এবারও কি ‘শুষ্ক’ শ্রাবণ নাকি মেঘমেদুর বরষা? by নিয়ামত হোসেন
আষাঢ় চলে গেল অবশেষে। শ্রাবণ এসেছে ফিরে। আজ শ্রাবণের প্রথম দিবস। শ্রাবণ এসেছে, কিন্তু তার দেখা নেই কেন? সে শ্রাবণে তো থাকে না, আসে আরও আগে। আষাঢ়ে। সে বাংলার প্রকৃতির রানী বর্ষারানী। সে সম্প্রতি কম দেখা দিচ্ছে। বর্ষার আগমনে আনন্দিত হয়ে এক কবি লিখেছেন, ‘এসেছে বর্ষা বড় চঞ্চল, বড় দুরন্ত মেয়ে।
’ প্রকৃতি রাজ্যের এই দুরন্ত মেয়েটির আসার সময় হয়ে গেলেও এখনও আসেনি। বড়ই অনিয়মিত তার যাওয়া-আসা। গত বছরও দেখা দিয়েছিল এই অবস্থা। শ্রাবণের অনেক দিনই শুকনো মেঘশূন্য আকাশ। খটখটে রোদ। ভ্যাপসা গরম। এর আগের কয়েক বছরের অবস্থা মোটামুটি একই রকম ছিল। বর্ষার আগমন এখনও তেমন দেখা গেল না। আষাঢ়েই এসে পড়ে, কিন্তু এবার আষাঢ়ে কোথাও কোথাও একটা ছোঁয়া দিয়ে চলে গেছে। স্থায়ী হয়নি। তাই আগমন বোঝা যায়নি। গোটা আষাঢ়টাই যেন শুকনো গেছে, বিশেষ করে এই সুবিস্তীর্ণ রাজধানী নগরীতে। শ্রাবণের লেখার এই সময় পর্যন্ত খোঁজ নেই বর্ষার।
অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা, তাপমাত্রা বাড়ছে, মেরু প্রদেশসহ হিমালয়ের বরফ গলছে, পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাবে, সমুদ্রে জলপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়বে ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা সম্মেলনে এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, কর্মপন্থা ঠিক করা হচ্ছে। বিশ্বের উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে উন্নত ধনী দেশগুলো। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা তথা দায়-দায়িত্ব এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। অথচ বিশ্ব উষ্ণতায়নের কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে দেশগুলো সেগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশ।
জলবায়ু, আবহাওয়া, পরিবেশ সবই এক সূত্রে গাথা। একটির সমস্যা অন্যটির সমস্যায় পরিণত হয়। বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া তথা জলবায়ুর ক্ষেত্রে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তার প্রভাব বিশ্বজুড়েই কমবেশি পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার প্রভাবও আমাদের জন্য কম নয়। আমাদের সামগ্রিক জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর এগুলোর প্রভাব পড়ছে। এখন দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ার উল্টোপাল্টা আচরণ। বর্ষার দিনে বর্ষা নেই। কখনও বর্ষায় আকাশে মেঘ নেই, কখনও মেঘ দেখা দিল তো প্রবল ধারায় নামল বৃষ্টি। অল্প সময়ে এমন বৃষ্টি হলো যাকে অতিবৃষ্টি বলা যায়। আবার কখনও বৃষ্টির দিনে প্রচ- খরা, চারদিক শুকনো, প্রচ- ভ্যাপসা ভাদ্দুরে গরম। যেখানে বৃষ্টির অঝোর ধারায় মানুষের প্রাণে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে গরমের কারণে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর সঙ্গে শীতের দিনে দেখা যাচ্ছে কোথাও তীব্র শীত। আবার শহরে শীত পড়ে না বললেই চলে।
বর্ষার সময় বর্ষা হবে, গরমে গরম পড়বে, শীতের সময় ঠা-া থাকবে প্রকৃতিÑ যুগ যুগ ধরে এটা দেখেছে দেশের মানুষ। এগুলোতেই তারা অভ্যস্ত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে উল্টোপাল্টা ব্যাপার। এজন্য অসুখবিসুখ বাড়ার সম্ভাবনা। আবহাওয়ার এই উল্টোপাল্টা আচরণের প্রভাব অন্যান্য প্রাণীর ওপরও পড়ছে। আষাঢ়-শ্রাবণে যথাযথ পরিমাণে বৃষ্টি না হলে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যায় নিচে, চাষাবাদেও সমস্যা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছিল, এই কারণে দেশের ৬০ প্রজাতির মাছ ও পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অর্ধশত নদী ও খাল। এতেই বোঝা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কী বিপুল ক্ষতি হয়ে যায় আমাদের দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির।
পরিবেশের ক্ষতি আমাদের দেশে হয়েছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশের প্রকৃতিÑসবুজ শ্যামল গাছপালা, নদ-নদী। সবসময় এমনই ছিল। ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন হয়েছে। সবুজ-শ্যামল এলাকার পরিমাণ কমেছে। নদীগুলোর বেশিরভাগই মৃতপ্রায়। বহু নদী সঙ্কীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে। অনেকটিই দূষিত। একটা সময় গেছে যখন নদীর পানি বহু মানুষই খেত। নদীগুলোয় ছিল অনেক ধরনের মাছ। অনেক নদীতে দেখা যেত শুশুক। এখনও অনেকেরই এগুলো মনে থাকার কথা। দিনে দিনে যেন এসব হারিয়ে যাচ্ছে। গাছ কাটতে কাটতে এমন অবস্থা হয়েছে, যার জন্য কমে গেছে সবুজ এলাকার পরিমাণ। দেশে কম করে হলেও মোট আয়তনের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ সবুজ এলাকা থাকা দরকার। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এটা জরুরী। কিন্তু দেখা যায়, এখন আমাদের সবুজ এলাকার পরিমাণ ওই সর্বনিম্ন পরিমাণের চাইতেও অনেক কম। ফলে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বিরূপ, চেহারাও তার হয়ে গেছে রুক্ষ্ম।
দেশে বেশ কিছু পাহাড় টিলা রয়েছে। অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক পাহাড়ের মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। এসব পাহাড়ে এমন এমন দুর্ঘটনা ঘটছে যা কখনও চিন্তাও করা যায়নি। একদিকে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে না, অন্যদিকে কখনও কখনও হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি। সেসব বৃষ্টির দিনে নানা পাহাড়ে ধস নামে। ধসে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। চট্টগ্রামে সম্প্রতি এমন ধসে বহু মানুষের প্রাণ গেছে। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে বন রক্ষা করতে হবে, গাছপালা রক্ষা করতে হবে। পাহাড়গুলোকেও রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমরা সবখানেই হাত দিয়েছি। এমনকি নদীর ওপরও হাত দিয়েছি। নদী দখল হয়েছে অনেক স্থানে। আর মারাত্মক দূষণ হয়েছে অনেক। এখন সব ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে। তবে সচেতনতা আগেও কিছু কিছু ছিল, তা সত্ত্বেও গাছ এবং বন উজাড় করার, নদী দখল ও দূষিত হওয়ার প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়নি। এখন থেকে কয়েক বছর ধরে গাছ লাগানো হচ্ছে, বনায়ন হচ্ছে, কিন্তু সর্বনিম্ন পরিমাণ সবুজ এলাকা গড়ে তোলার কাজও অনেক বাকি; তার চেয়ে বেশি করা তো দূরের কথা।
দেশের প্রধান শহর ঢাকার সমস্যাটি প্রকৃতির দিক থেকে প্রকট। এখানে অপরিকল্পিত ভবন একটার পর একটা তৈরি হয়েছে, বেড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, পাড়া। এগুলোর বেশির ভাগই এমন যেখান থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে সবুজ এলাকা, গাছপালা তেমন নেই। নেই জলাশয়।
পুরনো ঢাকা অনেক কাল আগের তৈরি। নতুন ঢাকা তৈরি হয়েছে একালে। সুপরিকল্পিতভাবে নতুন ঢাকাকে গড়ে তোলা যেত। এখানে ছিল অনেক খাল, পুকুর ও ডোবা। সেগুলোকে রক্ষা করে আরও সুন্দর করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি। বেশিরভাগ খাল, পুকুর, জলাশয়, ডোবা ভরাট করা হয়েছে। নতুন ঢাকার বেশিরভাগ এলাকাই গড়ে উঠেছে অল্প কিছুদিন আগে। এগুলোকে খুব সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল, উচিতও ছিল। কিন্তু হয়নি। আজ তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে। বহু পাড়া বা মহল্লায় পার্ক নেই। পুকুর, ডোবা, জলাশয় নেই। খেলার বা বেড়ানোর মাঠ নেই। তার ওপর বহু বাড়িই অপরিকল্পিত। সেজন্য এর রুক্ষ খটখটে শহরে গরম লাগে বেশি, বৃষ্টিও হয় কম। বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, হলে অতিবৃষ্টি হয়, অর্থাৎ হঠাৎ করে একদিন এমন প্রবল বৃষ্টি হয় যার জন্য পথে পথে পানি জমে যায়। তারপর আবার কিছুদিন এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয় না।
