বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী -সাক্ষাৎকারে নজরুল ইসলাম খান by শরিফুজ্জামান
গত তিন মাসের মধ্যে প্রায় দেড় মাস গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবস্থান করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
৫ এপ্রিল খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে তিনি রাজধানীর
একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। দলীয় কার্যালয়ে তাঁর অবস্থানের দিনগুলো,
আন্দোলনের প্রাপ্তি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে হাসপাতালে
বসেই তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।. সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শরিফুজ্জামান
প্রথম আলো . তিন মাসের এই আন্দোলন সফল না ব্যর্থ?
নজরুল ইসলাম খান . তিন মাসের আন্দোলনে সফলতা ও ব্যর্থতা দুই-ই আছে। এই সময়ে দলটি দেশে-বিদেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পেরেছে। তা ছাড়া, এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা নিজ দলের শক্তি ও সামর্থ্য বুঝতে পেরেছি। সরকারের মনোভাব ও অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে আমি এই আন্দোলনকে ব্যর্থ বলব না।
প্রথম আলো . প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলছেন, আপনাদের এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আপনাদের মূল্যায়ন কী?
নজরুল ইসলাম খান . সফলতা বলতে তাঁরা কী বোঝান, জানি না। আমরা তো আর এখনই সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলন করিনি। দেশে-বিদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমরা সরকারের মধ্যে বড় ধরনের ভীতি লক্ষ করেছি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলে তাদের এমন ভয় থাকত না।
প্রথম আলো . প্রায় দেড় মাস বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের ভেতর কেমন ছিলেন?
নজরুল ইসলাম খান . চেয়ারপারসনসহ আমরা ৬২ জন নেতা-কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মী সেখানে থেকেছি। একটি কার্যালয়ে এত দিন ধরে এতগুলো মানুষের খাওয়া, গোসল, ঘুমানোর বিষয়টি কতটা কষ্টকর ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। ব্যাকপেইনসহ কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে চেয়ারপারসন হাসপাতালে যেতে বলেন। আরও কয়েকজন অসুস্থ হন। কিন্তু আমরা কেউই ওনাকে ফেলে যেতে চাইনি। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার উপযোগী একটি ক্যাম্প খাট জোগাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
প্রথম আলো . বাসা ছেড়ে চেয়ারপারসন ও আপনারা দলীয় কার্যালয়ে থাকতে গেলেন কেন? বাসায় থেকে কি আন্দোলন করা যেত না?
নজরুল ইসলাম খান . চেয়ারপারসন তো আর ইচ্ছা করে সেখানে থাকেননি। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, তাঁকে বের হতে দেওয়া হয়নি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে কার্যালয়ের ভেতরে রেখে ফটক আটকে দেওয়া হয়েছিল। সেই তালা যখন ভিন্ন উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়, তখন তিনি আর বের হননি। এ ছাড়া দলের নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায়ভাবে যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছিল, যেভাবে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্যই তিনি তিনটি মাস একটিমাত্র কক্ষে অবস্থান করেছিলেন।
প্রথম আলো . আপনাদের আন্দোলন চলার সময় এতগুলো নিরীহ মানুষ মারা গেল। এর দায় কি আপনাদের নয়?
নজরুল ইসলাম খান . এতগুলো মানুষের মৃত্যু দুঃখজনক। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন চলাকালে তারা মারা গেছে বলে এই দায় বিএনপির ওপর চাপানো ঠিক নয়। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অন্যায় আগ্রহ গোটা ঘটনার জন্য দায়ী। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব সহিংসতার নিন্দা ও দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তা না করে বিএনপি ও ২০ দলের নেতা-কর্মীদের আটক করে ক্রসফায়ারের নামে খুন করেছে, পায়ে গুলি করে পঙ্গু করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও একই কায়দায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, বিচারও করা হয়নি। কেন? তাহলে প্রমাণ হতো সরকারি দলের লোকজনই এসব ঘটিয়েছে।
প্রথম আলো . নাশকতার সময় বিএনপি, যুবদলের কয়েকজন নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন। দায় এড়াবেন কীভাবে?
