুই প্রার্থী ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের নয়া পল্টন কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেন। খালেদা জিয়ার এমন সিদ্ধান্তের কথা সকাল সাড়ে এগারটায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও হান্নান শাহকে জানিয়ে দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশনা পাওয়ার পর উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে ফোন করেন মওদুদ আহমদ। মওদুদের সঙ্গে কথা বলার পর তাবিথ ফোন করেন তার বাবা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে। এদিকে খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে তার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ফোন করে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত দ্রুত গণমাধ্যমকে জানাতে বলেন। এ সময় মওদুদ আহমদ পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়েও জানতে চান। জবাবে শিমুল বিশ্বাস বলেন, এখন শুধু ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত জানাতে বলেছেন ম্যাডাম। কর্মসূচির বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। নয়াপল্টনে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেন মওদুদ, আসম হান্নান শাহ, তাবিথ আউয়াল ও আফরোজা আব্বাস। প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে ফোন করে দ্রুত নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে বলেন মওদুদ। আধাঘণ্টার মধ্যে তারা নয়াপল্টনে চলে আসেন। তবে গাড়ি সংকটের কারণে হান্নান শাহ সময়মতো আসতে পারেননি। সোয়া বারোটার দিকে দুই প্রার্থী ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতাদের উপস্থিতিতে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন মওদুদ আহমদ।
এদিকে সবাই চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে প্রতিটি কেন্দ্র দখলের কথা খালেদা জিয়াকে জানায়। চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদেরও ফোনে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত জানার পরই চট্টগ্রাম বিএনপি নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
অপরদিকে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি যেমন সঞ্চারিত হয়েছে, তেমনি নেতৃত্বের ধাপে ধাপে কিছু দুর্বল দিকও বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে তারা এখন দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সত্যিকারার্থে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ পাবেন।
এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন বর্জন নিয়ে দলের মধ্যে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। বর্জনের পরও তিন সিটিতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট দেখে অনেকেই মনে করছেন, বর্জনের সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি। বর্জনের পেছনে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের গন্ধও খুঁজছেন কেউ কেউ। তবে দলটির নীতিনির্ধারক ও চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের মতামত নিয়ে খালেদা জিয়া নিজেই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। খালেদা জিয়ার নির্দেশেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন মেয়র প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
ভোট বর্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, দল সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থীর মতামতের ওপর ভিত্তি করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, কারচুপির যেসব অভিযোগে তারা ভোট বর্জন করেছেন তা যে সঠিক ছিল তা আজ (বুধবার) প্রত্যেকটি গণমাধ্যম বিশেষ করে জাতীয় পত্রিকায় খবর দেখলেই তো স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
বর্জনের মধ্য দিয়ে কি অর্জন হল- জানতে চাইলে মওদুদ বলেন, ‘আমরা ভোটাধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এটা বারবার বলে আসছি। মঙ্গলবারের সিটি নির্বাচনে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। সিটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ফলে সরকারই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।’ বর্জনের পরও তিন সিটিতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের এত ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটাও সরকারের নীলনকশার অংশ। তারা যে ভোট ডাকাতি করেনি বা বিএনপির ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত পূর্বপরিকল্পিত তা প্রমাণ করার জন্যই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই কাজ করেছে।’
তিন সিটিতে ভোট বর্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছি আওয়ামী লীগ সরকার এবং এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা আরও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি, বর্তমান প্রশাসন সরকারের আজ্ঞাবহ। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে দীর্ঘদিন যে দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি তাও সঠিক।
নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সকাল নয়টার মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসে দক্ষিণের প্রায় সব কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছামতো ব্যালটে সিল মারছে। সাড়ে নয়টার দিকে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস আমাকে ফোন করে জানান, ‘হান্নান ভাই দয়া করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে থেকে কোনো লাভ হবে না।’ পরে বিষয়টি দলের চেয়ারপারসনকে অবহিত করি। চেয়ারপারসনের পরামর্শেই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিই।