প্রকৃতি রক্ষা করতে চাইলে গাছ লাগাতে হবে, সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে। খাল জলাশয় রক্ষা করতে হবে, নতুন পুকুর, খাল, লেক তৈরি করতে হবে। নদী ও লেককে গভীর ও দূষণমুক্ত করতে হবে। নদী দূষণমুক্ত হলে, তার পানি নির্মল হলে সেটা শুধু মানুষের জন্যই ভাল হবে না, জলের প্রাণিকুলের জন্যও ভাল হবে। সেজন্য প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে, জোরদার করতে হবে। তা না হলে দিন দিন প্রকৃতি আরও রুক্ষ হবে, আবহাওয়া আরও পাল্টাবে। ঋতুগুলো হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে বহু জাতের জলজ প্রাণী, হারিয়ে যাবে বহু জাতের পাখি। সে সবের আলামত এখনই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
এবার আষাঢ় গেল প্রায় নির্জলা। জল ঝরেছে দেশের এখানে ওখানে, নানা স্থানেই। কিন্তু সেই আগের মতো মুষলধারার বর্ষা নয়। এখানে যখন বেশ খানিকটা বৃষ্টি হচ্ছে তখন ওখানে খটখটে শুকনো। আবার ওখানে হলে এখানেই সেই অবস্থা টানা বৃষ্টি, ঝমঝমে দিন রাতকে এক করে ফেলা মেঘমেদুর বর্ষা এবার এই আষাঢ়েও আসেনি।
বিদায়ের দিন শেষ আষাঢ়েও দেখা গেল একই অবস্থা, ঝমঝমিয়ে বেশ বৃষ্টি এল, পথে পানি জমলো। কিছুক্ষণ পর উধাও হলো মেঘ।
শুরু হয়েছে শ্রাবণ। শ্রাবণে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার কথা। এবার কি সেরকম হবে? দেখা যাক। এবারের শ্রাবণ সেই চিরপরিচিত রূপে ফিরবে কিনা। বিশ্ব তাপমাত্রা বাড়ছে। আবহাওয়া পাল্টাচ্ছে। এখন কি বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না? এ বছর আষাঢ়ে বৃষ্টি নেই। শ্রাবণে ভাদ্দুরে উত্তাপ। কোন শীতে হাড়কাঁপানো শীতের দেখা নেই-এসব তো আবহাওয়া পাল্টানোর প্রমাণ। গত শ্রাবণ গেছে প্রায় বৃষ্টিবিহীন। এবার কেমন হবে কে জানে! দেখা যাক কী হয়। বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের কৃষির সম্পর্ক, আবহাওয়া ও পরিবেশের সম্পর্ক, এক কথায় আমাদের জীবনের সম্পর্ক। এবার শ্রাবণ যাতে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তারই প্রত্যাশা সবার।
অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা, তাপমাত্রা বাড়ছে, মেরু প্রদেশসহ হিমালয়ের বরফ গলছে, পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাবে, সমুদ্রে জলপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়বে ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা সম্মেলনে এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, কর্মপন্থা ঠিক করা হচ্ছে। বিশ্বের উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে উন্নত ধনী দেশগুলো। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা তথা দায়-দায়িত্ব এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। অথচ বিশ্ব উষ্ণতায়নের কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে দেশগুলো সেগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশ।
