ভারতীয়-ইউরেশীয় প্লেটের ফাটলে হিমালয় বিপর্যয়
দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা সহস্রের ঘর ছুঁতে যাচ্ছে। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নেপালের কাঠমান্ডু। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৮১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এর গভীরতা ছিল ১৫ কিলোমিটার। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৯।
এই বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে হিমালয় অঞ্চলের দুটি বড় টেকটোনিক প্লেটের হঠাৎ পতন হিসেবে বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা। ভূকম্পবিদ্যা বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দু প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের পতনে এই ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূস্তরের এই দুই প্লেটের ফাটলকে বিজ্ঞানীরা প্রধান সম্মুখস্থ ফুটো (এমএফটি) হিসেবে আগেই চিহ্নিত করেছিলেন। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি গবেষকরা জানিয়েছিলেন, হিমালয়-সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। জিওফিজিক্যাল রিসার্চের এক জার্নালে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিন বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে ভূ-পদার্থবিদদের এক বার্ষিক সম্মেলনে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেন, হিমালয় ও প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আশংকা বাড়ছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ওই সম্মেলনে সারা বিশ্বের প্রায় ২০ হাজার ভূ-পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী অংশ নিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, প্রশান্ত মহাসাগর ও এশিয়ায় দুটি সিসমিক প্লেট রয়েছে। একটির নাম ইউরেশিয়া প্লেট, আরেকটি ইন্ডিয়া প্লেট। হিমালয় এ দুটি প্লেটকে আলাদা করেছে।
প্লেট দুটির মিলনস্থলের নামকরণ করা হয়েছে ক্যাসকেডিয়ান সাবডাকশন জোন। দুই প্লেটের মধ্যবর্তী অংশে হিমালয়ের অবস্থান। বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা প্লেট দুটির সংঘর্ষ এবং এর ফলে ঘটা ফাটল নিয়ে কাজ করছেন। পুরনো গবেষণায় জানা গিয়েছিল, প্লেট দুটির ঘর্ষণে সৃষ্ট ফাটলটি সংযোগস্থলের কয়েক ডিগ্রি উত্তরে অবস্থিত। তবে নতুন তথ্য অনুযায়ী, আগের চেয়ে কিছুটা দূরে এ ফাটলের অবস্থান। ইন্ডিয়া প্লেট ও ইউরেশিয়া প্লেটের সংযোগস্থলের ২-৪ ডিগ্রি উত্তরেই এ ফাটলের অবস্থান। তবে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়েছেন এ ফাটলের গভীরতা দেখে। দুটি শক্তিশালী প্লেটের এ ঘর্ষণের ফলে নিচের দিকে প্রায় ১৫ ডিগ্রি গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। দৈর্ঘ্যরে ব্যাপ্তিতে এই ক্ষতের অবস্থান নিচে প্রায় ২০ কিলোমিটারের মতো। ক্ষত তৈরি হওয়ার কারণে এরই মধ্যে প্লেট দুটি তাদের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
এ কারণে সংযোগস্থল-সংশ্লিষ্ট এলাকাজুড়ে বড় আকারের ভূকম্পনের আশংকা বাড়ছে। সপ্তদশ শতকের পর থেকে এ অঞ্চলে বড় আকারের কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানেনি। কয়েক বছর ধরেই ভূ-গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ মারাত্মক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। সিসমিক প্লেটের ঘূর্ণন সাইকেলের কারণে সব অঞ্চলেই দেড়শ বছরের নিয়মিত বিরতিতে ৮ থেকে ১০ মাত্রার ন্যূনতম একটি ভূমিকস্প আঘাত হানে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ্যায় উচ্চতর গবেষণার ছাত্র ওয়ারেন ক্যাল্ডওয়েল বলেছেন, ‘ভূমিকম্প সম্পর্কে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। কিন্তু সিসমোগ্রাফের তথ্য জানাচ্ছে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির পরিমাণ বেশ বিস্তৃত। যেহেতু, এ অঞ্চল তুলনামূলক বেশি ঘনবসতিপূর্ণ, তাই আগাম সতর্ক বার্তা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।’ এদিকে ইউএসজিএস বলছে, পৃথিবীব্যাপী মাটি খনন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূমিকম্পের আশংকা বাড়ছে। তেল গ্যাস ও সম্পদের অনুসন্ধানে ভূমি খনন ও ভূ-অভ্যন্তরে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার মতো কাজে ভূগর্ভের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্য হিন্দু, গার্ডিয়ান।
No comments