‘ভোটের সাথে চাওয়া–পাওয়ার সম্পর্ক নাই’ by মশিউল আলম
এলাকায় প্রচারাভিযানে আফরোজা আব্বাস |
পরনে
নরম ঘিয়ে রঙের খদ্দরের সালোয়ার-কামিজ, মাথা ও গলায় জড়ানো বর্ণিল স্কার্ফ,
চোখে আয়ত কালো ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। বৈশাখের ঝলমলে
রোদে তিনি হেঁটে চলেছেন পুরান ঢাকার বকশীবাজার, উর্দু রোড, চকবাজারের খাজে
দেওয়ান ইত্যাদি এলাকার অলিগলি, তস্য গলি। তাঁর হাতে লিফলেট, সামনে যাকে
পাচ্ছেন হাসিমুখে সালাম দিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন একটা করে লিফলেট।
সচিত্র সে লিফলেটে লেখা রয়েছে: ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫,
“আদর্শ ঢাকা আন্দোলন” মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী জননেতা মির্জা আব্বাসকে মগ
মার্কায় ভোট দিন।’
তিনি মির্জা আব্বাসের সহধর্মিণী আফরোজা আব্বাস, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চলমান প্রচারাভিযানে এক ব্যতিক্রমী প্রচার নেত্রী। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে তাঁর স্বামী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস একমাত্র মেয়র পদপ্রার্থী, যিনি আত্মগোপনে বলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে পারছেন না এবং সে কারণে তাঁর সহধর্মিণীকেই নামতে হয়েছে এই কষ্টকর ও ঝক্কিপূর্ণ কাজে।
আফরোজা আব্বাস তাঁর স্বামীর জন্য প্রচারাভিযান শুরু করেছেন ৮ এপ্রিল সকাল থেকে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তিনি হেঁটে চলেন ঢাকা দক্ষিণের পাড়া-মহল্লার অলিগলি। সিটি নির্বাচনে মেয়র পদের জন্য কোনো নারী প্রার্থী হননি, মির্জা আব্বাসের প্রতিনিধি হিসেবে আফরোজা আব্বাসই একমাত্র নারী, যাঁকে প্রায়-মেয়র পদপ্রার্থী বলে মনে হচ্ছে। কোনো কোনো সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন ‘মেয়র নির্বাচিত হলে আপনি ঢাকা দক্ষিণের জন্য কী করবেন?’
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় তাঁর জনসংযোগ মিছিলের পিছু নিই পুরান ঢাকার বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসার পাশের এক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে। এটি সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড। এর আগে তিনি সকাল নয়টা থেকে জনসংযোগ করেছেন পার্শ্ববর্তী ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে।
বকশীবাজারের ওই গলিতে দেখলাম, জনা পঞ্চাশেক কর্মী-সমর্থক রয়েছেন তাঁর সঙ্গে, শক্ত-সমর্থ কয়েকজন হাতে হাত ধরে তাঁকে ঘিরে ধরে চলেছেন, তাঁদের পিছু পিছু স্লোগান দিতে দিতে চলেছেন অন্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। তাঁদের হাতে হাতে লিফলেট, একজনের হাতে ধবধবে সাদা সোলার বোর্ডে কালো কালিতে আঁকা একটা মগের ছবি। একজন বহন করে চলেছেন পানিভর্তি একটা জেরিক্যান। প্রচণ্ড রোদে দরদর করে ঘামছেন প্রত্যেকে, ঘামে চকচক করছে তাদের কপাল। চোখে-মুখে দারুণ উত্তেজনা।
স্টিল ফটো ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরাসহ আছেন বেশ কিছুসংখ্যক সাংবাদিক। সেই ভিড়ে দেখলাম, ভিডিও ক্যামেরা হাতে বিটিভির একজন সাংবাদিকও আছেন। মির্জা আব্বাসের কর্মীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পেছন থেকে ডাকছিলেন, ‘ওই বিটিভি, ওই বিটিভি, ছবি যে নিতাছেন, প্রচার তো করবেন না!’
