ভোটারের মন কে বুঝিতে পারে? by ফারুক ওয়াসিফ
দেশে
গণতন্ত্র আছে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত না, তবে ভোটাররা হারিয়ে যাননি।
তাঁরা দেখা দেওয়া শুরু করেছেন। হণ্টনক্লান্ত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক আর
মিরপুরের সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ রিকশায় বসা। দুপুর সাড়ে ১২টা। কথা বলছেন
সাংবাদিক ও কর্মীদের সঙ্গে। যেমন প্রশ্নই আসুক, হাসতে হাসতে উত্তর দিয়ে
যাচ্ছেন। বোঝা যায়, এ কাজে তিনি অভ্যস্ত ও দক্ষ। কিন্তু সেই হাসি কেড়ে নিল
তৃতীয় পক্ষের উড়ে আসা এক প্রশ্ন, ‘বছরের পর বছর ধরে পল্লবীর রাস্তা খারাপ,
এগুলা ঠিক করবেন কবে?’
উত্তরের মালিক প্রশ্নের মালিককে খুঁজে পেলেন না। প্রশ্নকারী তখনো বলে চলেছেন, ‘আপনারা ভোটের সময় ছাড়া আমাদের খোঁজ নেন কখনো?’ আওয়াজ শুনে সবাই এবার একসঙ্গে ওপরে তাকাল। রাস্তার পাশের বাড়ির দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়সী নারী। জবাবের আশায় তিনি তাকিয়ে আছেন আনিসুল হকের দিকে।
ঢাকা উত্তরে টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রার্থী হক সাহেব হঠাৎ থতমত। বললেন, ‘এর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব এমপি সাহেবের।’ এমপি সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান, কোন রাস্তার কথা কইতাছেন।’ উত্তরে ওই নারী আবারও বললেন, ‘এই যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, সেটাও তো ভালো না। পল্লবী থেকে বের হওয়ার রাস্তাটাও সাত বছর ধরে মেরামত হচ্ছে না।’ ইলিয়াস মোল্লাহ এবার হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘নির্বাচনের আগে দিয়া রাস্তার কাজ ধরুমনে।’
দোতলার নারী আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। কর্মীরা স্লোগান তুললেন, এমপি ও মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে রিকশা এগিয়ে চলল। এই রাস্তা ভাঙাচোরা হলেও পাকা। কিন্তু আমরা মোল্লা বস্তিতে ঢুকেছিলাম মোল্লা মার্কেটের পাশের যে রাস্তা দিয়ে, সেটায় খোয়া ঢালা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই পিচঢালাই হবে। এক শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কাজ শুরু হয়েছে ১৫-২০ দিন আগে। মেয়র নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকার অনেক রাস্তাই মেরামত চলছে। যে কাজ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে সিটি করপোরেশন ভুলে যাবে বলে সবার ধারণা, নির্বাচনী হাওয়ায় সরকার সেটি আগেই করে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠবেই, কার জন্য এত আয়োজন, সরকার–সমর্থিত প্রার্থীর জন্য, নাকি ভুক্তভোগী নাগরিকদের জন্য?
গত বুধবার সকাল সোয়া ১০টা। মিরপুরের পল্লবী থানা পেরিয়ে মুসলিম বাজার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ১০-১২টি গাড়ির বহর। জমায়েত সমর্থকেরা স্লোগান তুলল। আনিসুল হক উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের সাফল্যের কথা বললেন, ভোটারদের প্রভাবিত না হওয়ার অনুরোধ করে বক্তৃতা দিলেন। কেবল খেয়াল করলেন না, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি পার্কের জমির ওপর নির্মিত!
ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এক যুবক এগিয়ে এলেন। বললেন, আপনারা কি আনিসুল হকের সঙ্গে এসেছেন? সাংবাদিক পরিচয় দিলে বললেন, ‘উনি তো ভালো প্রার্থী, কিন্তু এ এলাকায় যারা ওনার ইলেকশন করতেছে, তারা তো ভালো না।’ যুবকটি নিজের পরিচয় দিলেন ওই এলাকার ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার ভাতিজা হিসেবে। এখন চাকরি করছেন। ঠিক একই কথা শুনি পল্লবীর পেছনের মোল্লা বস্তিতে।
দুপুর ১২টার দিকে বস্তির তিন ফুট চওড়া গলি দিয়ে হক ও মোল্লাহর প্রচার মিছিলের পেছন পেছন হাঁটছি। টিনের ঘরের দরজায় দাঁড়ানো এক নারী গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘গার্মেন্টস বন্ধ সেই কোরবানির টাইমে, খামু, না ভোট দিমু?’ বাচ্চা কোলে গজগজ করতে করতে তিনি চলে গেলেন বস্তির আরও ভেতরে। সরু রাস্তার সরু মিছিলের এক যুবক বললেন অন্য কথা। তাঁর বিচারে মোল্লা বস্তির বেশির ভাগ ভোট আনিসুল হকই পাবেন। মোল্লা মার্কেটের মাছের ব্যবসায়ী হামিদ পাশে পাশে হাঁটছিলেন। ‘কারে ভোট দিবেন’ জানতে চাইলে বলেন, ‘ঠিক করি নাই।’ ভোটের আগে মানুষ সত্যটা বলতে চায় না। বলে, ‘কী জানি’ কিংবা ‘আল্লায় জানে’ অথবা ‘দেখি’। অভিজ্ঞ মানুষ মাত্রই বুঝবে, এই ভাষা নিজেকে লুকানোর ভাষা। এবারে ঢাকার ভোটাররা অনেক সাবধানি। তা হলেও অনেক চাপাচাপির পর মুখ খুললেন হামিদ। তাঁর হিসাবে ওই বস্তির বেশি ভোট বিএনপির প্রার্থীর দিকেই যাবে। ভোট কে বেশি পাবেন, সেটা দেখার জন্য ২৮ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে পরিচিতি ও লোকবলে আনিসুল হকই যে এগিয়ে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
তাঁর কাছ থেকে সরে অন্য এক পুরুষকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের বস্তিতে টেবিল ঘড়ি মার্কার ভবিষ্যৎ কেমন?’ উত্তর এল, ‘আল্লায় জানে, তবে চোরের হাতে দিছে সব মাতব্বরি।’ এই সব অভিজ্ঞতা থেকে ভোলা বস্তির সামনের রাস্তায় পথসভার আগে আনিসুল হককে জিজ্ঞাসা করি, ‘কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলাকারীদের একজন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রচার করছে, এমন ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। আজ যাদের নিয়ে আপনি ঘুরলেন, এলাকায় তাদের ভাবমূর্তি বিষয়ে কি আপনি সতর্ক?’
উনি বললেন, ‘এত লোক আমার সঙ্গে ঘোরে। এদের সবার ব্যাপারে তো খোঁজ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার নজর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের দিকে। ’
প্রশ্ন: আপনি তো অনেকগুলো জরিপের ভিত্তিতে প্রচার চালাচ্ছেন, তাহলে এ ব্যাপারে কেন জরিপ করেননি?
উত্তর: আমি ঢাকার সমস্যার ওপর জরিপ করেছি, প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের কথা রেকর্ড করছে আমার লোকেরা। তবে সন্ত্রাসীদের ওপরে কোনো জরিপ করিনি।
প্রশ্ন: মুসলিম বাজারের যে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে আপনি বক্তব্য দিয়েছেন, সেই জমিটা তো পার্কের। মেয়র নির্বাচিত হলে কি আপনি মাঠঘাট-জলাশয় দখলমুক্ত করতে পারবেন? তখন কি দখলদার-সন্ত্রাসীদের আপনার পাশ থেকে সরাতে পারবেন?