জলবায়ু, আবহাওয়া, পরিবেশ সবই এক সূত্রে গাথা। একটির সমস্যা অন্যটির সমস্যায় পরিণত হয়। বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া তথা জলবায়ুর ক্ষেত্রে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তার প্রভাব বিশ্বজুড়েই কমবেশি পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার প্রভাবও আমাদের জন্য কম নয়। আমাদের সামগ্রিক জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর এগুলোর প্রভাব পড়ছে। এখন দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ার উল্টোপাল্টা আচরণ। বর্ষার দিনে বর্ষা নেই। কখনও বর্ষায় আকাশে মেঘ নেই, কখনও মেঘ দেখা দিল তো প্রবল ধারায় নামল বৃষ্টি। অল্প সময়ে এমন বৃষ্টি হলো যাকে অতিবৃষ্টি বলা যায়। আবার কখনও বৃষ্টির দিনে প্রচ- খরা, চারদিক শুকনো, প্রচ- ভ্যাপসা ভাদ্দুরে গরম। যেখানে বৃষ্টির অঝোর ধারায় মানুষের প্রাণে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে গরমের কারণে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর সঙ্গে শীতের দিনে দেখা যাচ্ছে কোথাও তীব্র শীত। আবার শহরে শীত পড়ে না বললেই চলে।
বর্ষার সময় বর্ষা হবে, গরমে গরম পড়বে, শীতের সময় ঠা-া থাকবে প্রকৃতিÑ যুগ যুগ ধরে এটা দেখেছে দেশের মানুষ। এগুলোতেই তারা অভ্যস্ত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে উল্টোপাল্টা ব্যাপার। এজন্য অসুখবিসুখ বাড়ার সম্ভাবনা। আবহাওয়ার এই উল্টোপাল্টা আচরণের প্রভাব অন্যান্য প্রাণীর ওপরও পড়ছে। আষাঢ়-শ্রাবণে যথাযথ পরিমাণে বৃষ্টি না হলে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যায় নিচে, চাষাবাদেও সমস্যা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছিল, এই কারণে দেশের ৬০ প্রজাতির মাছ ও পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অর্ধশত নদী ও খাল। এতেই বোঝা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কী বিপুল ক্ষতি হয়ে যায় আমাদের দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির।
পরিবেশের ক্ষতি আমাদের দেশে হয়েছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশের প্রকৃতিÑসবুজ শ্যামল গাছপালা, নদ-নদী। সবসময় এমনই ছিল। ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন হয়েছে। সবুজ-শ্যামল এলাকার পরিমাণ কমেছে। নদীগুলোর বেশিরভাগই মৃতপ্রায়। বহু নদী সঙ্কীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে। অনেকটিই দূষিত। একটা সময় গেছে যখন নদীর পানি বহু মানুষই খেত। নদীগুলোয় ছিল অনেক ধরনের মাছ। অনেক নদীতে দেখা যেত শুশুক। এখনও অনেকেরই এগুলো মনে থাকার কথা। দিনে দিনে যেন এসব হারিয়ে যাচ্ছে। গাছ কাটতে কাটতে এমন অবস্থা হয়েছে, যার জন্য কমে গেছে সবুজ এলাকার পরিমাণ। দেশে কম করে হলেও মোট আয়তনের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ সবুজ এলাকা থাকা দরকার। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এটা জরুরী। কিন্তু দেখা যায়, এখন আমাদের সবুজ এলাকার পরিমাণ ওই সর্বনিম্ন পরিমাণের চাইতেও অনেক কম। ফলে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বিরূপ, চেহারাও তার হয়ে গেছে রুক্ষ্ম।
দেশে বেশ কিছু পাহাড় টিলা রয়েছে। অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক পাহাড়ের মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। এসব পাহাড়ে এমন এমন দুর্ঘটনা ঘটছে যা কখনও চিন্তাও করা যায়নি। একদিকে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে না, অন্যদিকে কখনও কখনও হচ্ছে প্রবল বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি। সেসব বৃষ্টির দিনে নানা পাহাড়ে ধস নামে। ধসে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। চট্টগ্রামে সম্প্রতি এমন ধসে বহু মানুষের প্রাণ গেছে। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে বন রক্ষা করতে হবে, গাছপালা রক্ষা করতে হবে। পাহাড়গুলোকেও রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমরা সবখানেই হাত দিয়েছি। এমনকি নদীর ওপরও হাত দিয়েছি। নদী দখল হয়েছে অনেক স্থানে। আর মারাত্মক দূষণ হয়েছে অনেক। এখন সব ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে। তবে সচেতনতা আগেও কিছু কিছু ছিল, তা সত্ত্বেও গাছ এবং বন উজাড় করার, নদী দখল ও দূষিত হওয়ার প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়নি। এখন থেকে কয়েক বছর ধরে গাছ লাগানো হচ্ছে, বনায়ন হচ্ছে, কিন্তু সর্বনিম্ন পরিমাণ সবুজ এলাকা গড়ে তোলার কাজও অনেক বাকি; তার চেয়ে বেশি করা তো দূরের কথা।
