বিজয়ের সুন্দর উদযাপন by আনিসুল হক

বিজয় মহান। বিজয়ের জন্য সংগ্রাম মহত্তর। বিজয় সুন্দরভাবে উদযাপন করতে পারা মহত্তম। মাশরাফি বিন মুর্তজা আর তাঁর দলকে অভিনন্দন জানাতে হয় জাতিকে অপরূপ সুন্দর বিজয় উপহার দেওয়ার জন্য। পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা নিশ্চয়ই অনেক বড় আনন্দের একটা উপলক্ষ। এই জয়ের পেছনে রয়েছে অনেক দিনের কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলন, সাধনা আর প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশ দলের নেপথ্যে যাঁরা কাজ করছেন, দলের কোচ হাথুরুসিংহে, বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক, স্পিন বোলিং কোচ রুয়ান কালপাগে, ফিল্ডিং কোচ, ফিজিওসহ সবার কথাই আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে বিজয়ের এই উপলক্ষটা উদযাপনে বাংলাদেশ দলের পরিপক্বতা।
একবার বগুড়ায় শ্রীলঙ্কা দলকে হারানোর পরে ছেলেরা আনন্দে দৌড় ধরেছিল বলে তখনকার কোচ ডেভ হোয়াটমোর তাদের সমালোচনা করেছিলেন। একটা জয়েই আত্মহারা হলে তো চলবে না। এবার ১৬ বছর পর এক দিনের ম্যাচে বাংলাদেশ হারাল পাকিস্তানকে, কিন্তু তার পরও কোথাও উচ্ছ্বাসের আতিশয্য নেই, বাড়াবাড়ি নেই। আনন্দ আছে, খুশি আছে, কিন্তু বাঁধভাঙা সেলিব্রেশন নেই। আমাদের মনে পড়ে, ১৬ বছর আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে দর্শকেরাই দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলেন মাঠে। আর এখন? দুটো ম্যাচ জেতার পর সিরিজ জেতা হয়ে গেলে অধিনায়ক মাশরাফি বললেন, ‘আমাদের কাজ তো শেষ হয়নি। আরও একটা ম্যাচ বাকি।’ তারপর বুধবার ৩ নম্বর ম্যাচটাও যখন জেতা হয়ে গেল, আর সেটা কি যেমন তেমন জয়, ৮ উইকেটের বিশাল জয়, তার পরও তরুণতম খেলোয়াড়টিও ছুটলেন না মধ্যমাঠ বরাবর, স্টাম্প সংগ্রহের জন্য। কী শান্ত, কী সৌম্য, কী পরিপক্ব প্রতিক্রিয়া। আর মাশরাফি বললেন, ‘আমরা এখনো পুরোপুরি বদলাইনি, আমরা আরও বদলাতে পারি, আমরা আরও ভালো করতে পারি।’
শুধু যে মাশরাফি বিন মুর্তজা আর দলের খেলোয়াড়েরা সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা-ই নয়, বাংলাদেশের দর্শকেরাও যথেষ্টই পরিপক্ব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আমাদের মনে আছে কেনিয়ার সঙ্গে আইসিসি ট্রফির সেই ঐতিহাসিক ম্যাচটার কথা, আমরা খেলা শুনেছিলাম রেডিওতে, তারপর হাসিবুল হাসান শান্তর পা ছুঁয়ে জয়সূচক রানটা আসার সঙ্গে সঙ্গে একযোগে চিৎকার করতে করতে আমরা যে যেখানে ছিলাম, ছুটে গিয়েছিলাম রাস্তায়। আর এখন পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করার পরও আমরা শান্ত থাকি। হ্যাঁ, স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় মিছিল হয়েছে, কিন্তু তাতেও কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না, সৌম্য নামের ছেলেটি প্রথম শতক করেও যেমন শান্ত সৌম্য প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশের দর্শকেরাও তেমনি সুন্দরভাবেই তাদের উল্লাস প্রকাশ করতে পেরেছে। আমরা বিজয় অর্জন করতে শিখেছি, বিজয় উদযাপন করতেও শিখছি। বিজয়ে আমরা অভ্যস্ত হতে শিখছি।
খেলা আসলে সে জন্যই। জয় কিংবা পরাজয় দুটোকেই গ্রহণ করতে পারতে হবে খেলোয়াড়সুলভ আচরণের মধ্য দিয়ে। আমরা জাতীয় জীবনেও নানা দিক থেকে এগোচ্ছি, আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ভালো, শিশুমৃত্যু-মাতৃমৃত্যুর হার কমছে, আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে, মানব উন্নয়ন সূচকে উন্নতি হচ্ছে, আমরা ক্রীড়া ক্ষেত্রে ভালো করতে শুরু করেছি। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে খেলায় ভালো করা কঠিন। আবার ক্রিকেট নিয়েও অনেক কিছু করার আছে, বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট, ঘরোয়া লিগ, জাতীয় লিগ, প্রশিক্ষণ, একাডেমি—এসব বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বহুদিন থেকেই নানা রকমের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপের সুফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু করার আছে অনেক কিছুই।
আমাদের তরুণ ক্রিকেটাররা আমাদের আনন্দের উপলক্ষ দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সম্ভবত একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর মাধ্যমে।
বিজয়ীর পক্ষে, শক্তিমানের পক্ষেই সৌম্য প্রতিক্রিয়া দেখানো সাজে।
মাশরাফি বাহিনীর কাছ থেকে বোধ হয় এটা আমাদের শিখতে হবে।
২....
এবার একটু প্রসঙ্গান্তর। আসি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথায়। জাতীয় রাজনীতিতে কয়েক মাসের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আগুন-মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটা শ্বাস ফেলার ফুরসত এনে দিয়েছে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অবরোধ নেই। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে মেয়র পদপ্রার্থী মনোনয়নেও আমরা একটা ইতিবাচকতা দেখতে পাচ্ছি। ধরা যাক, ঢাকা উত্তরের কথাই। আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক ঠিক দলীয় লোক নন। তিনি আমাদের কাছে পরিচিত টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে। সফল ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা। বিএনপি মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল আরেক ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে, তাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়াল বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন। তিনিও তরুণ, ঠিক যাকে বলে রাজনীতির লোক, তা নন। টক শো করে পরিচিতি পাওয়া জোয়ারে সাকি কিংবা বামদের সমর্থিত আবদুল্লাহ আল ক্বাফী নিয়েও মানুষের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনটা যেন একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর সরকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারা। জনগণ অন্তত একটু স্বস্তির সঙ্গে চলাচল করার অবকাশ পাচ্ছে।
সেখানে সরকারি দলের আচরণ হওয়া উচিত পরিপক্ব, শান্ত, সৌম্য। সামনে নির্বাচন, ভোটাররা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন, সেটাও বিবেচনায় রাখা উচিত। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে পর পর তিন দিনের হামলা একেবারেই আত্মঘাতী কাজ হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের নীতিবিরুদ্ধ, বেআইনি, এই গৎবাঁধা কথার বাইরেও যা বলতে হবে, তা হলো, এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারি দল এবং সরকারি দল-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা। খালেদা জিয়া তাঁর সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইতে বেরিয়েছেন, এটা একটা ছোট্ট খবর। কিন্তু তাঁর গাড়িবহরে হামলা ব্যাপারটাকে করে তুলেছে সবগুলো সংবাদমাধ্যমের এক নম্বর খবর। বিনা পয়সায় ও বিনা আয়োজনে এত বড় প্রচার তাঁকে পাইয়ে দেওয়ার কাজটা করেছে হামলাকারীরা।
পেট্রলবোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া—এই রকমটা বলা হচ্ছে। ভোটাররা কিন্তু খুব বুদ্ধিমান, তাঁরা সব বোঝেন। কোনো দল বা গ্রুপ যদি কালো পতাকা প্রদর্শন পর্যন্ত সীমায়িত থাকত, তবু সেটাকে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি বলা যেত। কিন্তু লাঠিসোঁটা হাতে, কোমরে অস্ত্র গুঁজে হামলা তো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। বলা যেতে পারে, পেট্রলবোমা কি রাজনৈতিক কর্মসূচি? অবশ্যই নয়। সে কারণেই ওই কর্মসূচি দেশে-বিদেশে নিন্দিত, প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং পরিশেষে নিষ্ফল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা নূহ–উল–আলম লেনিনের লেখা—বেগম জিয়া তো নাহয় ঘরে ফিরে গেলেন, কিন্তু পেট্রলবোমাসহ সংঘাতে যারা হতাহত হয়েছে, তারা ও তাদের পরিবারগুলোর তো ফেরা হলো না—পাঠকদের মনকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা তাঁর প্রতি মানুষের সমবেদনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। এবং বিরোধী দলের দাবি—সরকারের আচরণ গণতান্ত্রিক নয়, সেটাকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে।
অথচ আমরা চাই আমাদের রাজনীতিও সৌম্য সুন্দর হোক, পরিপক্ব হোক। আমরা পেট্রলবোমার রাজনীতি চাই না, লাঠির রাজনীতিও চাই না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গণতান্ত্রিক সহনশীল পরিবেশ চাই। মত প্রকাশের উদার জমিন চাই। ভিন্নমত প্রকাশের ও বিরোধিতা করার স্বাধীনতা চাই। আবার মতের ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পরের সহযোগিতায় সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এমন একটা নতুন সংস্কৃতি চাই।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সুন্দরভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করাটাই হবে সর্বমহলের জন্য সবচেয়ে লাভজনক। ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন অবাধে, নির্ভয়ে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব, দেখে শুনে বুঝে দেব’—এই স্লোগান যেন বাস্তবায়িত হয়। এবং ভোটের ফলে যেন জনগণের মত প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশে সব সময়ই ভোট একটা উৎসব। দুই সিটির নির্বাচনে যেন উৎসবের আমেজটা রক্ষিত হয়। তারপর ফল যা-ই হোক না কেন, কোনো পক্ষেরই ক্ষতি নেই। মানুষের ভোট পেয়ে যদি সরকার সমর্থকেরা জয়লাভ করেন, তা সরকারকে আত্মবিশ্বাস দেবে, গ্রহণযোগ্যতাও দেবে, যদি হেরে যান, গণতন্ত্রের জয় হবে, সেটা তাদের একধরনের বৈধতা দেবে, দেশে-বিদেশে সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয় আমাদের আনন্দ দিয়েছে, সিটি নির্বাচনে গণতন্ত্রের জয় আমাদের স্বস্তি দিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.