তরুণেরাই পারে by সালমা খান
বাঙালির
জীবনে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখের দিন উৎসবের
প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শতসহস্র আনন্দমুখর মানুষের
উপস্থিতিতে বেশ কিছু নারীকে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার যে ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু
দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ বা ব্যথিত করেনি, হতবাকও করেছে। এ দেশে নারী নির্যাতন
নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু মূলত তা ঘটে গৃহকোণে, পথেঘাটে একাকিত্বের সুযোগে বা
অনিরাপদ স্থানে। যে উৎসবের জন্য মাসব্যাপী প্রস্তুতি, দেশের বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে আহরিত ‘শুভ’ ও ‘মঙ্গলে’র প্রতীকী শিল্পকর্মের মাধ্যমে বাঙালি
মূল্যবোধ প্রকাশ করতে শত শত তরুণ নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে,
যে উৎসবের নিরাপত্তার দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি
করেছে, সেখানেও যখন নারী চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়; তখন নারী নির্যাতন
নিরসনের কৌশল সম্বন্ধে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। লিঙ্গ সম্পর্কের
ব্যাপারে তরুণদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি না হলে নারীরা নির্যাতনের
শিকার হতেই থাকবে।
এই ন্যক্কারজনক ঘটনাকে ধিক্কার দিয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সামাজিক সংগঠনসমূহ, সেই সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণসমূহ। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ স্বল্প কিছু লোক, যাঁরা আক্রান্ত নারীদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বক্তব্যে জানা যায়, ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ঢিলেঢালা ও নিষ্ক্রিয় মনোভাবের কথা। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে শতসহস্র সাধারণ মানুষ, যাদের সামনে এই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে তৎপর হয়েছিল? আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের সংস্কৃতি, মা-বোনের মর্যাদা রক্ষার মূল্যবোধ, যে প্রতিচ্ছবি আমরা কাব্যে ও সংগীতে প্রকাশ করি, ‘মায়ের ভাইয়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ,’ সেই মানুষ শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করল কেন?
এই ঘটনার সুরাহা করতে স্বভাবতই অধিকাংশ ব্যক্তি মত প্রকাশ করেছেন দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ, বিচার ও শাস্তি প্রদানের। শুধু নারী নিগ্রহ কেন, সব অন্যায়ের আইনি প্রতিকার হওয়া উচিত। এটি অবশ্যকরণীয়। কিন্তু আমরা এও জানি এই পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতন রোধে যে বিভিন্ন আইন বিদ্যমান, তার দুর্বল বাস্তবায়ন ও সীমাবদ্ধতা নারীর মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা ভাবতে পারি, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও লিঙ্গসমতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকার ও সুশীল সমাজ সংগঠনসমূহ যার যার অবস্থান থেকে একটা দীর্ঘমেয়াদি কর্মপন্থা নেবে, যেখানে একাত্তরের চেতনায় গর্বিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থাকবে। দেশের তরুণসমাজ নারী ও পুরুষকে লিঙ্গসমতায় বিশ্বাসী হতে হবে এবং সরকারকে দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে নারীর সুরক্ষায় আইনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। কর্মপরিকল্পনায় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে:
ক) বর্তমান ব্যাষ্টিক স্থিতিশীলতা ও মানবিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করতে হবে। গৃহকর্মে নারীর মজুরিবিহীন শ্রম জিডিপির ৭৬ শতাংশের বেশি (সিপিডি), যা পুরুষের মজুরি শ্রমবাজারে প্রবেশের পথ সুগম করে দিচ্ছে।
খ) অর্থনীতিতে নারীর অবদানের পরিমাপ করে পাঠ্যপুস্তকে লৈঙ্গিক ভূমিকার গুণগত উত্তরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
গ) সরকারি ও বেসরকারি খাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জার্মানিতে আইন পাস করা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি না হলে পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর বলে বিবেচিত হবে না। অনুরূপ আইন বাংলাদেশেও গ্রহণ করা যেত পারে।
ঘ) সম্প্রতি জাতিসংঘে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশে ‘হি ফর সি’ নামে প্রচারণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুরুষ ও নারী পরস্পরের সহায়ক শক্তি হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব। আমাদের দেশেও অসংখ্য পুরুষ রয়েছেন যাঁরা নারীর ক্ষমতায়নে আন্তরিক বিশ্বাসী
ও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে তাঁরা তরুণদের রোল মডেল হতে পারেন।
ঙ) আমাদের জনসংখ্যার সিংহভাগই তরুণ। তাদের চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধে দেশপ্রেম ও সম-অধিকারবোধ প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত। তবে সচেতনভাবে প্রায়ই তা বিকশিত হয় না। ভিন্নভাবে সামাজিকীকরণের কারণে কতিপয় পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসী তরুণ যাতে তাদের সাম্যবোধ ও অন্তর্নিহিত বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ না করতে পারে, এ জন্য তরুণসমাজকে তৎপর, উদ্যমী ও সংগঠিত হতে হবে। প্রকাশ্যে লিঙ্গসমতার পক্ষে সোচ্চার হতে হবে; পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীর সম-অধিকার আদায়ে সহযোদ্ধা হতে হবে। চিরকাল তরুণেরাই অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছে, এখনো তারাই প্রতিবাদী হবে। এই দেশের তরুণেরাই দৃঢ় কণ্ঠে বলবে, সময় বদলেছে, প্রেক্ষাপট বদলেছে, নারী নির্যাতনের দিন শেষ হয়েছে। সোনার বাংলাদেশ গড়তে তরুণ নারী-পুরুষ সহকর্মী ও সহযাত্রী হিসেবে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও মর্যাদাবোধ নিয়ে এগিয়ে যাবে আলোর পথে।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।
এই ন্যক্কারজনক ঘটনাকে ধিক্কার দিয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সামাজিক সংগঠনসমূহ, সেই সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণসমূহ। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ স্বল্প কিছু লোক, যাঁরা আক্রান্ত নারীদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বক্তব্যে জানা যায়, ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ঢিলেঢালা ও নিষ্ক্রিয় মনোভাবের কথা। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে শতসহস্র সাধারণ মানুষ, যাদের সামনে এই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে তৎপর হয়েছিল? আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের সংস্কৃতি, মা-বোনের মর্যাদা রক্ষার মূল্যবোধ, যে প্রতিচ্ছবি আমরা কাব্যে ও সংগীতে প্রকাশ করি, ‘মায়ের ভাইয়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ,’ সেই মানুষ শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করল কেন?
