প্রসঙ্গ: মানবাধিকার by মনির হায়দার
ব্যাপারটা খুবই অনুচিত। কেবল অনুচিত নয়,
কিছুটা অমানবিকও বটে। আমরা এতটা অকৃতজ্ঞ কেন? অবশ্যই আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া
উচিত। একটুখানি নয়, অনেকখানি।
এমনিতেই বাঙালির কৃতজ্ঞতাবোধ
নিয়ে নানা কথা আছে। অনুযোগপ্রিয় জাতি হিসেবেও বেশ বদনাম আছে। প্রজাকুল তথা
সাধারণ মানুষের এসব দোষ-ত্রুটির কথা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন জনসেবকগণ
হরহামেশাই টের পান। তাদেরও তো ধৈর্যের একটা সীমা আছে। এত সমালোচনা আর
বিরোধিতা সহ্য করার মুচলেকা দিয়ে তো তারা মসনদে বসেননি। তাদের কর্মকাণ্ড
কারও পছন্দ না হলে চোখ বন্ধ রাখলেই পারেন। জনসেবকদের কথাবার্তা কারও ভাল না
লাগলে কানে দিতে পারেন তুলো। তাই বলে অধিকারের অজুহাতে সেবকদের সমালোচনায়
এত মুখর হতে হবে কেন?
দেশবাসীর সুখ-শান্তি আর উন্নতির জন্য আমাদের খাদেমগণ তো কম চেষ্টা করছেন না। দিন-রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রমই না তারা করে চলেছেন। শুধু কি কাজ? কণ্ঠকেও কোন বিশ্রাম দিচ্ছেন না বেচারারা। জনতার উদ্দেশে বিরামহীনভাবে বলে চলেছেন নানা রকম টক-ঝাল-মিষ্টি কথা। তাতে বিশেষ উপকার হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমগুলোরও। তুলনামূলক অল্প চেষ্টাতেই মিলে যাচ্ছে দারুণ সব খবর। প্রজাকুলও সহজেই জানতে পারছে জনসেবকদের নানা রকম বৈচিত্র্যময় ভাবনা ও স্বপ্ন-কল্পনার সমৃদ্ধ সম্ভার সম্পর্কে। সুতরাং জনসাধারণের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছুই কাম্য হতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারের খরচ বাঁচাতে এবং ভোটারদের ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই দিতে আমাদের শাসক মহল তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতার প্রমাণ রেখেছে গত ৫ই জানুয়ারির ভোটকাণ্ডে। ১৫৩ আসনের ভোটারদের তো ঘর থেকে বের হওয়ার কষ্টটুকুও করতে হয়নি। সম্পূর্ণ বিনা পরিশ্রমে এসব নির্বাচনী এলাকার জনগণ পেয়ে গেছেন এক-একজন প্রভাবশালী এমপি। বাকি ১৪৭ আসনেরও বেশির ভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কষ্ট থেকে বেঁচে যান সরকার মহাশয়ের বদান্যতায়। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের খরচ বাঁচানো কিংবা ভোটারকুলকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করাই শুধু নয়, বরং অভিনব এ রাজনৈতিক চমকের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা অনেকগুলো বিশ্বরেকর্ড অর্জনেও সক্ষম হয়েছি। সুতরাং এমন একটি জনদরদি শাসককুলের প্রতি অকাতরে কৃতজ্ঞতাই কেবল জানানো যায়।
দেশবাসীর নিরাপত্তা এবং আরাম-নিদ্রার জন্যও কি আমাদের রাজন্যবর্গের চেষ্টার কোন কমতি আছে? শহরে-গ্রামে সহিংসতা দমনের জন্য নেয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা। দেশীয় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে যৌথবাহিনী। এ বাহিনীর সুপ্রশিক্ষিত সদস্যরা রাতের ঘুটঘুটে আঁধার চিরে সহিংসতাকারীর খোঁজে চষে বেড়াচ্ছেন শহর-বন্দর-গ্রাম। কোথাও কোন সহিংসতাকারীর টিকি দৃশ্যমান হওয়া মাত্রই গর্জে উঠছে যৌথবাহিনীর রাইফেল। মুহূর্তেই এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে শত্রুর শরীর। আর বন্দুকযুদ্ধের গল্প তো সবারই জানা। সব যুদ্ধই জনগণকে দেখিয়ে করতে হবে এমন কোন কথা নেই। গুলির শব্দ শোনা গেলেই তো হলো। বাঙালির এ আরেক সমস্যা। সব কিছু নিজের চোখে দেখতে চায়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি তা সম্ভব? কোন হামলা মামলার প্রধান আসামি কিংবা অন্য আসামিদের লাশ কোথাও পাওয়া গেলে কিংবা আদৌ না পাওয়া গেলে সেটার সঙ্গে মানবাধিকারের কি সম্পর্ক? সীতাকুণ্ডের গ্রামে ১৪ বছর বয়েসী কিশোরের লাশ পাওয়া নিয়ে এত হইচইয়ের কি আছে? বয়সটাই বড় বিবেচ্য! সে তো শিবিরকর্মী। মানবাধিকারের অজুহাতে তাকেও ছেড়ে দিতে হবে? শিবির মানেই যে জঙ্গি, তা কি কারও অজানা আছে? রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সড়ক-অবরোধের মতো গুরুতর অপরাধ কি ক্ষমা করা যায়? এ ধরনের অপরাধীরা যদি যৌথবাহিনীর হাতে ধরা না দেয়, তাহলে তাদের স্ত্রী-সন্তান কিংবা পিতা-মাতাকে আটক করে কারাগারে পাঠানো কি অন্যায়? তাদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার মধ্যে মানবতার বিসর্জন কোথায়? এসবই ফালতু কথা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ টাইপের কিছু ভুঁইফোড় সংগঠনের ভূমিকাও খুবই বিরক্তিকর। কয়েক দিন পরপরই অদ্ভুত ধরনের সব মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে এ দেশের সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালায়। আমাদের উচিত সমস্বরে এসব কাজের নিন্দা জানানো। কেবল মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান একাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমালোচনা করবেন, তার কি এতই দায় ঠেকেছে? সরকারের ইমেজ রক্ষার চেষ্টায় এমনিতেই শুদ্ধভাষী এই বেচারাকে দিন-রাত মহাব্যস্ত থাকতে হয়। এসব মহৎ কাজে প্রজাকুলেরও দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। জনগণের প্রতি সরকার বাহাদুর যথেষ্ট দয়াশীল বলেই তো দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনও বেঁচে আছে। সকাল-দুপুর-রাতে খাওয়া-দাওয়া করছে, শঙ্কা-আতঙ্কের মধ্যেও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মতপ্রকাশের অধিকার নিয়েও আজকাল কিছু লোকের চেঁচামেচি ক্রমেই সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে। সদাশয় সরকার মতপ্রকাশের জন্যই তো এতগুলো টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে। তাতে সবার মত সমানভাবে প্রকাশ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। ক্ষমতাসীনদের মতটা ঠিকমতো প্রকাশের ক্ষেত্রে তো কেউ অবহেলা করছে না। তাহলে আর এতে কথা কেন? এখনও তো সব টিভিতেই টকশো হচ্ছে। সব সময়ই দর্শকদের চাহিদা বা পছন্দ অনুযায়ী অতিথি-আলোচক আনতে হবে এমনকি কোন দাসখত দেয়া হয়েছে? বশ্যতা মানতে না চাওয়ার কারণে দু’-চারটি টিভি চ্যানেল কিংবা সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হলে তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলো কোথায়? খামোখা এসব মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকারের ধুয়া তুলে সরকারের ইচ্ছাপূরণের পথে অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টা কি বরদাশত করা ঠিক?
No comments