রাষ্ট্র ও রাজনীতি- বিএনপির ঘাড়ে সিন্দবাদের বুড়ো by আবদুল মান্নান
আরব্য রজনীর গল্পে আছে, সিন্দবাদ সাতটি সমুদ্রযাত্রা করেছিল। প্রতিটি যাত্রায় তার যত সব রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। সিন্দবাদের পঞ্চম যাত্রার গল্পে আছে, তার কাঁধে এক বুড়ো সওয়ার হয়েছিল।
বুড়ো আবার কাঁধে এমন প্যাঁচ কষে বসেছিল যে সিন্দবাদ বস্তুতপক্ষে বুড়োর ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। শেষে সিন্দবাদ বিশেষ সুরা তৈরি করে বুড়োকে পান করিয়ে তাকে হত্যা করে। সিন্দবাদ তো বুড়ো থেকে নিস্তার পেতে একটা উপায় বের করেছিল। কারণ, সে বুড়োর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিএনপির ঘাড়ে জামায়াত নামের যে বুড়ো বা দৈত্যটি গেড়ে বসেছে, সবার প্রশ্ন, তার কী হবে? কারণ, বিএনপি নামের সিন্দবাদ তো এই দৈত্যটিকে বধ করতে নারাজ।
বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক অনেকটা দুজন দুজনার মতো। অবশ্য এর আগে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের পেটের দুই ভাই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাম্প্রতিক কালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে রাজনৈতিক বিপর্যয়, তার প্রধান কারণ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আর দেশ ও সম্পদ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যা দেড় বছর ধরে চলে আসছে। আন্দোলনের নামে তাদের মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো ভয়ানক অমানবিক কর্মকাণ্ড বিএনপির অনেক গোঁড়া সমর্থককেও বিএনপিবিমুখ করেছে।
কদিন আগে দায়িত্বশীল বিএনপি ঘরানার এক সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, জামায়াতের খপ্পরে পড়ে বিএনপি নিজের পাকা ধানে মই দিয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেকে তাদের ধারণা দিয়েছিল, নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো করবে, এমনকি হয়তো সরকারও গঠন করতে পারে। কিন্তু জামায়াত নির্বাচনে যাওয়া থেকে বিএনপিকে বিরত রাখতে পেরেছে। কারণ, বিএনপির ‘আন্দোলন’ আর জামায়াতের ‘আন্দোলন’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বিএনপি চাইছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আর জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো উপায়ে মহাজোট সরকারকে উৎখাত করে বিএনপির সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করা। এই দুটি দলই আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অনেক অক্ষমতা আর দুর্বলতা আছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের এখনো একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে আর আছেন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা। অনেকেই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপির তেমন রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই। তারা বুঝতে পারে না, সাধারণ মানুষ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। লক্ষ করলে, বেগম জিয়ার চারপাশে, যাঁরা তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকেন, তাঁরা প্রায় সবাই সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা। তাঁরা গুলশানের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের আলো-আঁধারে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিএনপির এই নেতারা মিডিয়ার সামনে এলে, আধো ইংরেজি আধো বাংলায়, যা জনমানুষের কাছে দুর্ভেদ্য, তেমন ভাষায় কথা বলেন। আর সরকার অফেন্সিভে গেলে আত্মগোপন করেন। নির্বাচনের আগে তাঁরা ভিডিওবার্তার সাহায্যে আন্দোলন পরিচালনা করার নতুন সংস্কৃতি চালু করেছেন। শুধু দেশের ভেতর থেকেই আন্দোলনের এমন আহ্বান আসছে, তা-ই নয়, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকেও আন্দোলনের এমন বার্তা পাঠাচ্ছেন। যে রাজনৈতিক দল এমন নেতাদের ওপর ভর করে সরকারবিরোধী রাজনীতি করতে চায়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সমালোচকেরা তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন, কিন্তু তারা যে একটি সন্ত্রাসী দল, তেমন অভিযোগ একটাও নেই। মিছিল করে যাওয়ার সময় তারা দু-চারটি গাড়িতে আগুন দেয়, পুলিশের সঙ্গে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হয় অথবা কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছাত্রশিবিরের মতো বলা যাবে না তারা গণহারে প্রতিপক্ষের রগ কাটে, গলা কেটে মানুষ হত্যা করে অথবা নির্বিচারে সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি বা গ্রামে আগুন দেয়।