অবশ্য তাঁদের এই তির্যক কথাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছিল কর্মীদের স্লোগানের নিচে: ঢাকার ছেলে আব্বাস ভাই/ মগ মার্কায় ভোট চাই; ভোট চাই ভোটারের/ দোয়া চাই সকলের ইত্যাদি। গলির দুই পাশে সারি সারি দোকানের লোকজন উৎসুক চোখে তাকাচ্ছেন, কেউ কেউ হাসিমুখে হাত নাড়ছেন, মাথা দোলাচ্ছেন। আফরোজা আব্বাস কোনো কোনো দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে সালাম দিয়ে লিফলেট এগিয়ে দিচ্ছেন, দোয়া চাইছেন, তারপর হাসিমুখে বেরিয়ে এসে আবার হেঁটে চলেছেন।
উর্দু রোডের এক জায়গায় পৌঁছে তিনি ঢুকে পড়লেন বেশ চিকন একটা গলির ভেতরে, কর্মীদের সবাই সেখানে ঢুকতে পারলেন না, তাঁরা গলিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে লাগলেন। আমি কষ্ট করে গলিটির ভেতরে ঢুকে একটু এগোতেই দেখতে পেলাম একটা মন্দির। আফরোজা আব্বাস মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন, লিফলেট দিলেন, তারপর বেরিয়ে এলেন। ফুরসত পেয়ে কজন সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলেন। একজন জানতে চাইলেন, ‘প্রচার করতে নেমে আপনি কেমন সাড়া পাচ্ছেন?’ উত্তরে আফরোজা আব্বাস বললেন, ‘ভালো সাড়া পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতিদিনই মিছিলের পর তিন-চারজন কর্মীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি কোনো বাসায় ঢুকলে পরে পুলিশের লোকেরা সেই বাসায় গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। সব রকম উপায়ে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।’
সেখান থেকে বেরিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা। মিছিলের ভিড়ে প্রচণ্ড ঠেলাঠেলিতে পথচলা দায়। কর্মীরা কেন নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করছিলেন, তা আমার বোধগম্য হলো না। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এমন ধাক্কাধাক্কির কারণ কী। তিনি আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি সামনে আগায়া যান, আপার আগে আগে থাকেন। পিছে এই ঠেলাধাক্কা সামলাইতে পারবেন না।’
কিন্তু কেন এই ‘ঠেলাধাক্কা’? আমি জানতে চাইলাম, পেছন থেকে মিছিলের ওপর আক্রমণের আশঙ্কা আছে কি না?
‘কিছুই বলা যায় না।’
‘এর আগে কি সে রকম কিছু ঘটেছে? ’
‘মিছিলে অ্যাটাক করে নাই। কিন্তু যেসব নেতা-কর্মী প্রচারে একটু বেশি অ্যাকটিভ, তাদেরকে হয়রানি করা হইতেছে। রাত্রেবেলা তারা বাসায় থাকতে পারে না। তাদের বাসায় তল্লাশি করা হইতেছে। আর দ্যাখেন, মির্জা আব্বাসের পোস্টার কম। আমরা পোস্টার লাগাই, আর আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের পোস্টার ছিড়্যা ফেলে।’
বকশীবাজারের সেই কমিউনিটি সেন্টারের পাশ থেকে আসার সময় অলিগলিতে টানা দড়িতে ঝোলানো অজস্র পোস্টার দেখতে পেয়েছি, সেগুলোর অধিকাংশই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের পোস্টার। মেয়র পদপ্রার্থীদের পোস্টার চোখে পড়েছে কদাচিৎ। যেমন বিরল মির্জা আব্বাসের পোস্টার, তেমনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের পোস্টারও চোখে পড়েছে কম।
মিছিলটা সামনে এগিয়ে গেলে আমি একটু থামি। আশপাশের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারি, যেখানে যেখানে আফরোজা আব্বাস এইমাত্র তাঁর স্বামীর হয়ে লিফলেট দিয়ে গেছেন। এক বয়স্ক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভোট দিতে যাবেন?’
তিনি হেসে বললেন, ‘কত দিন পর ভোট হইতেছে, যাব না কেন?’
‘যাঁকে মেয়র পদে ভোট দেবেন, তাঁর কাছে আপনি কী চান?’
তিনি হেসে বললেন, ‘শোনেন, ভোটের সাথে চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক নাই।’
‘কিছুই চান না? তাহলে রোদের মধ্যে কষ্ট করে ভোট দিতে যাবেন কেন?’
এবার তিনি বললেন, ‘চাই তো অনেক কিছুই। কিন্তু চাইয়া তো লাভ নাই। পাবলিকের চাওয়ায় কিছু আসে যায় না।’
‘আপনার যে অনেক কিছু চাওয়ার আছে, এটা কি মির্জা আব্বাস সাহেবের ওয়াইফকে বললেন?’
‘তাই কি বলা যায়?’
এক সুযোগে আফরোজা আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি যে লোকজনের কাছে আপনার স্বামীর জন্য ভোট চাচ্ছেন, তো ভোটাররা আপনার কাছে কী চাচ্ছে?’
উত্তরে তিনি বললেন, আমার প্রশ্নটা অত্যন্ত ভালো একটা প্রশ্ন। তারপর বললেন, ‘কোনো ভোটার এ পর্যন্ত কিছু চায়নি। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি, আপনি ভোট চাচ্ছেন, তার বিনিময়ে আপনার স্বামী আমাদের জন্য কী করবেন। সবাই আমাকে বলেছেন, আমরা ভোট দিতে চাই। গুম-খুনের রাজত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা ভোট দিতে চাই। পরিবর্তনের জন্য আমরা ভোট দিতে চাই।’
মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এটা যেন নগরবাসীর সুখ-দুঃখ দেখভালকারী নির্বাচনের লড়াই নয়, আমি যেন প্রত্যক্ষ করছি জাতীয় রাজনীতির ভোটযুদ্ধ, যেখানে সরকারবিরোধী পক্ষটি মনে করছে জনগণ যে সরকারের পাশে নেই, তা দেখিয়ে দেওয়ার একটা বিকল্প সুযোগ তাদের সামনে এসে গেছে। সেই সুযোগ তারা ছাড়তে রাজি নয়, এটা বোঝা গেল আফরোজা আব্বাসের পরের কথাগুলো শুনে: ‘মির্জা আব্বাসকে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার আসামি করে, তাঁকে জামিন না দিয়ে, তাঁকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে, আমাদের ওপর হয়রানি করে, নানা পন্থায় সরকার আমাদের নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। সরকার চাচ্ছে আমরা যেন নির্বাচন বর্জন করি। কিন্তু আমরা সেটা কোনোভাবেই করব না।’
তিনি শেষের বাক্যটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা জোরে স্লোগান দিয়ে উঠলেন।
মিছিলের পেছনে ঘুরে ঘুরে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, মির্জা আব্বাস ও সাঈদ খোকনের মধ্যে ভোটযুদ্ধ সম্পর্কে ভোটারদের মনোভাব কী। সমর্থনের পাল্লা কোন দিকে ভারী। কিন্তু মাত্র ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে ও কথাবার্তা বলে সেটা অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। সমর্থনের ঢেউ বা জোয়ার বলে যে একটা কথা শোনা যায়, সেটা এখনো কোনো পক্ষেই স্পষ্ট হয়ে জেগে ওঠেনি। আফরোজা আব্বাসের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়া কিংবা সায় দিয়ে মাথা দোলানো দেখে সম্ভবত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে এই ভোটারদের সবাই মির্জা আব্বাসের মগ মার্কায় ভোট দেবেন। জানি না, সাঈদ খোকনের নির্বাচনী প্রচার মিছিলের সময়ও এই ভোটাররা একইভাবে হাসিমুখে হাত নাড়েন কি না, একইভাবে সায় দিয়ে মাথা দোলান কি না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul. alam@gmail. com
তিনি মির্জা আব্বাসের সহধর্মিণী আফরোজা আব্বাস, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চলমান প্রচারাভিযানে এক ব্যতিক্রমী প্রচার নেত্রী। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে তাঁর স্বামী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস একমাত্র মেয়র পদপ্রার্থী, যিনি আত্মগোপনে বলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে পারছেন না এবং সে কারণে তাঁর সহধর্মিণীকেই নামতে হয়েছে এই কষ্টকর ও ঝক্কিপূর্ণ কাজে।
আফরোজা আব্বাস তাঁর স্বামীর জন্য প্রচারাভিযান শুরু করেছেন ৮ এপ্রিল সকাল থেকে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তিনি হেঁটে চলেন ঢাকা দক্ষিণের পাড়া-মহল্লার অলিগলি। সিটি নির্বাচনে মেয়র পদের জন্য কোনো নারী প্রার্থী হননি, মির্জা আব্বাসের প্রতিনিধি হিসেবে আফরোজা আব্বাসই একমাত্র নারী, যাঁকে প্রায়-মেয়র পদপ্রার্থী বলে মনে হচ্ছে। কোনো কোনো সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন ‘মেয়র নির্বাচিত হলে আপনি ঢাকা দক্ষিণের জন্য কী করবেন?’
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় তাঁর জনসংযোগ মিছিলের পিছু নিই পুরান ঢাকার বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসার পাশের এক কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে। এটি সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড। এর আগে তিনি সকাল নয়টা থেকে জনসংযোগ করেছেন পার্শ্ববর্তী ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে।
বকশীবাজারের ওই গলিতে দেখলাম, জনা পঞ্চাশেক কর্মী-সমর্থক রয়েছেন তাঁর সঙ্গে, শক্ত-সমর্থ কয়েকজন হাতে হাত ধরে তাঁকে ঘিরে ধরে চলেছেন, তাঁদের পিছু পিছু স্লোগান দিতে দিতে চলেছেন অন্য নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। তাঁদের হাতে হাতে লিফলেট, একজনের হাতে ধবধবে সাদা সোলার বোর্ডে কালো কালিতে আঁকা একটা মগের ছবি। একজন বহন করে চলেছেন পানিভর্তি একটা জেরিক্যান। প্রচণ্ড রোদে দরদর করে ঘামছেন প্রত্যেকে, ঘামে চকচক করছে তাদের কপাল। চোখে-মুখে দারুণ উত্তেজনা।
স্টিল ফটো ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরাসহ আছেন বেশ কিছুসংখ্যক সাংবাদিক। সেই ভিড়ে দেখলাম, ভিডিও ক্যামেরা হাতে বিটিভির একজন সাংবাদিকও আছেন। মির্জা আব্বাসের কর্মীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পেছন থেকে ডাকছিলেন, ‘ওই বিটিভি, ওই বিটিভি, ছবি যে নিতাছেন, প্রচার তো করবেন না!’
অবশ্য তাঁদের এই তির্যক কথাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছিল কর্মীদের স্লোগানের নিচে: ঢাকার ছেলে আব্বাস ভাই/ মগ মার্কায় ভোট চাই; ভোট চাই ভোটারের/ দোয়া চাই সকলের ইত্যাদি। গলির দুই পাশে সারি সারি দোকানের লোকজন উৎসুক চোখে তাকাচ্ছেন, কেউ কেউ হাসিমুখে হাত নাড়ছেন, মাথা দোলাচ্ছেন। আফরোজা আব্বাস কোনো কোনো দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে সালাম দিয়ে লিফলেট এগিয়ে দিচ্ছেন, দোয়া চাইছেন, তারপর হাসিমুখে বেরিয়ে এসে আবার হেঁটে চলেছেন।
উর্দু রোডের এক জায়গায় পৌঁছে তিনি ঢুকে পড়লেন বেশ চিকন একটা গলির ভেতরে, কর্মীদের সবাই সেখানে ঢুকতে পারলেন না, তাঁরা গলিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে লাগলেন। আমি কষ্ট করে গলিটির ভেতরে ঢুকে একটু এগোতেই দেখতে পেলাম একটা মন্দির। আফরোজা আব্বাস মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন, লিফলেট দিলেন, তারপর বেরিয়ে এলেন। ফুরসত পেয়ে কজন সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলেন। একজন জানতে চাইলেন, ‘প্রচার করতে নেমে আপনি কেমন সাড়া পাচ্ছেন?’ উত্তরে আফরোজা আব্বাস বললেন, ‘ভালো সাড়া পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের পদে পদে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতিদিনই মিছিলের পর তিন-চারজন কর্মীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি কোনো বাসায় ঢুকলে পরে পুলিশের লোকেরা সেই বাসায় গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। সব রকম উপায়ে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।’
সেখান থেকে বেরিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা। মিছিলের ভিড়ে প্রচণ্ড ঠেলাঠেলিতে পথচলা দায়। কর্মীরা কেন নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করছিলেন, তা আমার বোধগম্য হলো না। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এমন ধাক্কাধাক্কির কারণ কী। তিনি আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি সামনে আগায়া যান, আপার আগে আগে থাকেন। পিছে এই ঠেলাধাক্কা সামলাইতে পারবেন না।’
কিন্তু কেন এই ‘ঠেলাধাক্কা’? আমি জানতে চাইলাম, পেছন থেকে মিছিলের ওপর আক্রমণের আশঙ্কা আছে কি না?
‘কিছুই বলা যায় না।’
‘এর আগে কি সে রকম কিছু ঘটেছে? ’
‘মিছিলে অ্যাটাক করে নাই। কিন্তু যেসব নেতা-কর্মী প্রচারে একটু বেশি অ্যাকটিভ, তাদেরকে হয়রানি করা হইতেছে। রাত্রেবেলা তারা বাসায় থাকতে পারে না। তাদের বাসায় তল্লাশি করা হইতেছে। আর দ্যাখেন, মির্জা আব্বাসের পোস্টার কম। আমরা পোস্টার লাগাই, আর আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের পোস্টার ছিড়্যা ফেলে।’
বকশীবাজারের সেই কমিউনিটি সেন্টারের পাশ থেকে আসার সময় অলিগলিতে টানা দড়িতে ঝোলানো অজস্র পোস্টার দেখতে পেয়েছি, সেগুলোর অধিকাংশই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের পোস্টার। মেয়র পদপ্রার্থীদের পোস্টার চোখে পড়েছে কদাচিৎ। যেমন বিরল মির্জা আব্বাসের পোস্টার, তেমনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের পোস্টারও চোখে পড়েছে কম।
মিছিলটা সামনে এগিয়ে গেলে আমি একটু থামি। আশপাশের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারি, যেখানে যেখানে আফরোজা আব্বাস এইমাত্র তাঁর স্বামীর হয়ে লিফলেট দিয়ে গেছেন। এক বয়স্ক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভোট দিতে যাবেন?’