উত্তর: আমার ওপর ভরসা রাখেন।
তাঁর এক পাশে তখনো মিরপুরের প্রতাপশালী সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ, অন্য পাশে যুবলীগ নেতা নিখিল। এলাকায় এই দুজনকে নিয়েই অনেক বিতর্ক আছে।
সব কাজেরই ভালো ও মন্দ দুই দিকই আছে। আনিসুল হক যে উদ্যম আর স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারও ভালো-মন্দ আছে। মুসলিম বাজার থেকে মিছিল নিয়ে আধা কিলোমিটার এগোতেই ডান দিকে পড়ল ঈদগাহ মাঠ। বাচ্চারা সেখানে ক্রিকেট খেলছিল। আনিসুল হক হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ব্যাট হাতে নিলেন। জটলা তাঁকে ঘিরে হাততালি দিতে থাকল। কেউ একজন বল করল। তিনি সপাটে ব্যাট চালালেন। বল উড়ে চলে গেল অনেক দূরে। সবাই খুব খুশি। খেলা ছেড়ে আবার তিনি মিছিল নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ কিশোর বয়সী একটি ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘বল হারাই গেছে।’
সেই মাঠের পাশেরই একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাইয়ুম। তিনি পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, ‘আনিসুল হক উপস্থাপক ছিলেন। মানুষ হিসেবে ভালো। আমার ভোট আমি তাঁরেই দিব।’ রূপনগরের কাছের এক সবজি বিক্রেতাকে টেবিল ঘড়ি মার্কার পোস্টার দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেমন করবেন এই প্রার্থী?’ হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভালো ভালো।’
মোল্লা বস্তি ও ভোলা বস্তি পেরোলে উর্দুভাষী বিহারিদের সেই কালশী বস্তি। গত বছর শবে বরাতের রাতে এক পরিবারের সাতজনসহ ১০ জন মানুষকে সেখানে পুড়িয়ে মারা হয়। অভিযোগের আঙুল ওঠে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিকে। কালশী পেরোলেই নতুন সুন্দর-শোভন বিলাসী আবাসন ডিওএইচএস। আরেক দিকে নতুন ফ্লাইওভার চলে গেছে বনানী-গুলশান ও উত্তরার দিকে। একদিকে বস্তি, ভূমি-জলা দখল, সন্ত্রাস এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কষ্টের চলাফেরা; অন্যদিকে তিলোত্তমা ঢাকা। যিনিই মেয়র নির্বাচিত হবেন, কষ্টের ঢাকাকে তিনি কি সুখের ঢাকার কাছে নিতে পারবেন? নাকি যে জীবন স্বস্তির, সামর্থ্যের, তার সঙ্গে কষ্টের জীবনের কখনো হবে নাকো দেখা? অনেক ভোটারের মনে এই প্রশ্নই আজ জাগ্রত।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
উত্তরের মালিক প্রশ্নের মালিককে খুঁজে পেলেন না। প্রশ্নকারী তখনো বলে চলেছেন, ‘আপনারা ভোটের সময় ছাড়া আমাদের খোঁজ নেন কখনো?’ আওয়াজ শুনে সবাই এবার একসঙ্গে ওপরে তাকাল। রাস্তার পাশের বাড়ির দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়সী নারী। জবাবের আশায় তিনি তাকিয়ে আছেন আনিসুল হকের দিকে।
ঢাকা উত্তরে টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রার্থী হক সাহেব হঠাৎ থতমত। বললেন, ‘এর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব এমপি সাহেবের।’ এমপি সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান, কোন রাস্তার কথা কইতাছেন।’ উত্তরে ওই নারী আবারও বললেন, ‘এই যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, সেটাও তো ভালো না। পল্লবী থেকে বের হওয়ার রাস্তাটাও সাত বছর ধরে মেরামত হচ্ছে না।’ ইলিয়াস মোল্লাহ এবার হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘নির্বাচনের আগে দিয়া রাস্তার কাজ ধরুমনে।’
দোতলার নারী আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। কর্মীরা স্লোগান তুললেন, এমপি ও মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে রিকশা এগিয়ে চলল। এই রাস্তা ভাঙাচোরা হলেও পাকা। কিন্তু আমরা মোল্লা বস্তিতে ঢুকেছিলাম মোল্লা মার্কেটের পাশের যে রাস্তা দিয়ে, সেটায় খোয়া ঢালা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই পিচঢালাই হবে। এক শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কাজ শুরু হয়েছে ১৫-২০ দিন আগে। মেয়র নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকার অনেক রাস্তাই মেরামত চলছে। যে কাজ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে সিটি করপোরেশন ভুলে যাবে বলে সবার ধারণা, নির্বাচনী হাওয়ায় সরকার সেটি আগেই করে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠবেই, কার জন্য এত আয়োজন, সরকার–সমর্থিত প্রার্থীর জন্য, নাকি ভুক্তভোগী নাগরিকদের জন্য?