এযাবৎ ছাত্রশিবির যত সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল ছাত্রদলের সঙ্গে। আমার আগের কর্মক্ষেত্রে জিয়া পরিষদের সভাপতি ড. এনামুল হকের ছেলে মুসাকে তো ওরা পিটিয়েই মেরে ফেলেছিল। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আবদুল হামিদ ছাত্রদল ছেড়ে এরশাদের ছাত্রসমাজে যোগ দিয়েছিল। তাঁর হাতের কবজি কেটে কিরিচের মাথায় গেঁথে শিবির ভরদুপুরে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছিল। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি শিবিরের রাজনীতির একজন বড় বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। ড. কাজী আহম্মদ নবী মনেপ্রাণে জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর একমাত্র ছেলে মুসফিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে নতুন দীক্ষা নিয়েছেন। এক গুলিতেই তাঁকে শেষ করে দিল শিবিরের সন্ত্রাসীরা। হেলালি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছাত্রদলের নেতা। তাঁকে ১০ জনে টেবিলের ওপর চেপে ধরে চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সময়মতো শিক্ষকেরা সেখানে হাজির না হলে হেলালি এখন অন্ধ হয়ে হয়তো বেঁচে থাকতেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করেছেন। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন শিবির ছাত্রদলের ওপর হামলা করে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তখন ক্ষমতায় বেগম জিয়া। তিনি কিন্তু তাঁর দলের আহত সদস্যদের একবারও দেখতে যাননি, গিয়েছিলেন সে সময়কার সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেত্রীর মধ্যে এটাই তফাত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেগম জিয়ার অনেক সমর্থক আর উপদেষ্টা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি শক্তিশালী দেশের এক কূটনীতিককে বাংলাদেশে তাঁদের রাজনৈতিক চালের বিপর্যয়ের কারণে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ২০০৬ সালেও ঠিক তেমনটি ঘটেছিল। বিদেশিরা এখন বলছে, বেগম জিয়াকে জামায়াতের সংস্পর্শ ছাড়তে হবে। এত দিনে তারা উপলব্ধি করেছে, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এই দেশগুলোই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল, ‘জামায়াত একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল’। কিন্তু তারা বললেই তো আর বেগম জিয়া বা বিএনপি জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না। অদৃশ্য কারণে বিএনপির রাজনীতি জামায়াতের কাছে বাঁধা রয়েছে বলে বিশ্বাস।
সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনসভা করল। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, এটি ১৮ দলের জনসভা। পরে জানা গেল, এটি বিএনপির জনসভা। জামায়াতকে নাকি সভায় আসতে নিষেধও করা হয়েছিল। জামায়াত এসেছিল, কিন্তু ব্যানার ছাড়া। সঙ্গে ছিলেন হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। মঞ্চেও জামায়াতের নেতারা ছাড়া শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামেও অনুরূপ একটি সমাবেশ হয়েছিল এবং সেখানে মঞ্চে জামায়াতের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মঞ্চে জামায়াতকে দেখে আর মঞ্চে ওঠেননি। নিচে বসে তাঁর ছাত্রদের বলেছেন, এখনো যদি বিএনপির বোধোদয় না হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যতে ভালো তো কিছু দেখি না।
বেগম জিয়ার সব উপদেষ্টা হিসেবে সামরিক-বেসামরিক আমলা ছাড়াও আছেন বেশ কিছু আইনজীবী নতুবা বাস্তব জীবন-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু বুদ্ধিজীবী আর সুশীল ব্যক্তি। একজন আইনজীবী সেদিন জানান, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে শতভাগ লাভ বিএনপির। কারণ, জামায়াতের সবাই কাতারবন্দী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেবে। এই না হলে উপদেষ্টা। তিনি বুঝতে পারেননি অথবা বুঝতে চাননি, জামায়াত হচ্ছে একটি ভাইরাস। দেহে প্রবেশ করলে দেহটাকে ধ্বংস করে দেবে। জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়, তাহলে বিএনপিও যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