তিনি হেসে বললেন, ‘কত দিন পর ভোট হইতেছে, যাব না কেন?’
‘যাঁকে মেয়র পদে ভোট দেবেন, তাঁর কাছে আপনি কী চান?’
তিনি হেসে বললেন, ‘শোনেন, ভোটের সাথে চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক নাই।’
‘কিছুই চান না? তাহলে রোদের মধ্যে কষ্ট করে ভোট দিতে যাবেন কেন?’
এবার তিনি বললেন, ‘চাই তো অনেক কিছুই। কিন্তু চাইয়া তো লাভ নাই। পাবলিকের চাওয়ায় কিছু আসে যায় না।’
‘আপনার যে অনেক কিছু চাওয়ার আছে, এটা কি মির্জা আব্বাস সাহেবের ওয়াইফকে বললেন?’
‘তাই কি বলা যায়?’
এক সুযোগে আফরোজা আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি যে লোকজনের কাছে আপনার স্বামীর জন্য ভোট চাচ্ছেন, তো ভোটাররা আপনার কাছে কী চাচ্ছে?’
উত্তরে তিনি বললেন, আমার প্রশ্নটা অত্যন্ত ভালো একটা প্রশ্ন। তারপর বললেন, ‘কোনো ভোটার এ পর্যন্ত কিছু চায়নি। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি, আপনি ভোট চাচ্ছেন, তার বিনিময়ে আপনার স্বামী আমাদের জন্য কী করবেন। সবাই আমাকে বলেছেন, আমরা ভোট দিতে চাই। গুম-খুনের রাজত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা ভোট দিতে চাই। পরিবর্তনের জন্য আমরা ভোট দিতে চাই।’
মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এটা যেন নগরবাসীর সুখ-দুঃখ দেখভালকারী নির্বাচনের লড়াই নয়, আমি যেন প্রত্যক্ষ করছি জাতীয় রাজনীতির ভোটযুদ্ধ, যেখানে সরকারবিরোধী পক্ষটি মনে করছে জনগণ যে সরকারের পাশে নেই, তা দেখিয়ে দেওয়ার একটা বিকল্প সুযোগ তাদের সামনে এসে গেছে। সেই সুযোগ তারা ছাড়তে রাজি নয়, এটা বোঝা গেল আফরোজা আব্বাসের পরের কথাগুলো শুনে: ‘মির্জা আব্বাসকে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার আসামি করে, তাঁকে জামিন না দিয়ে, তাঁকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে, আমাদের ওপর হয়রানি করে, নানা পন্থায় সরকার আমাদের নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। সরকার চাচ্ছে আমরা যেন নির্বাচন বর্জন করি। কিন্তু আমরা সেটা কোনোভাবেই করব না।’
তিনি শেষের বাক্যটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা জোরে স্লোগান দিয়ে উঠলেন।
মিছিলের পেছনে ঘুরে ঘুরে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, মির্জা আব্বাস ও সাঈদ খোকনের মধ্যে ভোটযুদ্ধ সম্পর্কে ভোটারদের মনোভাব কী। সমর্থনের পাল্লা কোন দিকে ভারী। কিন্তু মাত্র ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে ও কথাবার্তা বলে সেটা অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। সমর্থনের ঢেউ বা জোয়ার বলে যে একটা কথা শোনা যায়, সেটা এখনো কোনো পক্ষেই স্পষ্ট হয়ে জেগে ওঠেনি। আফরোজা আব্বাসের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়া কিংবা সায় দিয়ে মাথা দোলানো দেখে সম্ভবত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে এই ভোটারদের সবাই মির্জা আব্বাসের মগ মার্কায় ভোট দেবেন। জানি না, সাঈদ খোকনের নির্বাচনী প্রচার মিছিলের সময়ও এই ভোটাররা একইভাবে হাসিমুখে হাত নাড়েন কি না, একইভাবে সায় দিয়ে মাথা দোলান কি না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul. alam@gmail. com
No comments