হান্নান শাহ বলেন, এই নির্বাচনে থেকে আমরা সরকারের ভোট ডাকাতির বৈধতা দিতে চাইনি। তাই সরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তিনি বলেন, ভোটে কারচুপি করে সরকারের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে। এই কারণে তারা বিএনপির ওপর দায় চাপাতে নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, ভোট গ্রহণের কিছু সময় পরেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার নীলনকশার নির্বাচন করছে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার কাছে অসংখ্য অভিযোগ আসতে থাকে। তিনি নিজেও অনেক কেন্দ্রে গিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখেন। প্রার্থী হওয়ার পরও তাকে কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হয়। ভোট কেন্দ্রের এমন অবস্থা বিএনপির হাইকমান্ডকে অবহিত করি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে থাকা ঠিক হবে কিনা সে ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধও জানাই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগারটার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা প্রভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়নি। ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা গণমাধ্যমের খবর দেখলেই তো বোঝা যায়। এই নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো দুঃখজনক।
জানা গেছে, ভোট বর্জনের পর এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন বিএনপি নেতারা। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মনে করেন, ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের যৌক্তিকতা আরও পোক্ত হয়েছে। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তবে জয়-পরাজয় দুটোতেই লাভ হতে পারে, এমন রোডম্যাপকে সামনে রেখে বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৃণমূলের কয়েকজন নেতা বলেন, সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি কিছুই হারায়নি। বরং প্রকাশ্যে এভাবে ভোট ডাকাতি করে দেশ-বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সকাল থেকেই গুলশানের বাসায় বসে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে মির্জা আব্বাস, তাবিথ আউয়াল ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি মনিটরিং টিম কাজ করে। নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বিশেষ টিমও রাখা হয়। কিন্তু সকালেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে মনিটরিং সেলে খবর আসতে থাকে যে, একে একে সব কেন্দ্র দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সকালে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস কেন্দ্র পরিদর্শন ও ভোট দিতে গিয়ে নিজেই এসব অভিযোগের চিত্র দেখতে পান। কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথও একই চিত্র দেখেন। গোপনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও ভোট কারচুপির বিভিন্ন তথ্য জানাতে থাকেন। এ ছাড়া বেশ কিছু কেন্দ্রে নির্বাচন শুরু হওয়ার এক/দেড় ঘণ্টা পর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে প্রথমে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি সরাসরি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর একই অনুভূতি জানিয়ে দলীয় চেয়ারপারসনকে ফোন করেন দক্ষিণের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ।
উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পিতা আবদুল আউয়াল মিন্টুও দলের চেয়ারপারসনকে ফোন করে জানান, ভোট ডাকাতির এই নির্বাচনে থেকে কোনো লাভ হবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়া উচিত। সকাল ১০টার কিছু পরে খালেদা জিয়া ফোন করেন আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের সদস্য সচিব শওকত মাহমুদকে। নির্বাচন সম্পর্কে তার মতামতও জানতে চান তিনি। শওকত মাহমুদ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘ম্যাডাম নির্বাচনে থাকা ঠিক হবে না। সরকার নীলনকশার নির্বাচন করছে। প্রায় সবগুলো কেন্দ্রই ক্ষমতাসীনরা দখলে নিয়ে নিয়েছে।’
এরপর খালেদা জিয়া কথা বলেন দুই সিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আসম হান্নান শাহর সঙ্গে। সবার পরামর্শ নিয়ে সবশেষে খালেদা জিয়া ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার দুই প্রার্থী ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের নয়া পল্টন কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেন। খালেদা জিয়ার এমন সিদ্ধান্তের কথা সকাল সাড়ে এগারটায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও হান্নান শাহকে জানিয়ে দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশনা পাওয়ার পর উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে ফোন করেন মওদুদ আহমদ। মওদুদের সঙ্গে কথা বলার পর তাবিথ ফোন করেন তার বাবা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে। এদিকে খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে তার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ফোন করে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত দ্রুত গণমাধ্যমকে জানাতে বলেন। এ সময় মওদুদ আহমদ পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়েও জানতে চান। জবাবে শিমুল বিশ্বাস বলেন, এখন শুধু ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত জানাতে বলেছেন ম্যাডাম। কর্মসূচির বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। নয়াপল্টনে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেন মওদুদ, আসম হান্নান শাহ, তাবিথ আউয়াল ও আফরোজা আব্বাস। প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে ফোন করে দ্রুত নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে বলেন মওদুদ। আধাঘণ্টার মধ্যে তারা নয়াপল্টনে চলে আসেন। তবে গাড়ি সংকটের কারণে হান্নান শাহ সময়মতো আসতে পারেননি। সোয়া বারোটার দিকে দুই প্রার্থী ও আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতাদের উপস্থিতিতে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন মওদুদ আহমদ।
এদিকে সবাই চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে প্রতিটি কেন্দ্র দখলের কথা খালেদা জিয়াকে জানায়। চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদেরও ফোনে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত জানার পরই চট্টগ্রাম বিএনপি নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
No comments