রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ by সাজেদুল হক
আপাতত রাজনীতি নেই এ কথা সত্য। তবে ৫ই জানুয়ারি পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছু নতুন সমীকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিএনপির
সঙ্গে জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনা
করা হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের জন্য বিএনপির ওপর দেশীয় এবং
আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এরই পটভূমিতে সর্বশেষ ২০শে জানুয়ারি
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরোধী জোটের সমাবেশে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট,
খেলাফত আন্দোলন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের দেখা যায়নি। যদিও
জোটভুক্ত অন্যান্য দলের নেতারা মঞ্চে ছিলেন। এ সমাবেশের পরই ১৮ দলীয় জোটে
ভাঙনের কথা ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, এখনই এ জোট ভাঙার ঘোষণা
না দিলেও কৌশলগত কারণেই জোটের ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। কারণ বিএনপি ও
জামায়াতের বুদ্ধিদাতা হিসেবে পরিচিত অনেকেই মনে করেন, বর্তমান বিশ্ব
বাস্তবতায় ইসলাম যুক্ত আছে এমন কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের
সম্ভাবনা খুবই কম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ
একেবারেই স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রতিনিয়ত খোলামেলাভাবেই কথা বলছে
বাংলাদেশ নিয়ে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ব সম্প্রদায়ের
প্রতিক্রিয়াতেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ সাবেক বাম বলয়ের
দেশগুলো এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও
বৃটেনসহ অনেক দেশ সরকারকে অভিনন্দিত না করলেও সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে
যাওয়ার কথা জানিয়েছে। যদিও এসব দেশ সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের জন্য
সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি
পার্লামেন্টে সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এসব আলোচনায়
সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী
তোফায়েল আহমেদ এরই মধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ
করবে। কোন সংলাপও হবে না।
এ অবস্থায় নিজেদের রাজনীতি রিভিউ করছে বিরোধী জোট। জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন পরিবর্তন নিয়ে চলছে আলোচনা। মূলত ভোটের পাটিগণিতের হিসাবেই ১৯৯৯ সালের ৩০শে নভেম্বর চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে এ জোট গঠিত হয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি পরে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ জোটে থেকে যায়। ২০০১ সালে এ জোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটের ভরাডুবি ঘটে। এর পরও এ জোটে আরও কয়েকটি দলকে নিয়ে গঠন করা হয় ১৮ দলীয় জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনও করে জোটবদ্ধভাবে। এ আন্দোলনের দাবির যৌক্তিকতা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো স্বীকার করলেও আন্দোলনে সহিংসতারও সমান তালে নিন্দা জানান তারা। মিডিয়া এবং পর্যবেক্ষকদের অনেকে এ সহিংসতার জন্য জামায়াতকেই দায়ী করেন। যদিও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার এ জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, গণ-আন্দোলন অহিংস নাকি সহিংস হবে তার ট্রিগার সব সময়ই সরকারেরই হাতে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধ সহিংস বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে দমন এবং তার পালটা প্রতিক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের সরকারি আচরণ থেকেই এখনকার সহিংসতার জন্ম। এ পরিস্থিতিতে একতরফা গণ-আন্দোলনের ধরন বিশেষত সহিংসতাকে নিন্দা করার একটাই অর্থ : ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো, সাফাই গাওয়া। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের প্রস্তাবেও সহিংসতায় জড়িত সংগঠন নিষিদ্ধের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। যদিও ওই প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক আগাম নির্বাচন। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদের জামায়াত এবং হেফাজতকে একসঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা কৌতূহল উদ্দীপক যে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে জামায়াত-হেফাজতকে একই কাতারে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হেফাজত কোন ধরনের সহিংসতায় জড়িত থাকার কথা আমি শুনিনি এবং বিরোধী দলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার কথাও শোনা যায়নি। কিছু আদর্শগত মিল থাকা সত্ত্বেও জামায়াত ও হেফাজত রাজনৈতিক মিত্র নয়। তাদের একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়তো ইউরোপীয় পার্লামেন্টের তথ্যগত ভুল।
নির্বাচন পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংলাপের পূর্ব-শর্ত হিসেবে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের কথা বলেছেন। অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ককে বর্ণনা করেছেন, কৌশলগত হিসেবে। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সম্পর্ক নিয়ে চলছে নতুন পর্যালোচনা। জামায়াতের পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত একজন সাবেক সচিবের মতে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণই হবে। যদিও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিএনপি সবসময়ই একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া জামায়াতের প্রায় সব শীর্ষ নেতাই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত। এ অবস্থায় জোটের বাইরে যুগপৎ আন্দোলনই বিএনপির জন্য সুফল বয়ে আনবে। যদিও ইসলামপন্থীদের ভোট ব্যাংকের বিষয়টিও বিএনপিকে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।
No comments