চাঁপার খুনি ও দুর্বৃত্তদের রক্ষার চেষ্টা by মালেকা বেগম
বাংলাদেশে
নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঘরে এবং বাইরে নারীর সরব
পদচারণ, কৃতিত্ব, শ্রম, শিক্ষা, প্রতিভা, সাফল্য সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে,
ব্যক্তি হিসেবে নারীর পরিচয় ও মর্যাদা বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা
দিচ্ছে বাড়ির ভেতর থেকে একান্ত আত্মীয়স্বজন। আঘাত হানছে আত্মীয়-পরিজন,
বাধা দিচ্ছে সামাজিক অপসংস্কৃতি, আঘাত হানছে দুষ্কৃতকারী। বাধা দিচ্ছে
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল-রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যক্তিরা।
গত ২৪ মার্চ জাতীয় সংসদে সাংসদ হাজি সেলিম পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘নারীদের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার একটি আইন করার দাবি জানাচ্ছি। আমি চাই পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে একটি আইন হোক।’ তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ ঘোষিত হয়নি। তবে নারীকে নিপীড়ন করার পদক্ষেপ বেড়েছে নিঃসন্দেহে, অপসংস্কৃতির ধারক-বাহকদের নারীর বিরুদ্ধে নৃশংস আচরণ বেড়েছে অবধারিতভাবে। এবং সেসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যত অকার্যকর।
এর আগেই ১৫ মার্চ ঘটেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অপর উদ্যোগ। চাঁপা হত্যা (১৮ অক্টোবর, ১৯৮৯) মামলায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত (২৩ জানুয়ারি, ১৯৯৪) অন্যতম আসামি জহিরুল আলমের অবশিষ্ট সাজা (শেষ হওয়ার তারিখ ২০৩৭ সালের ১১ অক্টোবর) মওকুফ করার জন্য আসামির স্ত্রী জেসমিন জাহানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং সচিব স্বাক্ষর করেছেন এবং আইনমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন ১৯ মার্চ, ২০১৫।
খবরটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে ২৮ মার্চ, ২০১৫।
এরপর আমরা দেখলাম পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল ২০১৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতে আসা নারীদের ওপর সংগঠিত দুর্বৃত্তদের দ্বারা নৃশংস-নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি পাহারা ছিল কিন্তু দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে তারা সক্রিয় ছিল না।
এই সেই টিএসসি এলাকা, যেখানে বাঁধন ২০০০ সালের প্রাক্কালে ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত খ্রিষ্টীয় নববর্ষের অনুষ্ঠানে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রকাশ্যে। বহু আন্দোলনের পর নির্যাতনকারী ছাত্ররা সাজা পেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় সাজা থেকে মুক্তও হয়েছিল। আবারও একই ঘটনা ঘটল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই সেই ঐতিহাসিক উদ্যান, যেখানে বর্তমান সরকার স্বাধীনতার স্মারক জাদুঘর স্থাপন করেছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর জাদুঘর উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হলো এই স্বাধীনতার স্মারক জাদুঘর।’ কিন্তু উন্মুক্ত সেই উদ্যানে নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য নিঃশঙ্ক নারী-শিশু-পুরুষ যখন সপরিবারে, সবান্ধব বা একাকী বেড়াচ্ছিলেন, তখন কতিপয় দুর্বৃত্ত মেয়েদের নানাভাবে নিপীড়ন করেছে। পুলিশের নীরব-নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এবারের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় ঘটে যাওয়া অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। সেই ঘটনায়ও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। নববর্ষের অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনা প্রথমে পুলিশ স্বীকারই করতে চায়নি। তদন্ত কমিটি গঠনেও ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। পরে ছাত্রসমাজ, নারীসমাজ, শিল্পীসমাজসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের ব্যাপক প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে তারা ১৮ এপ্রিল দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। একটি কমিটি তদন্ত করবে সত্যি কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে। অন্য কমিটি তদন্ত করবে পুলিশের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় ছিল কি না, সে বিষয়ে। নারীর ওপর যে নির্যাতন হয়েছে পুলিশ তা ঠেকাতে পারেনি। এখন অপরাধীদের ধরতেও তাদের মধ্যে গাফিলতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠন ও কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তি নয়, অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত নারী নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো নীরব। ছাত্রসমাজ ও কতিপয় বিবেকবান শিক্ষক সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ আন্দোলন করছে নারীসমাজ ও শিল্পীসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এ ঘটনায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পুরুষের ভূমিকা, লেখক-বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
