বিধানসভা নির্বাচন-এপার থেকে দেখা by আলতাফ পারভেজ
নারীদের অগ্রযাত্রার পাশাপাশি সর্বশেষ নির্বাচনে ভারতীয় পরিসরে আরেকটি পরিবর্তন দেখা গেছে খুব সূক্ষ্মভাবে। তা হলো সংখ্যালঘুদের সংঘবদ্ধতা ও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে রাজনীতি-সচেতন হয়ে ওঠা এবং জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক সমর্থন ধারা থেকে বেরিয়ে সংখ্যালঘুরা বাস্তববাদী হয়ে 'যখন যার সঙ্গে সুবিধা তখন তার সঙ্গে জোট' নীতিতে চলতে শুরু করেছে
ভারতে সম্প্রতি কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হলো। তবে বাংলাদেশে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের পরাজয় নিয়ে। নানাভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজয় বিশ্লেষিত হচ্ছে এখানে। এবারের এই বিধানসভা নির্বাচন শেষে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী যে দিকটি লক্ষণীয়, তা হলো এ মুহূর্তে ভারতে নারী মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল চারজনে। এই চারজনই_ জয়ললিতা, শীলা দীক্ষিত, মায়াবতী এবং মমতা নিজেও রাজনীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে এসেছেন পুরোপুরি নিজের যোগ্যতায়। ফলে নারী হিসেবে তাদের অগ্রযাত্রা ভারতীয় রাজনীতিতে স্পষ্টত এক ধরনের পরিবর্তনের স্মারক। এই চার নারী মুখ্যমন্ত্রী এখন সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩২%) ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। নারীদের অগ্রযাত্রার পাশাপাশি সর্বশেষ নির্বাচনে ভারতীয় পরিসরে আরেকটি পরিবর্তন দেখা গেছে খুব সূক্ষ্মভাবে। তা হলো সংখ্যালঘুদের সংঘবদ্ধতা ও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে রাজনীতি-সচেতন হয়ে ওঠা এবং জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক সমর্থন ধারা থেকে বেরিয়ে সংখ্যালঘুরা বাস্তববাদী হয়ে 'যখন যার সঙ্গে সুবিধা তখন তার সঙ্গে জোট' নীতিতে চলতে শুরু করেছে। অতীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলমানরা ভারতজুড়ে কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্টকে সমর্থন করলেও এখন পরিস্থিতি পুরো আঞ্চলিক রূপ নিয়েছে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও কেরালা, আসাম ও তামিলনাড়ূতে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের ভোটের আচরণে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, এটা বোঝার জন্য এই কয়েকটি রাজ্যের এবারের নির্বাচনী ফলকে আমাদের আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া যায়। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের বিশ্লেষণ করা যাক। এই রাজ্যে বিধানসভার ২৯৪টি আসনে মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ৫৯ জন, ২০০৬ সালের ভোটের চেয়ে ১৩ জন বেশি। কেবল একটি জেলা থেকেই (মুর্শিদাবাদ) ১৫ জন মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে এবারে নির্বাচিত ৫৯ জন মুসলমান বিধায়কের মধ্যে নারী রয়েছেন ৭ জন। গত বিধানসভায় মুসলিম নারী ছিলেন মাত্র দুই জন। ওই সময় বামফ্রন্টের নির্বাচিত এমএলএদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন মুসলমান। এবার সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮-তে অর্থাৎ বামফ্রন্ট এখন আর পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের আস্থায় নেই। অন্যদিকে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট যে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে সেটি মূলত মুসলমানদের ভোটের কারণে। যে কারণে এই জোটের বিজয়ীদের মধ্যে মুসলমান বিধায়ক রয়েছেন ৪০ জন এবং প্রায় সবাই বিধানসভায় নতুন মুখ। সব মিলে পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভায় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ২০ শতাংশে। তৃণমূল ও বামফ্রন্টের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্যে একজন মুসলমান প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবেও জিতেছেন!
আসামের পরিস্থিতি আরও উত্তেজক। সেখানে ১২৬ আসনের বিধানসভায় ৩২ জন মুসলমান প্রার্থী জিতেছেন এবার। গতবার এই সংখ্যা ছিল ২৫। এখানে রীতিমতো কিং-মেকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফ দল। গত বিধানসভায় এই দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ জন, এবার তা দাঁড়িয়েছে ১৮-তে।
অন্যদিকে কেরালার ভোট বিশ্লেষণে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। এই রাজ্যে বিধানসভার আসন ১৪০টি। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতোই কেরালাও হিন্দুপ্রধান একটি রাজ্য। এখানে ৫৫ ভাগ জনসংখ্যাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যে ইউডিএফ জোট জিতেছে সেখানে তারা ৭২টি আসন পেয়েছে। এই ৭২টি আসনের মধ্যে ৪৫ আসনেই জিতেছে সংখ্যালঘু মুখ (মুসলমান ও খ্রিস্টান)। প্রার্থী দেওয়ার সময় এই জোট ১৪০টির মধ্যে ৬৫টি আসনে সংখ্যালঘুদের প্রার্থী দিয়েছিল। এই ৬৫ জনের মধ্যে ৪৫ জনই জিতেছেন। অথচ তারা বাকি যে ৭৫টি আসনে হিন্দু প্রার্থী দিয়েছে তাদের মধ্যে জিতেছেন মাত্র ২৭ জন। কেরালা বিধানসভায় এবার মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ৩৬ জন, গতবার এ সংখ্যা ছিল ২৫।
এবার তামিলনাড়ূর কথা ধরা যাক। এ রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে জয়ের জন্য খুব যত্নের সঙ্গে প্রফেসর জওহির উল্ল্যাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম দল এমএমকের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। এই রাজ্যের বিধানসভায় এবার ৬ জন মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন, তাদের পাঁচজনই জয়ললিতার জোটের। গত বিধানসভায় জয়ললিতার দলে মুসলিম বিধায়ক ছিলেন মাত্র একজন। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ভোটের হিসাবে তামিলনাড়ূতে মুসলিমরা খুবই সংখ্যালঘু হলেও ধারণা করা হচ্ছে, জয়ললিতার বিজয়ে ওই অল্প ভোটই খুব সহায়তা করেছে। কারণ তার বিরোধী দল ডিএমকের গতবার মুসলিম বিধায়ক ছিল ৫ জন। এবার তাদের মুসলিম বিধায়ক আছেন মাত্র একজন। অর্থাৎ তাদের দিক থেকে মুসলিম ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই রাজ্যে এবার প্রধান দুই জোটের প্রার্থীদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন মুসলমান। এই ১৬ জনের ৬ জন বিজয়ী হওয়া ছাড়াও ১০ জন দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন।
আলোচনা না বাড়িয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কেবল এটুকু বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও আসামের তিনটি বিধানসভায় এবার মুসলমান প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে সেখানে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে মুসলমান ভোটারদের সীমাহীন গুরুত্ব বেড়ে গেছে। অন্যদিকে মুসলমান ভোটারদের মধ্যেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে দারুণভাবে। তারা দেখছেন, আঞ্চলিক পরিসরে সরকার পরিবর্তনের চাবিকাঠি এখন তাদের হাতে রয়েছে। ফলে জঙ্গি মনস্তত্ত্বের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণ।
আলতাফ পারভেজ : গবেষক ও লেখক
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও কেরালা, আসাম ও তামিলনাড়ূতে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের ভোটের আচরণে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, এটা বোঝার জন্য এই কয়েকটি রাজ্যের এবারের নির্বাচনী ফলকে আমাদের আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া যায়। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের বিশ্লেষণ করা যাক। এই রাজ্যে বিধানসভার ২৯৪টি আসনে মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ৫৯ জন, ২০০৬ সালের ভোটের চেয়ে ১৩ জন বেশি। কেবল একটি জেলা থেকেই (মুর্শিদাবাদ) ১৫ জন মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে এবারে নির্বাচিত ৫৯ জন মুসলমান বিধায়কের মধ্যে নারী রয়েছেন ৭ জন। গত বিধানসভায় মুসলিম নারী ছিলেন মাত্র দুই জন। ওই সময় বামফ্রন্টের নির্বাচিত এমএলএদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন মুসলমান। এবার সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮-তে অর্থাৎ বামফ্রন্ট এখন আর পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের আস্থায় নেই। অন্যদিকে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট যে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে সেটি মূলত মুসলমানদের ভোটের কারণে। যে কারণে এই জোটের বিজয়ীদের মধ্যে মুসলমান বিধায়ক রয়েছেন ৪০ জন এবং প্রায় সবাই বিধানসভায় নতুন মুখ। সব মিলে পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভায় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ২০ শতাংশে। তৃণমূল ও বামফ্রন্টের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্যে একজন মুসলমান প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবেও জিতেছেন!
আসামের পরিস্থিতি আরও উত্তেজক। সেখানে ১২৬ আসনের বিধানসভায় ৩২ জন মুসলমান প্রার্থী জিতেছেন এবার। গতবার এই সংখ্যা ছিল ২৫। এখানে রীতিমতো কিং-মেকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফ দল। গত বিধানসভায় এই দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ জন, এবার তা দাঁড়িয়েছে ১৮-তে।
অন্যদিকে কেরালার ভোট বিশ্লেষণে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। এই রাজ্যে বিধানসভার আসন ১৪০টি। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতোই কেরালাও হিন্দুপ্রধান একটি রাজ্য। এখানে ৫৫ ভাগ জনসংখ্যাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যে ইউডিএফ জোট জিতেছে সেখানে তারা ৭২টি আসন পেয়েছে। এই ৭২টি আসনের মধ্যে ৪৫ আসনেই জিতেছে সংখ্যালঘু মুখ (মুসলমান ও খ্রিস্টান)। প্রার্থী দেওয়ার সময় এই জোট ১৪০টির মধ্যে ৬৫টি আসনে সংখ্যালঘুদের প্রার্থী দিয়েছিল। এই ৬৫ জনের মধ্যে ৪৫ জনই জিতেছেন। অথচ তারা বাকি যে ৭৫টি আসনে হিন্দু প্রার্থী দিয়েছে তাদের মধ্যে জিতেছেন মাত্র ২৭ জন। কেরালা বিধানসভায় এবার মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন ৩৬ জন, গতবার এ সংখ্যা ছিল ২৫।
এবার তামিলনাড়ূর কথা ধরা যাক। এ রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে জয়ের জন্য খুব যত্নের সঙ্গে প্রফেসর জওহির উল্ল্যাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম দল এমএমকের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। এই রাজ্যের বিধানসভায় এবার ৬ জন মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন, তাদের পাঁচজনই জয়ললিতার জোটের। গত বিধানসভায় জয়ললিতার দলে মুসলিম বিধায়ক ছিলেন মাত্র একজন। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ভোটের হিসাবে তামিলনাড়ূতে মুসলিমরা খুবই সংখ্যালঘু হলেও ধারণা করা হচ্ছে, জয়ললিতার বিজয়ে ওই অল্প ভোটই খুব সহায়তা করেছে। কারণ তার বিরোধী দল ডিএমকের গতবার মুসলিম বিধায়ক ছিল ৫ জন। এবার তাদের মুসলিম বিধায়ক আছেন মাত্র একজন। অর্থাৎ তাদের দিক থেকে মুসলিম ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই রাজ্যে এবার প্রধান দুই জোটের প্রার্থীদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন মুসলমান। এই ১৬ জনের ৬ জন বিজয়ী হওয়া ছাড়াও ১০ জন দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন।
আলোচনা না বাড়িয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কেবল এটুকু বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও আসামের তিনটি বিধানসভায় এবার মুসলমান প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে সেখানে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে মুসলমান ভোটারদের সীমাহীন গুরুত্ব বেড়ে গেছে। অন্যদিকে মুসলমান ভোটারদের মধ্যেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে দারুণভাবে। তারা দেখছেন, আঞ্চলিক পরিসরে সরকার পরিবর্তনের চাবিকাঠি এখন তাদের হাতে রয়েছে। ফলে জঙ্গি মনস্তত্ত্বের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণ।
আলতাফ পারভেজ : গবেষক ও লেখক
No comments