দেশের প্রধান শহর ঢাকার সমস্যাটি প্রকৃতির দিক থেকে প্রকট। এখানে অপরিকল্পিত ভবন একটার পর একটা তৈরি হয়েছে, বেড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, পাড়া। এগুলোর বেশির ভাগই এমন যেখান থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে সবুজ এলাকা, গাছপালা তেমন নেই। নেই জলাশয়।
পুরনো ঢাকা অনেক কাল আগের তৈরি। নতুন ঢাকা তৈরি হয়েছে একালে। সুপরিকল্পিতভাবে নতুন ঢাকাকে গড়ে তোলা যেত। এখানে ছিল অনেক খাল, পুকুর ও ডোবা। সেগুলোকে রক্ষা করে আরও সুন্দর করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি। বেশিরভাগ খাল, পুকুর, জলাশয়, ডোবা ভরাট করা হয়েছে। নতুন ঢাকার বেশিরভাগ এলাকাই গড়ে উঠেছে অল্প কিছুদিন আগে। এগুলোকে খুব সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল, উচিতও ছিল। কিন্তু হয়নি। আজ তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে। বহু পাড়া বা মহল্লায় পার্ক নেই। পুকুর, ডোবা, জলাশয় নেই। খেলার বা বেড়ানোর মাঠ নেই। তার ওপর বহু বাড়িই অপরিকল্পিত। সেজন্য এর রুক্ষ খটখটে শহরে গরম লাগে বেশি, বৃষ্টিও হয় কম। বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, হলে অতিবৃষ্টি হয়, অর্থাৎ হঠাৎ করে একদিন এমন প্রবল বৃষ্টি হয় যার জন্য পথে পথে পানি জমে যায়। তারপর আবার কিছুদিন এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয় না।
প্রকৃতি রক্ষা করতে চাইলে গাছ লাগাতে হবে, সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে। খাল জলাশয় রক্ষা করতে হবে, নতুন পুকুর, খাল, লেক তৈরি করতে হবে। নদী ও লেককে গভীর ও দূষণমুক্ত করতে হবে। নদী দূষণমুক্ত হলে, তার পানি নির্মল হলে সেটা শুধু মানুষের জন্যই ভাল হবে না, জলের প্রাণিকুলের জন্যও ভাল হবে। সেজন্য প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে, জোরদার করতে হবে। তা না হলে দিন দিন প্রকৃতি আরও রুক্ষ হবে, আবহাওয়া আরও পাল্টাবে। ঋতুগুলো হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে বহু জাতের জলজ প্রাণী, হারিয়ে যাবে বহু জাতের পাখি। সে সবের আলামত এখনই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
এবার আষাঢ় গেল প্রায় নির্জলা। জল ঝরেছে দেশের এখানে ওখানে, নানা স্থানেই। কিন্তু সেই আগের মতো মুষলধারার বর্ষা নয়। এখানে যখন বেশ খানিকটা বৃষ্টি হচ্ছে তখন ওখানে খটখটে শুকনো। আবার ওখানে হলে এখানেই সেই অবস্থা টানা বৃষ্টি, ঝমঝমে দিন রাতকে এক করে ফেলা মেঘমেদুর বর্ষা এবার এই আষাঢ়েও আসেনি।
বিদায়ের দিন শেষ আষাঢ়েও দেখা গেল একই অবস্থা, ঝমঝমিয়ে বেশ বৃষ্টি এল, পথে পানি জমলো। কিছুক্ষণ পর উধাও হলো মেঘ।
শুরু হয়েছে শ্রাবণ। শ্রাবণে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার কথা। এবার কি সেরকম হবে? দেখা যাক। এবারের শ্রাবণ সেই চিরপরিচিত রূপে ফিরবে কিনা। বিশ্ব তাপমাত্রা বাড়ছে। আবহাওয়া পাল্টাচ্ছে। এখন কি বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না? এ বছর আষাঢ়ে বৃষ্টি নেই। শ্রাবণে ভাদ্দুরে উত্তাপ। কোন শীতে হাড়কাঁপানো শীতের দেখা নেই-এসব তো আবহাওয়া পাল্টানোর প্রমাণ। গত শ্রাবণ গেছে প্রায় বৃষ্টিবিহীন। এবার কেমন হবে কে জানে! দেখা যাক কী হয়। বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের কৃষির সম্পর্ক, আবহাওয়া ও পরিবেশের সম্পর্ক, এক কথায় আমাদের জীবনের সম্পর্ক। এবার শ্রাবণ যাতে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে তারই প্রত্যাশা সবার।
No comments