কলম হাতে নিয়েছিলাম চাঁপা হত্যার (১৯৮৯) অন্যতম আসামির সাজা মওকুফ করার জন্য আইন ও বিচার বিভাগের প্রস্তাবিত উদ্যোগের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। কিন্তু গত মার্চ ও এপ্রিলে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো একই বৃত্তে আবদ্ধ বলে এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বের প্রশ্নটি তোলা সংগত মনে করছি। সেই সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে চাঁপা হত্যা (ঘটনাস্থল বরিশাল) যখন ঘটেছিল, তাৎক্ষণিকভাবে বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় ও বরিশাল শাখা যৌথভাবে থানায় জিডি, মামলা করা থেকে শুরু করে বরিশালের সব স্তরের নারী-পুরুষ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। চাঁপা ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের মেধাবী ছাত্রী। বরিশালের বিএম কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকেরা চাঁপা হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও হত্যাকারীদের আইনানুগ সাজা দেওয়ার দাবিতে ১৯৮৯ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯০, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে আন্দোলন চালিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালতে চাঁপা হত্যা মামলা চলাকালীন বরিশাল জেলার নারী-ছাত্রছাত্রী-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি সারা দেশে আলোড়ন জাগিয়েছিল। ১৯৯৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বিজ্ঞ বিচারকের রায়ে চাঁপা হত্যাকাণ্ডের আসামিরা দোষী প্রমাণিত হয় এবং ৩৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। নারী হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সামাজিক নারী আন্দোলন তথা সভা, মিছিল ও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আজ আইন ও বিচার বিভাগের বেআইনি সিদ্ধান্তে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে বসেছে। এই মুহূর্তে আবারও নারীসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানান দিচ্ছে ‘অর্জিত বিজয় ধূলিসাৎ হতে দেব না।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে চাঁপা হত্যা মামলার শুরু থেকে তিন বছর সরাসরি যুক্ত ছিলাম। সেই সব আন্দোলনের তীব্রতা মনে পড়ছে আর হতাশ হচ্ছি আইন ও বিচার বিভাগ চাঁপা হত্যাকাণ্ডের আসামির সাজা মওকুফ করতে তৎপরতা চালাচ্ছে জেনে।
১৯৭২ থেকে আজ অবধি নারী নির্যাতনের ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে পূর্বাপর সরকারগুলো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার বিধান তারা নিজেরাই ভাঙছে ক্ষুদ্র ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে যথাযথ আইন থাকলেও নানা ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসে। শাস্তি হয় না।
বাংলাদেশে শিক্ষায়-পেশায়, খেলায়-রাজনীতিতে, উন্নয়নে, ক্ষমতায়নে নারীর সাফল্যে যখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেই সময় নারী নির্যাতনের উপর্যুপরি ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যে অপশক্তি নারীর শিক্ষা, অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা ঘরে-বাইরে নারীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের রুখে দিতেই হবে।
মনের হতাশা কেটে যায় যখন শুনি নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমস্বরে প্রতিবাদ জানায়। আমরা আশান্বিত হই যখন দেখি ন্যায়বিচারের দাবিতে তরুণেরা মানববন্ধন করে, থানা ঘেরাও করে, শিল্পীরা রাজপথে প্রতিবাদচিত্র অঙ্কন করে নির্যাতকদের ধিক্কার জানায়। নারীর মর্যাদা রক্ষায় পুরুষেরও দায়িত্ব আছে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে।
রোকেয়া-সুফিয়া কামালের উত্তরসূরি বাংলাদেশের নারীসমাজ কখনোই মাথা নত করবে না।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
গত ২৪ মার্চ জাতীয় সংসদে সাংসদ হাজি সেলিম পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘নারীদের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার একটি আইন করার দাবি জানাচ্ছি। আমি চাই পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে একটি আইন হোক।’ তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ ঘোষিত হয়নি। তবে নারীকে নিপীড়ন করার পদক্ষেপ বেড়েছে নিঃসন্দেহে, অপসংস্কৃতির ধারক-বাহকদের নারীর বিরুদ্ধে নৃশংস আচরণ বেড়েছে অবধারিতভাবে। এবং সেসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যত অকার্যকর।
এর আগেই ১৫ মার্চ ঘটেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অপর উদ্যোগ। চাঁপা হত্যা (১৮ অক্টোবর, ১৯৮৯) মামলায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত (২৩ জানুয়ারি, ১৯৯৪) অন্যতম আসামি জহিরুল আলমের অবশিষ্ট সাজা (শেষ হওয়ার তারিখ ২০৩৭ সালের ১১ অক্টোবর) মওকুফ করার জন্য আসামির স্ত্রী জেসমিন জাহানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপসচিব, যুগ্ম সচিব এবং সচিব স্বাক্ষর করেছেন এবং আইনমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন ১৯ মার্চ, ২০১৫।
খবরটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে ২৮ মার্চ, ২০১৫।
এরপর আমরা দেখলাম পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল ২০১৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতে আসা নারীদের ওপর সংগঠিত দুর্বৃত্তদের দ্বারা নৃশংস-নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি পাহারা ছিল কিন্তু দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে তারা সক্রিয় ছিল না।
এই সেই টিএসসি এলাকা, যেখানে বাঁধন ২০০০ সালের প্রাক্কালে ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত খ্রিষ্টীয় নববর্ষের অনুষ্ঠানে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রকাশ্যে। বহু আন্দোলনের পর নির্যাতনকারী ছাত্ররা সাজা পেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় সাজা থেকে মুক্তও হয়েছিল। আবারও একই ঘটনা ঘটল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই সেই ঐতিহাসিক উদ্যান, যেখানে বর্তমান সরকার স্বাধীনতার স্মারক জাদুঘর স্থাপন করেছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর জাদুঘর উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হলো এই স্বাধীনতার স্মারক জাদুঘর।’ কিন্তু উন্মুক্ত সেই উদ্যানে নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য নিঃশঙ্ক নারী-শিশু-পুরুষ যখন সপরিবারে, সবান্ধব বা একাকী বেড়াচ্ছিলেন, তখন কতিপয় দুর্বৃত্ত মেয়েদের নানাভাবে নিপীড়ন করেছে। পুলিশের নীরব-নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এবারের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় ঘটে যাওয়া অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। সেই ঘটনায়ও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। নববর্ষের অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনা প্রথমে পুলিশ স্বীকারই করতে চায়নি। তদন্ত কমিটি গঠনেও ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। পরে ছাত্রসমাজ, নারীসমাজ, শিল্পীসমাজসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের ব্যাপক প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে তারা ১৮ এপ্রিল দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। একটি কমিটি তদন্ত করবে সত্যি কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে। অন্য কমিটি তদন্ত করবে পুলিশের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় ছিল কি না, সে বিষয়ে। নারীর ওপর যে নির্যাতন হয়েছে পুলিশ তা ঠেকাতে পারেনি। এখন অপরাধীদের ধরতেও তাদের মধ্যে গাফিলতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠন ও কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তি নয়, অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত নারী নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো নীরব। ছাত্রসমাজ ও কতিপয় বিবেকবান শিক্ষক সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ আন্দোলন করছে নারীসমাজ ও শিল্পীসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এ ঘটনায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পুরুষের ভূমিকা, লেখক-বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
কলম হাতে নিয়েছিলাম চাঁপা হত্যার (১৯৮৯) অন্যতম আসামির সাজা মওকুফ করার জন্য আইন ও বিচার বিভাগের প্রস্তাবিত উদ্যোগের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। কিন্তু গত মার্চ ও এপ্রিলে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলো একই বৃত্তে আবদ্ধ বলে এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বের প্রশ্নটি তোলা সংগত মনে করছি। সেই সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে চাঁপা হত্যা (ঘটনাস্থল বরিশাল) যখন ঘটেছিল, তাৎক্ষণিকভাবে বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় ও বরিশাল শাখা যৌথভাবে থানায় জিডি, মামলা করা থেকে শুরু করে বরিশালের সব স্তরের নারী-পুরুষ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। চাঁপা ছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের মেধাবী ছাত্রী। বরিশালের বিএম কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকেরা চাঁপা হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও হত্যাকারীদের আইনানুগ সাজা দেওয়ার দাবিতে ১৯৮৯ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯০, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে আন্দোলন চালিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালতে চাঁপা হত্যা মামলা চলাকালীন বরিশাল জেলার নারী-ছাত্রছাত্রী-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি সারা দেশে আলোড়ন জাগিয়েছিল। ১৯৯৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বিজ্ঞ বিচারকের রায়ে চাঁপা হত্যাকাণ্ডের আসামিরা দোষী প্রমাণিত হয় এবং ৩৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। নারী হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সামাজিক নারী আন্দোলন তথা সভা, মিছিল ও আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আজ আইন ও বিচার বিভাগের বেআইনি সিদ্ধান্তে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে বসেছে। এই মুহূর্তে আবারও নারীসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানান দিচ্ছে ‘অর্জিত বিজয় ধূলিসাৎ হতে দেব না।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে চাঁপা হত্যা মামলার শুরু থেকে তিন বছর সরাসরি যুক্ত ছিলাম। সেই সব আন্দোলনের তীব্রতা মনে পড়ছে আর হতাশ হচ্ছি আইন ও বিচার বিভাগ চাঁপা হত্যাকাণ্ডের আসামির সাজা মওকুফ করতে তৎপরতা চালাচ্ছে জেনে।
১৯৭২ থেকে আজ অবধি নারী নির্যাতনের ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে পূর্বাপর সরকারগুলো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার বিধান তারা নিজেরাই ভাঙছে ক্ষুদ্র ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে যথাযথ আইন থাকলেও নানা ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসে। শাস্তি হয় না।
বাংলাদেশে শিক্ষায়-পেশায়, খেলায়-রাজনীতিতে, উন্নয়নে, ক্ষমতায়নে নারীর সাফল্যে যখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেই সময় নারী নির্যাতনের উপর্যুপরি ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যে অপশক্তি নারীর শিক্ষা, অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা ঘরে-বাইরে নারীর ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের রুখে দিতেই হবে।
মনের হতাশা কেটে যায় যখন শুনি নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমস্বরে প্রতিবাদ জানায়। আমরা আশান্বিত হই যখন দেখি ন্যায়বিচারের দাবিতে তরুণেরা মানববন্ধন করে, থানা ঘেরাও করে, শিল্পীরা রাজপথে প্রতিবাদচিত্র অঙ্কন করে নির্যাতকদের ধিক্কার জানায়। নারীর মর্যাদা রক্ষায় পুরুষেরও দায়িত্ব আছে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে।
রোকেয়া-সুফিয়া কামালের উত্তরসূরি বাংলাদেশের নারীসমাজ কখনোই মাথা নত করবে না।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
No comments