গত বুধবার সকাল সোয়া ১০টা। মিরপুরের পল্লবী থানা পেরিয়ে মুসলিম বাজার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ১০-১২টি গাড়ির বহর। জমায়েত সমর্থকেরা স্লোগান তুলল। আনিসুল হক উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের সাফল্যের কথা বললেন, ভোটারদের প্রভাবিত না হওয়ার অনুরোধ করে বক্তৃতা দিলেন। কেবল খেয়াল করলেন না, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি পার্কের জমির ওপর নির্মিত!
ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এক যুবক এগিয়ে এলেন। বললেন, আপনারা কি আনিসুল হকের সঙ্গে এসেছেন? সাংবাদিক পরিচয় দিলে বললেন, ‘উনি তো ভালো প্রার্থী, কিন্তু এ এলাকায় যারা ওনার ইলেকশন করতেছে, তারা তো ভালো না।’ যুবকটি নিজের পরিচয় দিলেন ওই এলাকার ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার ভাতিজা হিসেবে। এখন চাকরি করছেন। ঠিক একই কথা শুনি পল্লবীর পেছনের মোল্লা বস্তিতে।
দুপুর ১২টার দিকে বস্তির তিন ফুট চওড়া গলি দিয়ে হক ও মোল্লাহর প্রচার মিছিলের পেছন পেছন হাঁটছি। টিনের ঘরের দরজায় দাঁড়ানো এক নারী গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘গার্মেন্টস বন্ধ সেই কোরবানির টাইমে, খামু, না ভোট দিমু?’ বাচ্চা কোলে গজগজ করতে করতে তিনি চলে গেলেন বস্তির আরও ভেতরে। সরু রাস্তার সরু মিছিলের এক যুবক বললেন অন্য কথা। তাঁর বিচারে মোল্লা বস্তির বেশির ভাগ ভোট আনিসুল হকই পাবেন। মোল্লা মার্কেটের মাছের ব্যবসায়ী হামিদ পাশে পাশে হাঁটছিলেন। ‘কারে ভোট দিবেন’ জানতে চাইলে বলেন, ‘ঠিক করি নাই।’ ভোটের আগে মানুষ সত্যটা বলতে চায় না। বলে, ‘কী জানি’ কিংবা ‘আল্লায় জানে’ অথবা ‘দেখি’। অভিজ্ঞ মানুষ মাত্রই বুঝবে, এই ভাষা নিজেকে লুকানোর ভাষা। এবারে ঢাকার ভোটাররা অনেক সাবধানি। তা হলেও অনেক চাপাচাপির পর মুখ খুললেন হামিদ। তাঁর হিসাবে ওই বস্তির বেশি ভোট বিএনপির প্রার্থীর দিকেই যাবে। ভোট কে বেশি পাবেন, সেটা দেখার জন্য ২৮ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে পরিচিতি ও লোকবলে আনিসুল হকই যে এগিয়ে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
তাঁর কাছ থেকে সরে অন্য এক পুরুষকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের বস্তিতে টেবিল ঘড়ি মার্কার ভবিষ্যৎ কেমন?’ উত্তর এল, ‘আল্লায় জানে, তবে চোরের হাতে দিছে সব মাতব্বরি।’ এই সব অভিজ্ঞতা থেকে ভোলা বস্তির সামনের রাস্তায় পথসভার আগে আনিসুল হককে জিজ্ঞাসা করি, ‘কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলাকারীদের একজন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে টেবিল ঘড়ি মার্কার প্রচার করছে, এমন ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। আজ যাদের নিয়ে আপনি ঘুরলেন, এলাকায় তাদের ভাবমূর্তি বিষয়ে কি আপনি সতর্ক?’