কোনো কোনো বিএনপি-সমর্থক পেশাজীবী বিএনপিকে বাহবা দিচ্ছেন এই বলে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাকি মানুষ ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে যাননি। তাঁরাও বিএনপির ৫ শতাংশ ভোট-তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ৫ জানুয়ারি অনেক কেন্দ্রে ভোট কম পড়েছে সত্য, কিন্তু তা স্রেফ বেগম জিয়া বা বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘটেছে, তা বিশ্বাস করা চরম আহাম্মকি। যে মাত্রায় সহিংসতা নির্বাচনের আগের কয়েক দিন হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে মানুষ ভোট দিতে যাবে, তা তো আশা করা যায় না। বেগম জিয়ার এসব সর্বনাশা সমর্থক গোষ্ঠী তাঁকে মনে করিয়ে দেয়নি, নির্বাচনের আগের রাতে যদি ২০০ স্কুল, মাদ্রাসা আর কলেজ ভোটকেন্দ্র হওয়ার ‘অপরাধে’ জামায়াত-বিএনপির দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে সেসব কেন্দ্রে কোন ভরসায় ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন? ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। নির্দয়ভাবে এখান থেকে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট ছাঁটাই করলেও আওয়ামী লীগের একেবারে ‘দলকানা’ ভোটার ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ। নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা সারা দেশে এই ভয়াবহ তাণ্ডব না চালালে আওয়ামী লীগ কমপক্ষে এই ভোটগুলো তো পেত।
যদি নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ৪০ শতাংশ হিসাব বিশ্বাস না করেন, তাই বলে ৫ শতাংশ বিশ্বাস করতে হবে কেন? বিএনপির কাঁধ থেকে জামায়াত নামের সিন্দবাদের সেই দৈত্য বা বুড়োটাকে তারা নামাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এককভাবে তাদের। কিন্তু দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশে একাধিক সুস্থধারার রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। তেমনই একটি দল হিসেবে বিএনপি নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছরের আগে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা তাদের নেই। আওয়ামী লীগ অন্য চিন্তা করলে ভিন্ন কথা। বাস্তববাদী হওয়া মঙ্গল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক অনেকটা দুজন দুজনার মতো। অবশ্য এর আগে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের পেটের দুই ভাই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাম্প্রতিক কালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে রাজনৈতিক বিপর্যয়, তার প্রধান কারণ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আর দেশ ও সম্পদ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যা দেড় বছর ধরে চলে আসছে। আন্দোলনের নামে তাদের মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো ভয়ানক অমানবিক কর্মকাণ্ড বিএনপির অনেক গোঁড়া সমর্থককেও বিএনপিবিমুখ করেছে।
কদিন আগে দায়িত্বশীল বিএনপি ঘরানার এক সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, জামায়াতের খপ্পরে পড়ে বিএনপি নিজের পাকা ধানে মই দিয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেকে তাদের ধারণা দিয়েছিল, নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো করবে, এমনকি হয়তো সরকারও গঠন করতে পারে। কিন্তু জামায়াত নির্বাচনে যাওয়া থেকে বিএনপিকে বিরত রাখতে পেরেছে। কারণ, বিএনপির ‘আন্দোলন’ আর জামায়াতের ‘আন্দোলন’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বিএনপি চাইছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আর জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো উপায়ে মহাজোট সরকারকে উৎখাত করে বিএনপির সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করা। এই দুটি দলই আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অনেক অক্ষমতা আর দুর্বলতা আছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের এখনো একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে আর আছেন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা। অনেকেই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপির তেমন রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই। তারা বুঝতে পারে না, সাধারণ মানুষ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। লক্ষ করলে, বেগম জিয়ার চারপাশে, যাঁরা তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকেন, তাঁরা প্রায় সবাই সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা। তাঁরা গুলশানের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের আলো-আঁধারে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিএনপির এই নেতারা মিডিয়ার সামনে এলে, আধো ইংরেজি আধো বাংলায়, যা জনমানুষের কাছে দুর্ভেদ্য, তেমন ভাষায় কথা বলেন। আর সরকার অফেন্সিভে গেলে আত্মগোপন করেন। নির্বাচনের আগে তাঁরা ভিডিওবার্তার সাহায্যে আন্দোলন পরিচালনা করার নতুন সংস্কৃতি চালু করেছেন। শুধু দেশের ভেতর থেকেই আন্দোলনের এমন আহ্বান আসছে, তা-ই নয়, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকেও আন্দোলনের এমন বার্তা পাঠাচ্ছেন। যে রাজনৈতিক দল এমন নেতাদের ওপর ভর করে সরকারবিরোধী রাজনীতি করতে চায়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সমালোচকেরা তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন, কিন্তু তারা যে একটি সন্ত্রাসী দল, তেমন অভিযোগ একটাও নেই। মিছিল করে যাওয়ার সময় তারা দু-চারটি গাড়িতে আগুন দেয়, পুলিশের সঙ্গে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হয় অথবা কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছাত্রশিবিরের মতো বলা যাবে না তারা গণহারে প্রতিপক্ষের রগ কাটে, গলা কেটে মানুষ হত্যা করে অথবা নির্বিচারে সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি বা গ্রামে আগুন দেয়।
এযাবৎ ছাত্রশিবির যত সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল ছাত্রদলের সঙ্গে। আমার আগের কর্মক্ষেত্রে জিয়া পরিষদের সভাপতি ড. এনামুল হকের ছেলে মুসাকে তো ওরা পিটিয়েই মেরে ফেলেছিল। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আবদুল হামিদ ছাত্রদল ছেড়ে এরশাদের ছাত্রসমাজে যোগ দিয়েছিল। তাঁর হাতের কবজি কেটে কিরিচের মাথায় গেঁথে শিবির ভরদুপুরে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছিল। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি শিবিরের রাজনীতির একজন বড় বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। ড. কাজী আহম্মদ নবী মনেপ্রাণে জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর একমাত্র ছেলে মুসফিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে নতুন দীক্ষা নিয়েছেন। এক গুলিতেই তাঁকে শেষ করে দিল শিবিরের সন্ত্রাসীরা। হেলালি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছাত্রদলের নেতা। তাঁকে ১০ জনে টেবিলের ওপর চেপে ধরে চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সময়মতো শিক্ষকেরা সেখানে হাজির না হলে হেলালি এখন অন্ধ হয়ে হয়তো বেঁচে থাকতেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করেছেন। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন শিবির ছাত্রদলের ওপর হামলা করে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তখন ক্ষমতায় বেগম জিয়া। তিনি কিন্তু তাঁর দলের আহত সদস্যদের একবারও দেখতে যাননি, গিয়েছিলেন সে সময়কার সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেত্রীর মধ্যে এটাই তফাত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেগম জিয়ার অনেক সমর্থক আর উপদেষ্টা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি শক্তিশালী দেশের এক কূটনীতিককে বাংলাদেশে তাঁদের রাজনৈতিক চালের বিপর্যয়ের কারণে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ২০০৬ সালেও ঠিক তেমনটি ঘটেছিল। বিদেশিরা এখন বলছে, বেগম জিয়াকে জামায়াতের সংস্পর্শ ছাড়তে হবে। এত দিনে তারা উপলব্ধি করেছে, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এই দেশগুলোই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল, ‘জামায়াত একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল’। কিন্তু তারা বললেই তো আর বেগম জিয়া বা বিএনপি জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না। অদৃশ্য কারণে বিএনপির রাজনীতি জামায়াতের কাছে বাঁধা রয়েছে বলে বিশ্বাস।
সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনসভা করল। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, এটি ১৮ দলের জনসভা। পরে জানা গেল, এটি বিএনপির জনসভা। জামায়াতকে নাকি সভায় আসতে নিষেধও করা হয়েছিল। জামায়াত এসেছিল, কিন্তু ব্যানার ছাড়া। সঙ্গে ছিলেন হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। মঞ্চেও জামায়াতের নেতারা ছাড়া শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামেও অনুরূপ একটি সমাবেশ হয়েছিল এবং সেখানে মঞ্চে জামায়াতের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মঞ্চে জামায়াতকে দেখে আর মঞ্চে ওঠেননি। নিচে বসে তাঁর ছাত্রদের বলেছেন, এখনো যদি বিএনপির বোধোদয় না হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যতে ভালো তো কিছু দেখি না।
বেগম জিয়ার সব উপদেষ্টা হিসেবে সামরিক-বেসামরিক আমলা ছাড়াও আছেন বেশ কিছু আইনজীবী নতুবা বাস্তব জীবন-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু বুদ্ধিজীবী আর সুশীল ব্যক্তি। একজন আইনজীবী সেদিন জানান, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে শতভাগ লাভ বিএনপির। কারণ, জামায়াতের সবাই কাতারবন্দী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেবে। এই না হলে উপদেষ্টা। তিনি বুঝতে পারেননি অথবা বুঝতে চাননি, জামায়াত হচ্ছে একটি ভাইরাস। দেহে প্রবেশ করলে দেহটাকে ধ্বংস করে দেবে। জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়, তাহলে বিএনপিও যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
কোনো কোনো বিএনপি-সমর্থক পেশাজীবী বিএনপিকে বাহবা দিচ্ছেন এই বলে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাকি মানুষ ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে যাননি। তাঁরাও বিএনপির ৫ শতাংশ ভোট-তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ৫ জানুয়ারি অনেক কেন্দ্রে ভোট কম পড়েছে সত্য, কিন্তু তা স্রেফ বেগম জিয়া বা বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘটেছে, তা বিশ্বাস করা চরম আহাম্মকি। যে মাত্রায় সহিংসতা নির্বাচনের আগের কয়েক দিন হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে মানুষ ভোট দিতে যাবে, তা তো আশা করা যায় না। বেগম জিয়ার এসব সর্বনাশা সমর্থক গোষ্ঠী তাঁকে মনে করিয়ে দেয়নি, নির্বাচনের আগের রাতে যদি ২০০ স্কুল, মাদ্রাসা আর কলেজ ভোটকেন্দ্র হওয়ার ‘অপরাধে’ জামায়াত-বিএনপির দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে সেসব কেন্দ্রে কোন ভরসায় ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন? ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। নির্দয়ভাবে এখান থেকে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট ছাঁটাই করলেও আওয়ামী লীগের একেবারে ‘দলকানা’ ভোটার ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ। নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা সারা দেশে এই ভয়াবহ তাণ্ডব না চালালে আওয়ামী লীগ কমপক্ষে এই ভোটগুলো তো পেত।
যদি নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ৪০ শতাংশ হিসাব বিশ্বাস না করেন, তাই বলে ৫ শতাংশ বিশ্বাস করতে হবে কেন? বিএনপির কাঁধ থেকে জামায়াত নামের সিন্দবাদের সেই দৈত্য বা বুড়োটাকে তারা নামাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এককভাবে তাদের। কিন্তু দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশে একাধিক সুস্থধারার রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। তেমনই একটি দল হিসেবে বিএনপি নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছরের আগে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা তাদের নেই। আওয়ামী লীগ অন্য চিন্তা করলে ভিন্ন কথা। বাস্তববাদী হওয়া মঙ্গল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments