অসমাপ্ত এক সংলাপ by দ্বিজেন শর্মা
রেইনট্রির নিচে লেখক দ্বিজেন শর্মা |
ঢাকা
শহরের গাছপালা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কিছু তরুণের
সঙ্গে কথা বলতে দিন কয়েক আগে পুরোনো পাবলিক লাইব্রেরির পেছনের চত্বরে
হাজির হই এবং সেখানকার বিশাল এক রেইনট্রির তলায় তাদের খুঁজে পাই। বহুদিন
এদিকে আসিনি, তাই সবই বড় অচেনা লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্র ছিলাম
(১৯৫৬-৫৮) তখন এই লাইব্রেরির নির্মাণ সবে শুরু হয়েছে এবং চারুকলা
ইনস্টিটিউট ছাড়া শাহবাগ পর্যন্ত কোনো দালানকোঠা ছিল না। সম্ভবত এলাকাটি
ছিল গাছগাছালি ভরা। গোটা দৃশ্যপট এখন পাল্টে গেছে, ছেলেমেয়েরা ঘুরে
বেড়াচ্ছে, অথচ আমাদের সময় কার্জন হলের চত্বরই দিনমান প্রায় শূন্য থাকত।
গাছের নিচে রাখা একটি বেঞ্চিতে বসলাম, সামনে স্ট্যান্ডে বসান ঢাউস ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। তার দিয়ে আমাকে একটি মাইক্রোফোনের সঙ্গে যুক্ত করে সেটি আমার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তাড়া দিলাম এবং একটি ছেলে এসে আমার পাশে বসল। শুরু হলো সংলাপ।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের গাছপালা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
আমাদের তাহলে ফিরতে হবে ১৯০৫ সালে, যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম একত্র করে ঢাকায় নবগঠিত এই প্রদেশের রাজধানী নির্মাণ হতে চলেছে রমনা এলাকায়, আর তাতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর গোটা রমনা গ্রিন, বর্তমান সচিবালয় ও নীলক্ষেত। ১৯১১ সালে নতুন এই প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং পরিকল্পিত রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১)। মন্ত্রীদের যে বাড়িগুলো দেখ, সেগুলোতে একসময় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। গোটা রাজধানী হস্তান্তরিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। রাজধানীর বৃক্ষসজ্জার দায়িত্ব পান লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের এক কর্মকর্তা আর. এল প্রাউডলক। তিনি ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন। তিনি দেশি-বিদেশি গাছপালা দিয়ে শহরের পথগুলো সাজান, যার সামান্য অবশিষ্টই শুধু আজ টিকে আছে মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে। তাই এই এলাকার বড় বড় গাছগুলোর বয়স জানার জন্য তাঁর থাকাকালীন সময়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা যেতে পারে, যদিও তার আগেও এখানে কিছু গাছ ছিল এবং পরেও অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। রমনা পার্কের গাছগুলো অনেক পরে লাগানো একমাত্র কুসুমগাছের সারি এবং একটি মহুয়া ও দু–তিনটি রেইনট্রি ছাড়া। ১৯১৮ সালে প্রাউডলক দেশে ফেরেন, আমাদের জন্য রেখে যান উদ্যান-নগর নির্মাণের একটি প্রত্নকাঠামো বা আর্কিটাইপ।
—বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা নির্মাণের সময় কি গাছপালা কাটা পড়েছিল?
