খাপড়া ওয়ার্ড- এমন মৃত্যু আগে দেখিনি by সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য
সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য |
খাপড়া
ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের ৬৫তম দিবস আজ। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী
কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে সাতজন বামপন্থী রাজবন্দী শহীদ হন।
আহত হন ৩২ জন। সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য তাঁদেরই একজন। ১৯৩৩ সালে বগুড়ায়
তাঁর জন্ম। ১৯৫৫ সালের নভেম্বরে জেল থেকে তিনি মুক্তি পান এবং ১৯৬২ সাল
থেকে স্থায়ীভাবে ভারতের শিলিগুড়িতে বসবাস করেন। তিনি ছাড়া বর্বরোচিত
খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আর কেউ বেঁচে নেই। লেখাটি তিনি
সম্প্রতি লিখেছেন মতিউর রহমানের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০ গ্রন্থের
জন্য। আজ বিকেল চারটায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে গ্রন্থটির
প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আমি ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর বগুড়ায় গ্রেপ্তার হই। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি নাগাদ রাজশাহী জেলে ট্রান্সফার হই। সেই থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমি অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খাপড়া ওয়ার্ডে ছিলাম। ২৪ এপ্রিল জেল সুপার বিলের ফাইল শুরু হয়। বিল ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী। ইংরেজ আমলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করার কারণে স্বাধীনতার সময় (১৯৪৭) যেমন ব্রিটিশ-শাসিত ভারত-পাকিস্তানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ভারত বা পাকিস্তানের অপশন দেওয়ার সুযোগ ছিল, তেমনি ইংরেজ কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরও ভারত, পাকিস্তান বা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। বিল পাকিস্তানে অপশন দিয়ে থেকে যান। সেই থেকে তিনি রাজশাহী জেলে সুপারের চাকরি করতেন।
ঘটনার দিন বিল ফাইল পরিদর্শন করতে আসেন। নিয়ম ছিল, ফাইল পরিদর্শন করার সময় বন্দীরা নিজেদের বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আর সুপার তাঁর সামনে দিয়ে যেতেন, বন্দীদের কিছু বলার থাকলে সে সময় বলতে পারতেন। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দীদের মধ্যে সবাই কমিউনিস্ট ছিলেন এবং তাঁদের একটা সংগঠনও ছিল। তাঁদের নেতা ছিলেন যশোরের কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক। কমরেড হকই বন্দীদের পক্ষ থেকে তাঁদের অভিযোগের কথা সুপারকে জানাতেন। ঘটনার দিন বিল ক্ষিপ্রগতিতে হক সাহেবের কাছে যান এবং তাঁকে রাজবন্দীদের বিভিন্ন সেলে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব দেন। স্বাভাবিকভাবেই হক সাহেব এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বিলও একেবারে উল্টোমুখে রওনা হয়ে হুইসেল বাজাতে থাকেন। হুইসেল বাজালে বিপদের সংকেত বলেই মনে করা হতো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেলখানার পাগলা ঘণ্টিও বাজতে থাকে। পাগলা ঘণ্টি মানে অ্যালার্ম সিগন্যাল। বিল খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বের হতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বন্দীরা বাইরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দেন। বিল কোনোরকমে বন্দীদের সরিয়ে বাইরে চলে যান এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলি চালনার নির্দেশ দেন। ১০-১৫ মিনিট ধরে সমানে গুলিবর্ষণ হতে থাকে।