নজরুল ইসলাম খান . সারা দেশে এতগুলো পেট্রলবোমা মারা হলো, কিন্তু হাতেনাতে বিএনপির কেউ ধরা পড়ল না। র্যাব-পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তারা যেভাবে ঘটনা সাজাতে চায়, সেভাবেই হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর থেকে পেট্রলবোমাসহ বোমা বানানোর জিনিস, বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের যেসব খবর বের হয়েছে, তার কি কোনো বিচার হয়েছে। আমরা কাউকে বোমা মারতে বলিনি, এর দায় আমরা কেন নেব?
প্রথম আলো . কিন্তু মীর নেওয়াজ আলীর বাড়ি থেকে তো পেট্রলবোমাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম খান . ওই বাড়িতে তাঁদের কেউ থাকতেন না। ওটা ছিল তাঁদের মালিকানাধীন ভাড়া বাড়ি। নিজের বাড়িতে কেউ এমন শক্তিশালী বিস্ফোরক রাখবে না। তা ছাড়া, এ ধরনের শূন্য ফ্ল্যাটে অভিযানের সময় শনাক্ত করার জন্য বাড়ির মালিক বা তাঁর প্রতিনিধি অথবা প্রতিবেশী কাউকে সঙ্গে নেওয়া হয়নি। কিন্তু টিভি ক্যামেরা ছিল। কারণ, ঘটনাটি ছিল সাজানো। এবং উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো।
প্রথম আলো . বিএনপির চেয়ারপারসন হরতাল-অবরোধ ডাকলেন। একটি বড় বিক্ষোভ-সমাবেশ করার ক্ষমতা কি দলের নেই?
নজরুল ইসলাম খান . আসলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা শান্তিপ্রিয়। বিএনপি একটি সমাবেশ করলে প্রচুর লোকসমাগম হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমাবেশেও এত মানুষ হয় না। কিন্তু বিএনপির সমাবেশে বোমা-ককটেল ফুটলে অর্ধেক সমর্থক চলে যায়, পুলিশ গুলি করলে সমাবেশ ফাঁকা হয়ে যায়। তাই বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আইনি অস্ত্রের বেআইনি প্রয়োগের মুখে দলটি মাঠ দখলে রাখার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে। বিএনপি কিংবা ২০ দলের দু–চারজন কর্মী কোথাও এক হলেই সেখানে গুলি করা হয়। এ অবস্থায় বিক্ষোভ সমাবেশ করা কঠিন হলেও আমাদের কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে, গুলি খেয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে।
প্রথম আলো . বিএনপির অবস্থান কিছুটা নমনীয় বলে মনে করেন কি? তৃতীয় পক্ষ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে গুঞ্জন আছে।
নজরুল ইসলাম খান . তৃতীয় কোনো পক্ষের এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা আমি জানি না। তবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা সবার জন্য, বিশেষ করে সরকারের জন্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এ জন্য যে ধরনের আচরণ ও যৌক্তিক কার্যক্রম থাকা দরকার, তা সরকারের ছিল না। সরকার দেরিতে হলেও এটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছে।
প্রথম আলো . তিন মাসে খালেদা জিয়া না লন্ডন থেকে তারেক রহমান আন্দোলন পরিচালনা করেছেন?
নজরুল ইসলাম খান . তারেক রহমানের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ বেশ ভালো। এমনকি আমাদের অনেক নেতার চেয়েও তিনি বেশি যোগাযোগ রাখতেন। তাই বলে তিনি বিদেশে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, এটা ঠিক নয়। বিএনপির চেয়ারপারসন সবার সঙ্গে আলোচনা করেই কর্মসূচি ঠিক করেছেন এবং আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। তারেক রহমানকে যারা ভয় পায়, তারা এসব কথা ছড়ায়।
প্রথম আলো . আন্দোলন থেকে হঠাৎ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ কী?
নজরুল ইসলাম খান . বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এই নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি তাদের দাবি, যুক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে চায়।
প্রথম আলো . তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন?
নজরুল ইসলাম খান . নির্বাচন কমিশন যে ধরনের অনুগত প্রতিষ্ঠান, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও ঢাকায় হাজি সেলিমকে বসিয়ে দিলেন, তাতে বোঝা যায়, দলটি এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যেকোনো উপায়ে তাদের জেতার চেষ্টা থাকবে। তবে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি, ভোটারদের সচেতনতা ও গণমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন হবে। তার পরও দুশ্চিন্তা হলো, এই সরকার সমালোচনার পরোয়ানা করে না। ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন করেও তারা দাবি করে যে জনগণের রায় নিয়ে তারা ক্ষমতায় আছে। এই নির্বাচনেও ভোট না পেয়ে তারা আবার জনগণের রায় পেয়েছে বলে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা তাদের জন্য বেশ বড় ঝুঁকি হবে।
প্রথম আলো . ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে একাদশ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা বা সমঝোতা কি হয়েছিল? তারানকোর উপস্থিতিতে দুই দলের মধ্যে কী কথা হয়েছিল?