—আমি তখন ঢাকায় ছিলাম না। অবশ্যই কাটা পড়েছে, শুনেছি একমাত্র বাওবাব গাছটিও রেহাই পায়নি।
—বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় গাছের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িত থাকলে সেগুলোর কথা বলুন।
—এদের কোনোটিই আর নেই। ঢাকা হলের তৃতীয় তলায় পূর্ব দিকের শেষ কক্ষে থাকতাম। কোনো কোনো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেডিকেল কলেজের সামনের গগন-শিরীষগাছের সারিগুলো দেখতাম। নিঃশব্দ চরাচর। মনে হতো ওরা গাছ নয়, অনৈসর্গিক কোনো সত্তা ক্ষণিকের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, উড়ে যাবে যেকেনো মুহূর্তে। ওদের থেকে চোখ ফেরাতে পারতাম না। কার্জন হল চত্বরে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বোটানিক গার্ডেনের সীমানায় ছিল দুটি গ্লিরিসিডিয়ার গাছ, সেগুলো বসন্তের শুরুতে হালকা বেগুনি সাদা ফুলে ভরে উঠত। একটি কোকিল গাছে বসে সারা দিন অবিরাম ডেকে চলত। আমি ও আমার এক সহপাঠী প্রায়ই বিকেলে ওই গাছের নিচে বসে গল্প করতাম। একসময় গোটা এলাকা নির্জন হতো, সন্ধ্যা নামত, আমরা বসেই থাকতাম। হঠাৎ করেই মনে হতো কার্জন হলের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন এক মোগল রাজকন্যা, অপরূপ সজ্জা, পিঠে দীর্ঘ বেণি, যেন এখনই নেমে আসবেন নিচের সবুজ তৃণাঙ্গনে। প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তার সামান্য পশ্চিমে গোলচত্বরে ছিল একটি পাকুড়গাছ, তাতে পেঁচিয়ে উঠেছিল স্পেক্টাবিলিস জাতের একটি বাগানবিলাস, বেগুনি রঙের ফুলে ভরে উঠে আমাদের বসন্তের আগমনী বার্তা জানাত। এক আশ্চর্য দৃশ্য। তখন এত যানজট, মানুষজন ছিল না। লোকে দাঁড়িয়ে থেকে সেই অপূর্ব শোভা দেখত। মিন্টো ও হেয়ার রোডের মিলনস্থলের গোলচত্বরের সুগন্ধি ফুলের বিশাল নাগলিঙ্গমগাছটিও আর নেই। পার্কে বেড়াতে আসা সবাই ওই গাছটি অন্তত একবার দেখে যেতেন।
—ঢাকা এখন কংক্রিটের শহর, হারিয়ে ফেলেছে বাসযোগ্যতা। কীভাবে এই শহরের পুনরুদ্ধার সম্ভব?
—আমার জানা নেই। টিভির টক শোতে নাগরিকদের বিষণ্ন² আলাপন শুনি। মনে পড়ে ছাত্রজীবনের কথা। আমরা প্রায়ই বেড়াতে যেতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে এবং স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা একদিন উদ্যান-নগর হবে। নদীর দুই পাড়ে থাকবে রয়েল পামের সারি ও নিওন বাতিশোভিত বুলেভার, জিঞ্জিরার মাঠ হবে খোলা ময়দান, সারা শহরে থাকবে প্রাউডলকের রমনা গ্রিন আদলের বৃক্ষসজ্জা—ছায়াময় মায়াময়। বর্তমান ঢাকা আজ আমাদের দুঃস্বপ্নের অতীত। ষাটের দশকের গোড়া থেকে আমি ঢাকার উন্নয়নের ধারা লক্ষ করে আসছি। যেসব উপাত্ত একটি মানবিক শহর নির্মাণকে পরাস্ত করে, সেগুলো ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, শক্তিধর হয়ে উঠেছে। এগুলো থামানো আমাদের সাধ্যাতীত।
—তাহলে আমাদের কোনো আশা নেই?
মাথা নাড়ি, কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না। তখনই বৃষ্টি নামে এবং আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু হয়। বাড়ি ফেরার পথে এই আলাপন আমাকেও বিষণ্ন করে। ভাবি, বলা উচিত ছিল—আশা আছে একটিই এবং সেটি তোমরা, দেশের নতুন প্রজন্ম।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
গাছের নিচে রাখা একটি বেঞ্চিতে বসলাম, সামনে স্ট্যান্ডে বসান ঢাউস ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। তার দিয়ে আমাকে একটি মাইক্রোফোনের সঙ্গে যুক্ত করে সেটি আমার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তাড়া দিলাম এবং একটি ছেলে এসে আমার পাশে বসল। শুরু হলো সংলাপ।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের গাছপালা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
আমাদের তাহলে ফিরতে হবে ১৯০৫ সালে, যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম একত্র করে ঢাকায় নবগঠিত এই প্রদেশের রাজধানী নির্মাণ হতে চলেছে রমনা এলাকায়, আর তাতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর গোটা রমনা গ্রিন, বর্তমান সচিবালয় ও নীলক্ষেত। ১৯১১ সালে নতুন এই প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং পরিকল্পিত রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১)। মন্ত্রীদের যে বাড়িগুলো দেখ, সেগুলোতে একসময় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। গোটা রাজধানী হস্তান্তরিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। রাজধানীর বৃক্ষসজ্জার দায়িত্ব পান লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের এক কর্মকর্তা আর. এল প্রাউডলক। তিনি ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন। তিনি দেশি-বিদেশি গাছপালা দিয়ে শহরের পথগুলো সাজান, যার সামান্য অবশিষ্টই শুধু আজ টিকে আছে মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে। তাই এই এলাকার বড় বড় গাছগুলোর বয়স জানার জন্য তাঁর থাকাকালীন সময়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা যেতে পারে, যদিও তার আগেও এখানে কিছু গাছ ছিল এবং পরেও অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। রমনা পার্কের গাছগুলো অনেক পরে লাগানো একমাত্র কুসুমগাছের সারি এবং একটি মহুয়া ও দু–তিনটি রেইনট্রি ছাড়া। ১৯১৮ সালে প্রাউডলক দেশে ফেরেন, আমাদের জন্য রেখে যান উদ্যান-নগর নির্মাণের একটি প্রত্নকাঠামো বা আর্কিটাইপ।
—বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা নির্মাণের সময় কি গাছপালা কাটা পড়েছিল?
—আমি তখন ঢাকায় ছিলাম না। অবশ্যই কাটা পড়েছে, শুনেছি একমাত্র বাওবাব গাছটিও রেহাই পায়নি।
—বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় গাছের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িত থাকলে সেগুলোর কথা বলুন।
—এদের কোনোটিই আর নেই। ঢাকা হলের তৃতীয় তলায় পূর্ব দিকের শেষ কক্ষে থাকতাম। কোনো কোনো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেডিকেল কলেজের সামনের গগন-শিরীষগাছের সারিগুলো দেখতাম। নিঃশব্দ চরাচর। মনে হতো ওরা গাছ নয়, অনৈসর্গিক কোনো সত্তা ক্ষণিকের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, উড়ে যাবে যেকেনো মুহূর্তে। ওদের থেকে চোখ ফেরাতে পারতাম না। কার্জন হল চত্বরে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বোটানিক গার্ডেনের সীমানায় ছিল দুটি গ্লিরিসিডিয়ার গাছ, সেগুলো বসন্তের শুরুতে হালকা বেগুনি সাদা ফুলে ভরে উঠত। একটি কোকিল গাছে বসে সারা দিন অবিরাম ডেকে চলত। আমি ও আমার এক সহপাঠী প্রায়ই বিকেলে ওই গাছের নিচে বসে গল্প করতাম। একসময় গোটা এলাকা নির্জন হতো, সন্ধ্যা নামত, আমরা বসেই থাকতাম। হঠাৎ করেই মনে হতো কার্জন হলের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন এক মোগল রাজকন্যা, অপরূপ সজ্জা, পিঠে দীর্ঘ বেণি, যেন এখনই নেমে আসবেন নিচের সবুজ তৃণাঙ্গনে। প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তার সামান্য পশ্চিমে গোলচত্বরে ছিল একটি পাকুড়গাছ, তাতে পেঁচিয়ে উঠেছিল স্পেক্টাবিলিস জাতের একটি বাগানবিলাস, বেগুনি রঙের ফুলে ভরে উঠে আমাদের বসন্তের আগমনী বার্তা জানাত। এক আশ্চর্য দৃশ্য। তখন এত যানজট, মানুষজন ছিল না। লোকে দাঁড়িয়ে থেকে সেই অপূর্ব শোভা দেখত। মিন্টো ও হেয়ার রোডের মিলনস্থলের গোলচত্বরের সুগন্ধি ফুলের বিশাল নাগলিঙ্গমগাছটিও আর নেই। পার্কে বেড়াতে আসা সবাই ওই গাছটি অন্তত একবার দেখে যেতেন।
—ঢাকা এখন কংক্রিটের শহর, হারিয়ে ফেলেছে বাসযোগ্যতা। কীভাবে এই শহরের পুনরুদ্ধার সম্ভব?
—আমার জানা নেই। টিভির টক শোতে নাগরিকদের বিষণ্ন² আলাপন শুনি। মনে পড়ে ছাত্রজীবনের কথা। আমরা প্রায়ই বেড়াতে যেতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে এবং স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা একদিন উদ্যান-নগর হবে। নদীর দুই পাড়ে থাকবে রয়েল পামের সারি ও নিওন বাতিশোভিত বুলেভার, জিঞ্জিরার মাঠ হবে খোলা ময়দান, সারা শহরে থাকবে প্রাউডলকের রমনা গ্রিন আদলের বৃক্ষসজ্জা—ছায়াময় মায়াময়। বর্তমান ঢাকা আজ আমাদের দুঃস্বপ্নের অতীত। ষাটের দশকের গোড়া থেকে আমি ঢাকার উন্নয়নের ধারা লক্ষ করে আসছি। যেসব উপাত্ত একটি মানবিক শহর নির্মাণকে পরাস্ত করে, সেগুলো ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, শক্তিধর হয়ে উঠেছে। এগুলো থামানো আমাদের সাধ্যাতীত।
—তাহলে আমাদের কোনো আশা নেই?
মাথা নাড়ি, কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না। তখনই বৃষ্টি নামে এবং আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু হয়। বাড়ি ফেরার পথে এই আলাপন আমাকেও বিষণ্ন করে। ভাবি, বলা উচিত ছিল—আশা আছে একটিই এবং সেটি তোমরা, দেশের নতুন প্রজন্ম।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
No comments