এখানে খাপড়া ওয়ার্ডের বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। এই ওয়ার্ডের এক ধারে ছিল গারদ আর অন্য তিন ধারে গারদের পরে ছিল কাঠের দরজা। হয়তো জেল পার্টির তরফ থেকে কোনো কোনো কমরেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কাঠের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার। কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী কাঠের দরজার কিছু অংশ ভেঙে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি চলতে থাকে। আমি এক দরজার পাশে এসে পড়ে যাই। হঠাৎ দেখি, আমার কোমরের কাছে কিছু নড়াচড়া করছে। আমি হাত দিয়ে সেটা সরাতেই গুলি ছুটে গেল। আর ওই জায়গা নিরাপদ নয় বুঝে আমি কিছুটা দূরে ওয়ার্ডের জল রাখার জায়গায় ছুটে যাই। আমাকে দেখেই সামনের দিকে এক পুলিশ বন্দুক তাক করে। কিন্তু জেলের ডাক্তার সম্ভবত ওয়ার্ড থেকে বের হতে পারেননি। তিনিই হাত তুলে পুলিশকে গুলি চালাতে নিষেধ করেন। তার ফলে সেদিকে আর গুলি চলেনি। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। কিছু কয়েদিও জেল ডাক্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ গুলি চলে। এরপর খাট ও ম্যাট্রেসের সাহায্যে ওয়ার্ডে ঢোকার যে দরজা রাজবন্দীরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তা খুলে যায়। তখন গুলি চালনা বন্ধ হয়।
বিল আবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। তাঁর পেছন পেছন ঢুকে পড়েন বেশ কয়েকজন কয়েদি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, জেলে কয়েদিদের খাওয়া অর্থাৎ ভাত, ডাল, সবজি কাঁধে করে বাঁশে ঝুলিয়ে আনা হতো। কাজেই সেই বাঁশ খুব শক্তপোক্ত ছিল, যা দিয়ে একই সঙ্গে মণ খানেক চালের ভাত এবং আনুপাতিক হারে সবজি ও ডাল বহন করা যেত। সেই বাঁশ দিয়ে তারা রাজবন্দীদের পেটাতে লাগল। আর বিল সোজা হক সাহেবের কাছে চলে যান এবং ব্যাটন দিয়ে তাঁকে পেটাতে থাকেন। তিনি খাটের ওপর পড়ে যান কিন্তু ব্যাটন চার্জ থামে না। একসময় হক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি বোধ হয় বেঁচে নেই। তাঁর দেহটা উঠছিল আর পড়ছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা এই পেটানোর পালা চলার পর বিল ক্লান্ত হয়ে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেরিয়ে যান। খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বিল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নারকীয় কাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটে। আহত ও নিহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্যোগই জেল কর্তৃপক্ষের ছিল না। বিকেল চারটার সময় আহত ও নিহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন পর্যন্ত দুজন অর্থাৎ কমরেড দিলওয়ার হোসেন ও কমরেড সুধীন ধর মারা গেছেন। কমরেড দিলওয়ার হোসেনকে কোনো বন্ধুই জীবিত অবস্থায় দেখেননি। অর্থাৎ তিনি গুলি চালনার সময়ই মারা যান।
কমরেড সুধীন ধর বেঁচে ছিলেন। তিনি আমাদের কাছে জল চাইলেন। আমি তাঁর পেটে গুলি লাগায় জল খেতে বারণ করি। কিন্তু তিনি বলেন, চার-পাঁচ মিনিটের বেশি তিনি বাঁচবেন না, তাই জল খাবেন। আমি তখন নিরুপায় হয়ে জল আনতে গেলাম বাইরে। তিন-চার মিনিটের বেশি দেরি হয়নি আমাদের। এসে দেখি, কমরেড সুধীন ধর মারা গেছেন। আমরা কেউই এর আগে মৃত্যুর মুখোমুখি হইনি। আমাদের একজন বললেন, মৃত মানুষের চুল টানলে চুল উঠে আসে। আমরা সুধীনদার চুল টানলাম, চুল উঠল না। নাকের কাছে হাত রাখলাম, নিশ্বাস পড়ছে না। জোর করে জল খাওয়াতে গেলাম, জল বেরিয়ে গেল। তখন মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। আমরা অবাক হলাম, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এমন নিরুদ্বেগে অপেক্ষা করা কী করে সম্ভব? কোনো আক্ষেপ নেই, আত্মীয়-পরিজনদের চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। নিশ্চুপ, এমন নিরুত্তাপ মৃত্যু এর আগে আমি দেখিনি।
যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কমরেড আনোয়ার, সুখেন ভট্টাচার্য্য কোনো কথা বলেননি। কমরেড আনোয়ারের মুখে গুলি লেগে মুখটা প্রায় উড়ে গিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। সুখেন ভট্টাচার্য্যের কোথায় গুলি লেগেছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল না। যাঁরা গুলিতে আহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কমরেড বিজন সেন, কমরেড হানিফ শেখ কথা বলছিলেন। হানিফ শেখকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাত কেটে ফেললে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি মারা যান। আর কমরেড বিজন সেনের কোথায় গুলি লেগেছিল, তা-ও বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। কেবল রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে দুটি পঙ্ক্তি, ‘কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন/ চারিদিকে তার বাঁধন কেন/ ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন/ সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন,/ লহরীর পরে লহরী তুলিয়া/ আঘাতের পরে আঘাত কর/ ...ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা আঘাতে আঘাত কর’ আওড়াচ্ছিলেন। কমরেড কম্পরাম সিংহের ঠিক কোথায় গুলি লেগেছিল, তা আমাদের জানা নেই। কমরেড নূরুন্নবীর একটা পা পরে কেটে বাদ দেওয়া হয়। আর কমরেড সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের আইনমন্ত্রী ও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি খুব বিশ্রীভাবে আহত হন। এ তো গেল গুলি চালানোর বৃত্তান্ত।
১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য দুটি পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের আলাদা পার্টি হলেও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদীভের প্রণীত রাজনৈতিক দলিলকেই আমরা গ্রহণ করেছিলাম। তাতে ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওই দলিলে বলা হয় যে গণ-আন্দোলন বা কৃষকসমাজের আন্দোলন ‘now rising up and dying down’ অর্থাৎ কোনো সময় জ্বলে উঠছে আবার কখনো নিভে যাচ্ছে। দলিলের সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ ভারতের তেলেঙ্গানার অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী আমাদের রাজশাহী জেল পার্টির মধ্যে ‘জেল-বিপ্লব’ বলে একটা তত্ত্ব চালু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, যশোরের আবদুল হক ছিলেন এর প্রবক্তা। আমাদের ধারণা ছিল, জেলের অন্য কয়েদিদের সঙ্গে নিয়ে আমরা কারাগার ভেঙে ফেলব। পরবর্তীকালে কমরেড সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ আমাদের সঙ্গে থাকেন এবং বলেন, মার্ক্সবাদের কোথাও জেল-বিপ্লবের কথা উল্লেখ নেই। এই বিতর্কের অবসান ঘটে কমরেড হকের স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি স্বীকার করেন, জেল-বিপ্লব স্বতন্ত্র কিছু নয়, এটা গণতন্ত্রের বিপ্লবের অংশ। এভাবে মীমাংসা হয়। কিন্তু জেলের কয়েদিদের মধ্যে তখন গভীর দুঃখ আর হতাশা নেমে আসে।
তখনকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল, তাতে আমাদের বিশ্বাস হয়েছিল, হয়তো এ রকম বিপ্লবের পরিস্থিতি ভারতেও সৃষ্টি হবে। আমাদের মনে স্থির বিশ্বাস এসেছিল যে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যে রাজনৈতিক চালই খাটাক না কেন, তাকে প্রতিহত করে এ উপমহাদেশের জনগণ বিপ্লবের পথকেই বেছে নেবে। সাতচল্লিশে ব্রিটিশরা চলে গেল ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে রয়ে গেল সেই বিপ্লবী চেতনা। তাই তখনো আমাদের কাজ ছিল মাঝেমধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়ানো। প্রত্যাশা ছিল, এই স্ফুলিঙ্গ দাবদাহের সৃষ্টি করবে। কিন্তু খাপড়া ওয়ার্ডের সাতটি প্রাণের বিনিময়ে কোনো দাবদাহের সৃষ্টি হলো না। তবে এতে আমাদের মোহমুক্তি ঘটল। [ঈষৎ সংক্ষেপিত]
সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য: খাপড়া ওয়ার্ডে আহত রাজবন্দী। বর্তমানে ভারতের শিলিগুড়ির অধিবাসী।
আমি ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর বগুড়ায় গ্রেপ্তার হই। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি নাগাদ রাজশাহী জেলে ট্রান্সফার হই। সেই থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমি অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খাপড়া ওয়ার্ডে ছিলাম। ২৪ এপ্রিল জেল সুপার বিলের ফাইল শুরু হয়। বিল ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী। ইংরেজ আমলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করার কারণে স্বাধীনতার সময় (১৯৪৭) যেমন ব্রিটিশ-শাসিত ভারত-পাকিস্তানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ভারত বা পাকিস্তানের অপশন দেওয়ার সুযোগ ছিল, তেমনি ইংরেজ কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরও ভারত, পাকিস্তান বা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। বিল পাকিস্তানে অপশন দিয়ে থেকে যান। সেই থেকে তিনি রাজশাহী জেলে সুপারের চাকরি করতেন।
ঘটনার দিন বিল ফাইল পরিদর্শন করতে আসেন। নিয়ম ছিল, ফাইল পরিদর্শন করার সময় বন্দীরা নিজেদের বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আর সুপার তাঁর সামনে দিয়ে যেতেন, বন্দীদের কিছু বলার থাকলে সে সময় বলতে পারতেন। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দীদের মধ্যে সবাই কমিউনিস্ট ছিলেন এবং তাঁদের একটা সংগঠনও ছিল। তাঁদের নেতা ছিলেন যশোরের কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক। কমরেড হকই বন্দীদের পক্ষ থেকে তাঁদের অভিযোগের কথা সুপারকে জানাতেন। ঘটনার দিন বিল ক্ষিপ্রগতিতে হক সাহেবের কাছে যান এবং তাঁকে রাজবন্দীদের বিভিন্ন সেলে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব দেন। স্বাভাবিকভাবেই হক সাহেব এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বিলও একেবারে উল্টোমুখে রওনা হয়ে হুইসেল বাজাতে থাকেন। হুইসেল বাজালে বিপদের সংকেত বলেই মনে করা হতো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেলখানার পাগলা ঘণ্টিও বাজতে থাকে। পাগলা ঘণ্টি মানে অ্যালার্ম সিগন্যাল। বিল খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বের হতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বন্দীরা বাইরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দেন। বিল কোনোরকমে বন্দীদের সরিয়ে বাইরে চলে যান এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলি চালনার নির্দেশ দেন। ১০-১৫ মিনিট ধরে সমানে গুলিবর্ষণ হতে থাকে।
এখানে খাপড়া ওয়ার্ডের বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। এই ওয়ার্ডের এক ধারে ছিল গারদ আর অন্য তিন ধারে গারদের পরে ছিল কাঠের দরজা। হয়তো জেল পার্টির তরফ থেকে কোনো কোনো কমরেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কাঠের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার। কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী কাঠের দরজার কিছু অংশ ভেঙে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি চলতে থাকে। আমি এক দরজার পাশে এসে পড়ে যাই। হঠাৎ দেখি, আমার কোমরের কাছে কিছু নড়াচড়া করছে। আমি হাত দিয়ে সেটা সরাতেই গুলি ছুটে গেল। আর ওই জায়গা নিরাপদ নয় বুঝে আমি কিছুটা দূরে ওয়ার্ডের জল রাখার জায়গায় ছুটে যাই। আমাকে দেখেই সামনের দিকে এক পুলিশ বন্দুক তাক করে। কিন্তু জেলের ডাক্তার সম্ভবত ওয়ার্ড থেকে বের হতে পারেননি। তিনিই হাত তুলে পুলিশকে গুলি চালাতে নিষেধ করেন। তার ফলে সেদিকে আর গুলি চলেনি। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। কিছু কয়েদিও জেল ডাক্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ গুলি চলে। এরপর খাট ও ম্যাট্রেসের সাহায্যে ওয়ার্ডে ঢোকার যে দরজা রাজবন্দীরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তা খুলে যায়। তখন গুলি চালনা বন্ধ হয়।
বিল আবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। তাঁর পেছন পেছন ঢুকে পড়েন বেশ কয়েকজন কয়েদি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, জেলে কয়েদিদের খাওয়া অর্থাৎ ভাত, ডাল, সবজি কাঁধে করে বাঁশে ঝুলিয়ে আনা হতো। কাজেই সেই বাঁশ খুব শক্তপোক্ত ছিল, যা দিয়ে একই সঙ্গে মণ খানেক চালের ভাত এবং আনুপাতিক হারে সবজি ও ডাল বহন করা যেত। সেই বাঁশ দিয়ে তারা রাজবন্দীদের পেটাতে লাগল। আর বিল সোজা হক সাহেবের কাছে চলে যান এবং ব্যাটন দিয়ে তাঁকে পেটাতে থাকেন। তিনি খাটের ওপর পড়ে যান কিন্তু ব্যাটন চার্জ থামে না। একসময় হক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি বোধ হয় বেঁচে নেই। তাঁর দেহটা উঠছিল আর পড়ছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা এই পেটানোর পালা চলার পর বিল ক্লান্ত হয়ে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বেরিয়ে যান। খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বিল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নারকীয় কাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটে। আহত ও নিহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্যোগই জেল কর্তৃপক্ষের ছিল না। বিকেল চারটার সময় আহত ও নিহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন পর্যন্ত দুজন অর্থাৎ কমরেড দিলওয়ার হোসেন ও কমরেড সুধীন ধর মারা গেছেন। কমরেড দিলওয়ার হোসেনকে কোনো বন্ধুই জীবিত অবস্থায় দেখেননি। অর্থাৎ তিনি গুলি চালনার সময়ই মারা যান।
কমরেড সুধীন ধর বেঁচে ছিলেন। তিনি আমাদের কাছে জল চাইলেন। আমি তাঁর পেটে গুলি লাগায় জল খেতে বারণ করি। কিন্তু তিনি বলেন, চার-পাঁচ মিনিটের বেশি তিনি বাঁচবেন না, তাই জল খাবেন। আমি তখন নিরুপায় হয়ে জল আনতে গেলাম বাইরে। তিন-চার মিনিটের বেশি দেরি হয়নি আমাদের। এসে দেখি, কমরেড সুধীন ধর মারা গেছেন। আমরা কেউই এর আগে মৃত্যুর মুখোমুখি হইনি। আমাদের একজন বললেন, মৃত মানুষের চুল টানলে চুল উঠে আসে। আমরা সুধীনদার চুল টানলাম, চুল উঠল না। নাকের কাছে হাত রাখলাম, নিশ্বাস পড়ছে না। জোর করে জল খাওয়াতে গেলাম, জল বেরিয়ে গেল। তখন মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। আমরা অবাক হলাম, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এমন নিরুদ্বেগে অপেক্ষা করা কী করে সম্ভব? কোনো আক্ষেপ নেই, আত্মীয়-পরিজনদের চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। নিশ্চুপ, এমন নিরুত্তাপ মৃত্যু এর আগে আমি দেখিনি।
যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কমরেড আনোয়ার, সুখেন ভট্টাচার্য্য কোনো কথা বলেননি। কমরেড আনোয়ারের মুখে গুলি লেগে মুখটা প্রায় উড়ে গিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। সুখেন ভট্টাচার্য্যের কোথায় গুলি লেগেছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল না। যাঁরা গুলিতে আহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কমরেড বিজন সেন, কমরেড হানিফ শেখ কথা বলছিলেন। হানিফ শেখকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাত কেটে ফেললে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি মারা যান। আর কমরেড বিজন সেনের কোথায় গুলি লেগেছিল, তা-ও বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। কেবল রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে দুটি পঙ্ক্তি, ‘কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন/ চারিদিকে তার বাঁধন কেন/ ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন/ সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন,/ লহরীর পরে লহরী তুলিয়া/ আঘাতের পরে আঘাত কর/ ...ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা আঘাতে আঘাত কর’ আওড়াচ্ছিলেন। কমরেড কম্পরাম সিংহের ঠিক কোথায় গুলি লেগেছিল, তা আমাদের জানা নেই। কমরেড নূরুন্নবীর একটা পা পরে কেটে বাদ দেওয়া হয়। আর কমরেড সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের আইনমন্ত্রী ও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি খুব বিশ্রীভাবে আহত হন। এ তো গেল গুলি চালানোর বৃত্তান্ত।
১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য দুটি পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের আলাদা পার্টি হলেও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদীভের প্রণীত রাজনৈতিক দলিলকেই আমরা গ্রহণ করেছিলাম। তাতে ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওই দলিলে বলা হয় যে গণ-আন্দোলন বা কৃষকসমাজের আন্দোলন ‘now rising up and dying down’ অর্থাৎ কোনো সময় জ্বলে উঠছে আবার কখনো নিভে যাচ্ছে। দলিলের সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ ভারতের তেলেঙ্গানার অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী আমাদের রাজশাহী জেল পার্টির মধ্যে ‘জেল-বিপ্লব’ বলে একটা তত্ত্ব চালু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, যশোরের আবদুল হক ছিলেন এর প্রবক্তা। আমাদের ধারণা ছিল, জেলের অন্য কয়েদিদের সঙ্গে নিয়ে আমরা কারাগার ভেঙে ফেলব। পরবর্তীকালে কমরেড সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ আমাদের সঙ্গে থাকেন এবং বলেন, মার্ক্সবাদের কোথাও জেল-বিপ্লবের কথা উল্লেখ নেই। এই বিতর্কের অবসান ঘটে কমরেড হকের স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি স্বীকার করেন, জেল-বিপ্লব স্বতন্ত্র কিছু নয়, এটা গণতন্ত্রের বিপ্লবের অংশ। এভাবে মীমাংসা হয়। কিন্তু জেলের কয়েদিদের মধ্যে তখন গভীর দুঃখ আর হতাশা নেমে আসে।
তখনকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল, তাতে আমাদের বিশ্বাস হয়েছিল, হয়তো এ রকম বিপ্লবের পরিস্থিতি ভারতেও সৃষ্টি হবে। আমাদের মনে স্থির বিশ্বাস এসেছিল যে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যে রাজনৈতিক চালই খাটাক না কেন, তাকে প্রতিহত করে এ উপমহাদেশের জনগণ বিপ্লবের পথকেই বেছে নেবে। সাতচল্লিশে ব্রিটিশরা চলে গেল ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে রয়ে গেল সেই বিপ্লবী চেতনা। তাই তখনো আমাদের কাজ ছিল মাঝেমধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়ানো। প্রত্যাশা ছিল, এই স্ফুলিঙ্গ দাবদাহের সৃষ্টি করবে। কিন্তু খাপড়া ওয়ার্ডের সাতটি প্রাণের বিনিময়ে কোনো দাবদাহের সৃষ্টি হলো না। তবে এতে আমাদের মোহমুক্তি ঘটল। [ঈষৎ সংক্ষেপিত]
সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য: খাপড়া ওয়ার্ডে আহত রাজবন্দী। বর্তমানে ভারতের শিলিগুড়ির অধিবাসী।
No comments