স্মরণ-মানবতাবাদী: পৌল তিগ্যা by সৈয়দ শামসুল আলম
গত বছরের ১৫ জুলাই চলে গেলেন পৌল চারোয়া তিগ্যা। পৌল চারোয়া তিগ্যার জন্ম আদিবাসী গ্রামের উয়াও পরিবারে ১৯৪০ সালের ৩০ জুন, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার ঘাওড়া গ্রামে। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে পৌল তিগ্যার অবস্থান চতুর্থ। সব অভাবের মধ্যদিয়ে তাঁর জীবনের পথচলা।
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ছোটবেলায় বাবা-মাকে রেখে ঘোড়াঘাট উপজেলার মারিয়ামপুর মিশন স্কুলে ভর্তি হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। অভাবী পরিবারে জন্ম হলেও কারও করুণায় বড় হননি পৌল তিগ্যা। মিশনারি বিদ্যালয়ের হোস্টেলের বিভিন্ন কাজে শ্রম দিয়ে পড়ালেখা অব্যাহত রেখে ১৯৬১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মিশনারি ফাদারের সংস্পর্শে পৌল তিগ্যা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। মিশনারি ফাদারের সহায়তায় ঢাকায় নটর ডেম মহাবিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। পৌলের স্বপ্ন প্রতিকূলতাকে জয় করা। ১৯৬৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সফলতার সঙ্গে। টাকাপয়সার অভাবে অনার্সে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ফলে নটর ডেম কলেজেই স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৫ সালে স্নাতক পাস করেন।
মিশনারি ফাদাররা পৌল তিগ্যার সফলতায় মুগ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ করে দেন। ১৯৬৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবোর্চ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পৌল তিগ্যা সারাজীবনই পড়ালেখার জন্য কৃতজ্ঞ তাঁর বড় ভাই ও বিভিন্ন মিশনারি ফাদারদের কাছে। তাঁদের ত্যাগ ও নির্দেশনা ছাড়া এতদূর আসা হয়তো তাঁর জন্য মসৃণ পথ ছিল না।
মহাজনের শোষণ কীভাবে মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে জীবন থেকে উপলব্ধি তাঁর। তাই ১৯৬৯ সালে ধর্ম প্রদেশীয় ঋণদান সমিতিতে সংগঠক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার শিলিগুড়িতে শরণার্থী শিবিরে ক্যাম্পপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ গঠনে কারিতাস বাংলাদেশের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে যোগ দেন। কারিতাস বাংলাদেশ তাঁর কাজের সফলতার জন্য পৌলকে ১৯৭৪ সালে কারিতাস দিনাজপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিযুক্ত করে। আঞ্চলিক পরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে তাঁর মুক্ত মেধা বিকাশের সুযোগ আসে। দারিদ্র্য ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে বাচ্চাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য অনেক শিশুই বিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার লক্ষ্যে প্রয়াত শিক্ষক নরেশ চক্রবর্তী ও পৌল তিগ্যা চার থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রি-স্কুল বা প্রাক্ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ ব্যাপারে গ্রামবাসী বাড়িয়ে দেয় প্রত্যক্ষ সহযোগিতার হাত। কারিতাস বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিসের কাছে প্রি-স্কুলের সফলতার সংবাদ পৌঁছায়। কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করে দেখা যায়, বাচ্চাদের ঝরে পড়া রোধে প্রি-স্কুল একটি অসম্ভব সফল উদ্যোগ।
প্রয়াত নরেশ চক্রবর্তী ও পৌল তিগ্যা গভীরভাবে লক্ষ্য করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করার পর ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে ঝরে পড়ে। শিশুদের ঝরে পড়া রোধে তাঁরা গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বৃত্তি চালু করেন। এ বৃত্তির ফলে গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়ার বই, স্কুলের বেতন দিতে পারে। আজ জাতীয় জীবনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের এ পদ্ধতি চালু করে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে অনেক গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রী। বৃত্তি পদ্ধতি তাদের চিন্তার ফসল।
আন্না হেয়ারিঙ্গার (জার্মান স্থপতি) দীপশিখায় প্রায় ১৮ মাস স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করেছিলেন তিগ্যা। আন্না অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যা বিষয়ে পড়ালেখাকালীন মেটি শিশুদের কথা মনে করে ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’ থিসিসটি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামে মেটি শিশুদের জন্য ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’ জার্মান, অস্টিয়া ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় নির্মাণ করেন। অবকাঠামো নির্মাণ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আগা খান ফাউন্ডেশন পুরস্কার ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’-এর জন্য দীপশিখা ও আন্না হেয়ারিঙ্গার দুর্লভ এ পুরস্কার লাভ করেন, যার পেছনে তিগ্যার অশেষ অনুপ্রেরণার কথা আন্না অনেক বার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন।
পৌল তিগ্যা ১৯৭৩ সালে লিডারশিপ প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডনে যান। প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করেছেন। ১৯৮১ সালে ‘নৃতত্ত্ব’ বিষয়ে ডিপ্লোমা করার জন্য নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখা করেন। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা, নরওয়ে, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ইতালি, নিউজিল্যান্ডসহ এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ মহাদেশের প্রায় ৩০টি দেশে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, এক্সপোজার ও পড়ালেখাসহ প্রশিক্ষণের জন্য ভ্রমণ করেছেন একাধিকবার। পৌল তিগ্যা বারবার স্বীকার করেছেন, ‘এ দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতির কাছে আমি ঋণী। কারণ, এদের কাছে আমি বেশি শিখেছি।’
পৌল তিগ্যা ব্যক্তিগত জীবনে গান্ধীর অহিংস দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। আদিবাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ প্রায় সব ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা।
সৈয়দ শামসুল আলম
মিশনারি ফাদাররা পৌল তিগ্যার সফলতায় মুগ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ করে দেন। ১৯৬৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবোর্চ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পৌল তিগ্যা সারাজীবনই পড়ালেখার জন্য কৃতজ্ঞ তাঁর বড় ভাই ও বিভিন্ন মিশনারি ফাদারদের কাছে। তাঁদের ত্যাগ ও নির্দেশনা ছাড়া এতদূর আসা হয়তো তাঁর জন্য মসৃণ পথ ছিল না।
মহাজনের শোষণ কীভাবে মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে জীবন থেকে উপলব্ধি তাঁর। তাই ১৯৬৯ সালে ধর্ম প্রদেশীয় ঋণদান সমিতিতে সংগঠক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার শিলিগুড়িতে শরণার্থী শিবিরে ক্যাম্পপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ গঠনে কারিতাস বাংলাদেশের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে যোগ দেন। কারিতাস বাংলাদেশ তাঁর কাজের সফলতার জন্য পৌলকে ১৯৭৪ সালে কারিতাস দিনাজপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিযুক্ত করে। আঞ্চলিক পরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে তাঁর মুক্ত মেধা বিকাশের সুযোগ আসে। দারিদ্র্য ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে বাচ্চাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য অনেক শিশুই বিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার লক্ষ্যে প্রয়াত শিক্ষক নরেশ চক্রবর্তী ও পৌল তিগ্যা চার থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রি-স্কুল বা প্রাক্ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ ব্যাপারে গ্রামবাসী বাড়িয়ে দেয় প্রত্যক্ষ সহযোগিতার হাত। কারিতাস বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিসের কাছে প্রি-স্কুলের সফলতার সংবাদ পৌঁছায়। কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করে দেখা যায়, বাচ্চাদের ঝরে পড়া রোধে প্রি-স্কুল একটি অসম্ভব সফল উদ্যোগ।
প্রয়াত নরেশ চক্রবর্তী ও পৌল তিগ্যা গভীরভাবে লক্ষ্য করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করার পর ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে ঝরে পড়ে। শিশুদের ঝরে পড়া রোধে তাঁরা গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বৃত্তি চালু করেন। এ বৃত্তির ফলে গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়ার বই, স্কুলের বেতন দিতে পারে। আজ জাতীয় জীবনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের এ পদ্ধতি চালু করে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে অনেক গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রী। বৃত্তি পদ্ধতি তাদের চিন্তার ফসল।
আন্না হেয়ারিঙ্গার (জার্মান স্থপতি) দীপশিখায় প্রায় ১৮ মাস স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করেছিলেন তিগ্যা। আন্না অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যা বিষয়ে পড়ালেখাকালীন মেটি শিশুদের কথা মনে করে ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’ থিসিসটি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামে মেটি শিশুদের জন্য ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’ জার্মান, অস্টিয়া ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় নির্মাণ করেন। অবকাঠামো নির্মাণ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আগা খান ফাউন্ডেশন পুরস্কার ‘পরিবেশবান্ধব মাটির ঘর’-এর জন্য দীপশিখা ও আন্না হেয়ারিঙ্গার দুর্লভ এ পুরস্কার লাভ করেন, যার পেছনে তিগ্যার অশেষ অনুপ্রেরণার কথা আন্না অনেক বার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন।
পৌল তিগ্যা ১৯৭৩ সালে লিডারশিপ প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডনে যান। প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করেছেন। ১৯৮১ সালে ‘নৃতত্ত্ব’ বিষয়ে ডিপ্লোমা করার জন্য নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখা করেন। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা, নরওয়ে, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ইতালি, নিউজিল্যান্ডসহ এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ মহাদেশের প্রায় ৩০টি দেশে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, এক্সপোজার ও পড়ালেখাসহ প্রশিক্ষণের জন্য ভ্রমণ করেছেন একাধিকবার। পৌল তিগ্যা বারবার স্বীকার করেছেন, ‘এ দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতির কাছে আমি ঋণী। কারণ, এদের কাছে আমি বেশি শিখেছি।’
পৌল তিগ্যা ব্যক্তিগত জীবনে গান্ধীর অহিংস দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। আদিবাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ প্রায় সব ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা।
সৈয়দ শামসুল আলম
No comments