নজরুল ইসলাম খান . অস্কার ফার্নান্দো তারানকোর উপস্থিতিতে দশম নির্বাচনের আলোচনা সফল হয়নি। সরকার বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন পেছানো সম্ভব নয়, যদিও সুযোগ ছিল। তবে সর্বশেষ কথা ছিল, পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত সোয়া বছরে সরকার আলোচনায় বসতে চায়নি। এমনকি ওই নির্বাচনের আগে-পরে সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীগণ শিগগিরই একাদশ নির্বাচনের কথা বললেও এখন দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে ২০১৯ সাল। সরকারি দলের এই অবস্থান পরিবর্তন জনগণকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে।
প্রথম আলো . বিএনপি মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে, সোজা কথায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে কি? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই গাঁটছড়া কি আপনাকে পীড়া দেয় না?
নজরুল ইসলাম খান . এটা করতে হলে তো আলোচনা করতে হবে। শুধু যুদ্ধাপরাধী কেন, দুর্নীতি, অনাচার রোধ, সন্ত্রাস, বেকারত্ব, কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, পরীক্ষার সময় কেউ হরতাল করতে পারবে না, যারা সরকারে থাকবে, তাদের আচরণ কেমন হবে, বিরোধীদের প্রতি সরকারের বা সরকারের প্রতি বিরোধীদের আচরণ কেমন হবে—এসব বিষয়েও আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন এই বিষয়ে একমত হওয়া যে দেশের সরকার নির্বাচিত হবে জনগণের সমর্থনে। আর এ জন্য সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি অবশ্যই মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, গণতন্ত্র হত্যাকারী, স্বৈরাচারী এবং ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য মানুষ খুনের বিপক্ষে। এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তো আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। এসব পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকল্প নেই। এ জন্য সরকার আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি না করার সুযোগ খুঁজলে তো কিছুই হবে না।
প্রথম আলো . আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম খান . ধন্যবাদ।
প্রথম আলো . তিন মাসের এই আন্দোলন সফল না ব্যর্থ?
নজরুল ইসলাম খান . তিন মাসের আন্দোলনে সফলতা ও ব্যর্থতা দুই-ই আছে। এই সময়ে দলটি দেশে-বিদেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পেরেছে। তা ছাড়া, এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা নিজ দলের শক্তি ও সামর্থ্য বুঝতে পেরেছি। সরকারের মনোভাব ও অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে আমি এই আন্দোলনকে ব্যর্থ বলব না।
প্রথম আলো . প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলছেন, আপনাদের এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আপনাদের মূল্যায়ন কী?
নজরুল ইসলাম খান . সফলতা বলতে তাঁরা কী বোঝান, জানি না। আমরা তো আর এখনই সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলন করিনি। দেশে-বিদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমরা সরকারের মধ্যে বড় ধরনের ভীতি লক্ষ করেছি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলে তাদের এমন ভয় থাকত না।
প্রথম আলো . প্রায় দেড় মাস বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের ভেতর কেমন ছিলেন?
নজরুল ইসলাম খান . চেয়ারপারসনসহ আমরা ৬২ জন নেতা-কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মী সেখানে থেকেছি। একটি কার্যালয়ে এত দিন ধরে এতগুলো মানুষের খাওয়া, গোসল, ঘুমানোর বিষয়টি কতটা কষ্টকর ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। ব্যাকপেইনসহ কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে চেয়ারপারসন হাসপাতালে যেতে বলেন। আরও কয়েকজন অসুস্থ হন। কিন্তু আমরা কেউই ওনাকে ফেলে যেতে চাইনি। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার উপযোগী একটি ক্যাম্প খাট জোগাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
প্রথম আলো . বাসা ছেড়ে চেয়ারপারসন ও আপনারা দলীয় কার্যালয়ে থাকতে গেলেন কেন? বাসায় থেকে কি আন্দোলন করা যেত না?
