উচ্চশিক্ষা-ভর্তিযুদ্ধ এড়াতে by ছিদ্দিকুর রহমান

উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের জন্য এক মহাযুদ্ধ, কোচিং সেন্টারের জন্য রমরমা ব্যবসা। এইচএসসি পরীক্ষা আরম্ভের আগেই কোচিং সেন্টারে ভর্তি এবং পরীক্ষা শেষ না হতেই কোচিং ক্লাস শুরু। এইচএসসির দুই বছরের বিরাট চাপমুক্ত না হতেই ভর্তি প্রস্তুতির প্রচণ্ড চাপ।


কেবল পড়ো, মুখস্থ করো, কোচিং সেন্টারে দৌড়াও—এ এক কঠিন জীবন। ঘুম হারাম, খেলাধুলা বাদ, টেনশনে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম।
প্রস্তুতিপর্ব শেষে ভর্তি পরীক্ষা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে অন্য জেলায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়। রাত জেগে ভ্রমণ করে সকালে পরীক্ষা। এভাবে চলে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পালা। এত সব করার পরও অনেকের ভাগ্যে ভর্তির সুযোগ জোটে না। নেমে আসে বিষণ্নতা, চরম হতাশা।
এখন নজর দেওয়া যাক অভিভাবকদের দিকে। ভর্তি নিয়ে মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের মহা টেনশন। কোচিং সেন্টারের ফি, যাওয়া-আসার খরচ এবং ভর্তি পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের খরচ, তার ওপর ভর্তি পরীক্ষার ফি, তাও এক পরীক্ষার নয়, গড়ে পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের—এসব খরচ বহন করতে মধ্যবিত্তের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। গ্রামের ছেলেমেয়েদের কোচিং করার জন্য শহরে এসে থাকতে হয়। এতেও প্রচুর খরচ। মেয়েদের যাতায়াতের খরচ আরও বেশি। অভিভাবককে সঙ্গে যেতে হয়। তা ছাড়া যতক্ষণ কোচিং চলে ততক্ষণ ঘর-সংসার ছেড়ে কোচিং সেন্টারের বাইরে মায়েদের অপেক্ষার পালা।
এত সব খরচ বহন করা গরিব পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই গরিব ছেলেমেয়েরা কোচিংও করতে পারে না এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেও পারে না। এসব কারণে উচ্চশিক্ষার দ্বার গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য বন্ধ, যত মেধাবীই হোক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি কম হলে কী লাভ, গরিবের ভর্তির সুযোগ থাকতে হবে।
এ সমস্যার কি সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে যেভাবে এইচএসসিতে ভর্তি করা হয়, একই পদ্ধতিতে এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সম্ভব। প্রকৌশল, মেডিকেল, কৃষি ইত্যাদি পেশাভিত্তিক কোর্সে ভর্তির জন্য বিশেষ বিশেষ বিষয়ের যেমন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরকে গুরুত্ব দিয়ে ভর্তির নীতিমালা নির্ধারণ করা সম্ভব। সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তির নীতিমালা নির্ধারণে বিষয়-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে প্রাপ্ত নম্বরের ওপর গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব।
এখানে উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যখন বিদেশে পড়তে যায়, তখন তাদের আমাদের দেশে প্রাপ্ত ফলাফল এবং জিআরই বা আইইএলটিএস পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা কোনো ভর্তি পরীক্ষা নেয় না। আরও বলা প্রয়োজেন যে আমাদের দেশে বর্তমানে নকলমুক্ত পরিবেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। প্রয়োজনে প্রশ্নপত্র এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের মানোন্নয়ন করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্রের যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতাসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভর্তির প্রার্থী নির্বাচন করা হলে ছাত্রছাত্রীরা মানসিক চাপ ও অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে। অভিভাবকদেরও মানসিক ও আর্থিক চাপ কমবে। এর ফলে গরিব মেধাবীরাও ভর্তির সুযোগ পাবে। কোচিং-ব্যবসাও বন্ধ হবে। উদ্বৃত্ত ভর্তি ফি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কিছু বাড়তি আয় বন্ধ হবে বটে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী, তাদের অভিভাবক তথা সমগ্র জাতি উপকৃত হবে। যথাসময়ে নতুন সেশন আরম্ভ করা সম্ভব হবে।
ভর্তি পরীক্ষা যদি নিতেই হয়, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় সব জেলা শহরে একই সময়ে একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একই শাখা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা ভর্তির ফরম পূরণ করার সময় ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও ভর্তির বিষয়ের পছন্দের তালিকা দেবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর এবং তাদের দেওয়া পছন্দের ভিত্তিতে ভর্তির বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করা হবে। এভাবে সব কটি পাবলিক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ইউনিটের জন্য একটি করে এবং পেশাগত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পেশাগত বিষয়ের জন্য একটি করে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ আলাদাভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভর্তির পরীক্ষা থাকবে। এখানে উল্লেখ্য যে বর্তমানে মেডিকেল শিক্ষায় ভর্তি এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতি মেডিকেল কলেজে আলাদা ভর্তির পরীক্ষা হয় না।
কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তির কার্যক্রম পরিচালনার সময় এখনো আছে। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই ভর্তির নীতি প্রকাশ করা প্রয়োজন। তা করা হলে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ হবে। হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান: অধ্যাপক ও পরিচালক (সাবেক), শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
semzs@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.