এই ঘটনার সুরাহা করতে স্বভাবতই অধিকাংশ ব্যক্তি মত প্রকাশ করেছেন দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ, বিচার ও শাস্তি প্রদানের। শুধু নারী নিগ্রহ কেন, সব অন্যায়ের আইনি প্রতিকার হওয়া উচিত। এটি অবশ্যকরণীয়। কিন্তু আমরা এও জানি এই পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতন রোধে যে বিভিন্ন আইন বিদ্যমান, তার দুর্বল বাস্তবায়ন ও সীমাবদ্ধতা নারীর মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমরা ভাবতে পারি, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও লিঙ্গসমতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকার ও সুশীল সমাজ সংগঠনসমূহ যার যার অবস্থান থেকে একটা দীর্ঘমেয়াদি কর্মপন্থা নেবে, যেখানে একাত্তরের চেতনায় গর্বিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থাকবে। দেশের তরুণসমাজ নারী ও পুরুষকে লিঙ্গসমতায় বিশ্বাসী হতে হবে এবং সরকারকে দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে নারীর সুরক্ষায় আইনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। কর্মপরিকল্পনায় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে:
ক) বর্তমান ব্যাষ্টিক স্থিতিশীলতা ও মানবিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করতে হবে। গৃহকর্মে নারীর মজুরিবিহীন শ্রম জিডিপির ৭৬ শতাংশের বেশি (সিপিডি), যা পুরুষের মজুরি শ্রমবাজারে প্রবেশের পথ সুগম করে দিচ্ছে।
খ) অর্থনীতিতে নারীর অবদানের পরিমাপ করে পাঠ্যপুস্তকে লৈঙ্গিক ভূমিকার গুণগত উত্তরণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
গ) সরকারি ও বেসরকারি খাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জার্মানিতে আইন পাস করা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি না হলে পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর বলে বিবেচিত হবে না। অনুরূপ আইন বাংলাদেশেও গ্রহণ করা যেত পারে।
ঘ) সম্প্রতি জাতিসংঘে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশে ‘হি ফর সি’ নামে প্রচারণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুরুষ ও নারী পরস্পরের সহায়ক শক্তি হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব। আমাদের দেশেও অসংখ্য পুরুষ রয়েছেন যাঁরা নারীর ক্ষমতায়নে আন্তরিক বিশ্বাসী
ও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে তাঁরা তরুণদের রোল মডেল হতে পারেন।
ঙ) আমাদের জনসংখ্যার সিংহভাগই তরুণ। তাদের চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধে দেশপ্রেম ও সম-অধিকারবোধ প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত। তবে সচেতনভাবে প্রায়ই তা বিকশিত হয় না। ভিন্নভাবে সামাজিকীকরণের কারণে কতিপয় পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসী তরুণ যাতে তাদের সাম্যবোধ ও অন্তর্নিহিত বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ না করতে পারে, এ জন্য তরুণসমাজকে তৎপর, উদ্যমী ও সংগঠিত হতে হবে। প্রকাশ্যে লিঙ্গসমতার পক্ষে সোচ্চার হতে হবে; পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীর সম-অধিকার আদায়ে সহযোদ্ধা হতে হবে। চিরকাল তরুণেরাই অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছে, এখনো তারাই প্রতিবাদী হবে। এই দেশের তরুণেরাই দৃঢ় কণ্ঠে বলবে, সময় বদলেছে, প্রেক্ষাপট বদলেছে, নারী নির্যাতনের দিন শেষ হয়েছে। সোনার বাংলাদেশ গড়তে তরুণ নারী-পুরুষ সহকর্মী ও সহযাত্রী হিসেবে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও মর্যাদাবোধ নিয়ে এগিয়ে যাবে আলোর পথে।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।
No comments