নজরুল ইসলাম খান . চেয়ারপারসন তো আর ইচ্ছা করে সেখানে থাকেননি। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, তাঁকে বের হতে দেওয়া হয়নি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে কার্যালয়ের ভেতরে রেখে ফটক আটকে দেওয়া হয়েছিল। সেই তালা যখন ভিন্ন উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হয়, তখন তিনি আর বের হননি। এ ছাড়া দলের নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায়ভাবে যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছিল, যেভাবে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্যই তিনি তিনটি মাস একটিমাত্র কক্ষে অবস্থান করেছিলেন।
প্রথম আলো . আপনাদের আন্দোলন চলার সময় এতগুলো নিরীহ মানুষ মারা গেল। এর দায় কি আপনাদের নয়?
নজরুল ইসলাম খান . এতগুলো মানুষের মৃত্যু দুঃখজনক। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন চলাকালে তারা মারা গেছে বলে এই দায় বিএনপির ওপর চাপানো ঠিক নয়। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অন্যায় আগ্রহ গোটা ঘটনার জন্য দায়ী। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব সহিংসতার নিন্দা ও দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তা না করে বিএনপি ও ২০ দলের নেতা-কর্মীদের আটক করে ক্রসফায়ারের নামে খুন করেছে, পায়ে গুলি করে পঙ্গু করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও একই কায়দায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, বিচারও করা হয়নি। কেন? তাহলে প্রমাণ হতো সরকারি দলের লোকজনই এসব ঘটিয়েছে।
প্রথম আলো . নাশকতার সময় বিএনপি, যুবদলের কয়েকজন নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন। দায় এড়াবেন কীভাবে?
নজরুল ইসলাম খান . সারা দেশে এতগুলো পেট্রলবোমা মারা হলো, কিন্তু হাতেনাতে বিএনপির কেউ ধরা পড়ল না। র্যাব-পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তারা যেভাবে ঘটনা সাজাতে চায়, সেভাবেই হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর থেকে পেট্রলবোমাসহ বোমা বানানোর জিনিস, বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের যেসব খবর বের হয়েছে, তার কি কোনো বিচার হয়েছে। আমরা কাউকে বোমা মারতে বলিনি, এর দায় আমরা কেন নেব?
প্রথম আলো . কিন্তু মীর নেওয়াজ আলীর বাড়ি থেকে তো পেট্রলবোমাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম খান . ওই বাড়িতে তাঁদের কেউ থাকতেন না। ওটা ছিল তাঁদের মালিকানাধীন ভাড়া বাড়ি। নিজের বাড়িতে কেউ এমন শক্তিশালী বিস্ফোরক রাখবে না। তা ছাড়া, এ ধরনের শূন্য ফ্ল্যাটে অভিযানের সময় শনাক্ত করার জন্য বাড়ির মালিক বা তাঁর প্রতিনিধি অথবা প্রতিবেশী কাউকে সঙ্গে নেওয়া হয়নি। কিন্তু টিভি ক্যামেরা ছিল। কারণ, ঘটনাটি ছিল সাজানো। এবং উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো।
প্রথম আলো . বিএনপির চেয়ারপারসন হরতাল-অবরোধ ডাকলেন। একটি বড় বিক্ষোভ-সমাবেশ করার ক্ষমতা কি দলের নেই?
নজরুল ইসলাম খান . আসলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা শান্তিপ্রিয়। বিএনপি একটি সমাবেশ করলে প্রচুর লোকসমাগম হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমাবেশেও এত মানুষ হয় না। কিন্তু বিএনপির সমাবেশে বোমা-ককটেল ফুটলে অর্ধেক সমর্থক চলে যায়, পুলিশ গুলি করলে সমাবেশ ফাঁকা হয়ে যায়। তাই বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও আইনি অস্ত্রের বেআইনি প্রয়োগের মুখে দলটি মাঠ দখলে রাখার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে। বিএনপি কিংবা ২০ দলের দু–চারজন কর্মী কোথাও এক হলেই সেখানে গুলি করা হয়। এ অবস্থায় বিক্ষোভ সমাবেশ করা কঠিন হলেও আমাদের কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে, গুলি খেয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে।
প্রথম আলো . বিএনপির অবস্থান কিছুটা নমনীয় বলে মনে করেন কি? তৃতীয় পক্ষ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে গুঞ্জন আছে।
নজরুল ইসলাম খান . তৃতীয় কোনো পক্ষের এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা আমি জানি না। তবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা সবার জন্য, বিশেষ করে সরকারের জন্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এ জন্য যে ধরনের আচরণ ও যৌক্তিক কার্যক্রম থাকা দরকার, তা সরকারের ছিল না। সরকার দেরিতে হলেও এটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছে।
প্রথম আলো . তিন মাসে খালেদা জিয়া না লন্ডন থেকে তারেক রহমান আন্দোলন পরিচালনা করেছেন?
নজরুল ইসলাম খান . তারেক রহমানের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ বেশ ভালো। এমনকি আমাদের অনেক নেতার চেয়েও তিনি বেশি যোগাযোগ রাখতেন। তাই বলে তিনি বিদেশে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, এটা ঠিক নয়। বিএনপির চেয়ারপারসন সবার সঙ্গে আলোচনা করেই কর্মসূচি ঠিক করেছেন এবং আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। তারেক রহমানকে যারা ভয় পায়, তারা এসব কথা ছড়ায়।
প্রথম আলো . আন্দোলন থেকে হঠাৎ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ কী?
নজরুল ইসলাম খান . বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এই নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি তাদের দাবি, যুক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে চায়।
প্রথম আলো . তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন?
নজরুল ইসলাম খান . নির্বাচন কমিশন যে ধরনের অনুগত প্রতিষ্ঠান, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও ঢাকায় হাজি সেলিমকে বসিয়ে দিলেন, তাতে বোঝা যায়, দলটি এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যেকোনো উপায়ে তাদের জেতার চেষ্টা থাকবে। তবে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি, ভোটারদের সচেতনতা ও গণমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন হবে। তার পরও দুশ্চিন্তা হলো, এই সরকার সমালোচনার পরোয়ানা করে না। ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন করেও তারা দাবি করে যে জনগণের রায় নিয়ে তারা ক্ষমতায় আছে। এই নির্বাচনেও ভোট না পেয়ে তারা আবার জনগণের রায় পেয়েছে বলে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা তাদের জন্য বেশ বড় ঝুঁকি হবে।
প্রথম আলো . ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে একাদশ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা বা সমঝোতা কি হয়েছিল? তারানকোর উপস্থিতিতে দুই দলের মধ্যে কী কথা হয়েছিল?
নজরুল ইসলাম খান . অস্কার ফার্নান্দো তারানকোর উপস্থিতিতে দশম নির্বাচনের আলোচনা সফল হয়নি। সরকার বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন পেছানো সম্ভব নয়, যদিও সুযোগ ছিল। তবে সর্বশেষ কথা ছিল, পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত সোয়া বছরে সরকার আলোচনায় বসতে চায়নি। এমনকি ওই নির্বাচনের আগে-পরে সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীগণ শিগগিরই একাদশ নির্বাচনের কথা বললেও এখন দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে ২০১৯ সাল। সরকারি দলের এই অবস্থান পরিবর্তন জনগণকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে।
প্রথম আলো . বিএনপি মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে, সোজা কথায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে কি? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই গাঁটছড়া কি আপনাকে পীড়া দেয় না?
নজরুল ইসলাম খান . এটা করতে হলে তো আলোচনা করতে হবে। শুধু যুদ্ধাপরাধী কেন, দুর্নীতি, অনাচার রোধ, সন্ত্রাস, বেকারত্ব, কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, পরীক্ষার সময় কেউ হরতাল করতে পারবে না, যারা সরকারে থাকবে, তাদের আচরণ কেমন হবে, বিরোধীদের প্রতি সরকারের বা সরকারের প্রতি বিরোধীদের আচরণ কেমন হবে—এসব বিষয়েও আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন এই বিষয়ে একমত হওয়া যে দেশের সরকার নির্বাচিত হবে জনগণের সমর্থনে। আর এ জন্য সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি অবশ্যই মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, গণতন্ত্র হত্যাকারী, স্বৈরাচারী এবং ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য মানুষ খুনের বিপক্ষে। এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তো আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। এসব পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকল্প নেই। এ জন্য সরকার আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি না করার সুযোগ খুঁজলে তো কিছুই হবে না।
প্রথম আলো . আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম খান . ধন্যবাদ।
No comments