উনি বললেন, ‘এত লোক আমার সঙ্গে ঘোরে। এদের সবার ব্যাপারে তো খোঁজ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার নজর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের দিকে। ’
প্রশ্ন: আপনি তো অনেকগুলো জরিপের ভিত্তিতে প্রচার চালাচ্ছেন, তাহলে এ ব্যাপারে কেন জরিপ করেননি?
উত্তর: আমি ঢাকার সমস্যার ওপর জরিপ করেছি, প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের কথা রেকর্ড করছে আমার লোকেরা। তবে সন্ত্রাসীদের ওপরে কোনো জরিপ করিনি।
প্রশ্ন: মুসলিম বাজারের যে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে আপনি বক্তব্য দিয়েছেন, সেই জমিটা তো পার্কের। মেয়র নির্বাচিত হলে কি আপনি মাঠঘাট-জলাশয় দখলমুক্ত করতে পারবেন? তখন কি দখলদার-সন্ত্রাসীদের আপনার পাশ থেকে সরাতে পারবেন?
উত্তর: আমার ওপর ভরসা রাখেন।
তাঁর এক পাশে তখনো মিরপুরের প্রতাপশালী সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ, অন্য পাশে যুবলীগ নেতা নিখিল। এলাকায় এই দুজনকে নিয়েই অনেক বিতর্ক আছে।
সব কাজেরই ভালো ও মন্দ দুই দিকই আছে। আনিসুল হক যে উদ্যম আর স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারও ভালো-মন্দ আছে। মুসলিম বাজার থেকে মিছিল নিয়ে আধা কিলোমিটার এগোতেই ডান দিকে পড়ল ঈদগাহ মাঠ। বাচ্চারা সেখানে ক্রিকেট খেলছিল। আনিসুল হক হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ব্যাট হাতে নিলেন। জটলা তাঁকে ঘিরে হাততালি দিতে থাকল। কেউ একজন বল করল। তিনি সপাটে ব্যাট চালালেন। বল উড়ে চলে গেল অনেক দূরে। সবাই খুব খুশি। খেলা ছেড়ে আবার তিনি মিছিল নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ কিশোর বয়সী একটি ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘বল হারাই গেছে।’
সেই মাঠের পাশেরই একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাইয়ুম। তিনি পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, ‘আনিসুল হক উপস্থাপক ছিলেন। মানুষ হিসেবে ভালো। আমার ভোট আমি তাঁরেই দিব।’ রূপনগরের কাছের এক সবজি বিক্রেতাকে টেবিল ঘড়ি মার্কার পোস্টার দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেমন করবেন এই প্রার্থী?’ হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভালো ভালো।’
মোল্লা বস্তি ও ভোলা বস্তি পেরোলে উর্দুভাষী বিহারিদের সেই কালশী বস্তি। গত বছর শবে বরাতের রাতে এক পরিবারের সাতজনসহ ১০ জন মানুষকে সেখানে পুড়িয়ে মারা হয়। অভিযোগের আঙুল ওঠে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিকে। কালশী পেরোলেই নতুন সুন্দর-শোভন বিলাসী আবাসন ডিওএইচএস। আরেক দিকে নতুন ফ্লাইওভার চলে গেছে বনানী-গুলশান ও উত্তরার দিকে। একদিকে বস্তি, ভূমি-জলা দখল, সন্ত্রাস এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কষ্টের চলাফেরা; অন্যদিকে তিলোত্তমা ঢাকা। যিনিই মেয়র নির্বাচিত হবেন, কষ্টের ঢাকাকে তিনি কি সুখের ঢাকার কাছে নিতে পারবেন? নাকি যে জীবন স্বস্তির, সামর্থ্যের, তার সঙ্গে কষ্টের জীবনের কখনো হবে নাকো দেখা? অনেক ভোটারের মনে এই প্রশ্নই আজ জাগ্রত।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments