বিবিয়ানার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ তালিকা হচ্ছে সুবিধাভোগীদের সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড by শংকর কুমার দে

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী ‘বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের গোপন সুড়ঙ্গ পথে বিকল্প পাইপ লাইন স্থাপনের ভিডিও ফুটেজসহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ তৈরি করে বিষধর সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর মতো ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তারা নিজেদের জীবন দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে গেছে বলে তদন্তকারী সূত্র অভিমত ব্যক্ত করেছেন।


হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে ঢাকায় ফেরার পর তারা হুমকির মুখে পড়েছিলেন বলে তদন্তে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। বিবিয়ানার গ্যাস ফিল্ড সংক্রান্ত খবর ফাঁস হওয়ার পর সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সমর্থক, সুবিধাভোগী সাংবাদিকসহ কিছু ভিআইপি ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তদন্তে নতুন মোড় নেয়ার পর প্রভাবশালী মহল এখন সাংবাদিক দম্পতির খুনের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য পর্দার অন্তরালে তৎপরতা শুরু করেছে। এ খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের গোপন সুড়ঙ্গ পথে পাইপলাইন স্থাপনের ফুটেজসহ রিপোর্ট সংগ্রহের পর রুনী যে হুমকির মুখে পড়েছিলেন সেই ব্যাপারে তার মা ও সহকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা অব্যাহত আছে। রুনীর সহকর্মীদের মধ্যে কারও কারও সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। এই ধরনের তথ্য পাওয়ার পর, র‌্যাবের কর্মকর্তারা গত সোমবার খুনের ঘটনা রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে র‌্যাব সদর দফতরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন রুনীর মা নূরুন্নাহার মির্জাকে। মামলার বাদী নওশের রোমানকেও ইতোমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাগর-রুনীর একমাত্র সন্তান মেঘকে র‌্যাবের তদন্তকারীদের তত্ত্বাবধানে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে। এমনকি শুক্রবার সরকারী ছুটির দিনেও র‌্যাবের তদন্তকারী দলের সদস্যরা সাংবাদিক দম্পতি খুনের ঘটনাস্থল রাজাবাজারের তালাবদ্ধ ফ্ল্যাট পরিদর্শন করেছেন। নির্দিষ্ট ক্লু যাচাই করতে বার বার খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হচ্ছে।
রুনী কোথায় বসত, কোন্ কম্পিউটার চালাত, কোথায় এ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তারা খুন হওয়ার পর থেকে দাফন করার সময় পর্যন্ত যা ঘটেছে এবং তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান মেঘের প্রথম সাক্ষাতকারের ফুটেজ নিয়ে এসেছে র‌্যাব। খুনের ঘটনাস্থলটি আবারও খুব ভালভাবে প্রত্যক্ষ করে ইতোপূর্বে অঙ্কিত স্কেচের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। সাংবাদিক দম্পতি যেই ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন সেই ভবনের চারদিক ঘুরে দেখেছেন তারা। সাংবাদিক দম্পতিকে খুন করে ঘাতকরা কিভাবে গা ঢাকা দিয়েছে তা তদন্ত করে দেখাই উদ্দেশ্য। খুনের ঘটনাটির নেপথ্যে যে প্রভাবশালী মহল জড়িয়ে আছে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। নতুবা এতদিনে এ খুনের ঘটনাটি রহস্য উদঘাটিত হয়ে যেত।
এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র শিশুপুত্র মেঘকে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে মেঘের প্রথম সাক্ষাতকারের যেই ভিডিও ফুটেজটি দেয়া হয়েছে তাতে মেঘ বলেছে, প্রথমে আমার আব্বু (সাগর) আমার আম্মুকে (রুনী) খুন করে। পরে দু’টি গুন্ডা আমার আব্বুকে খুন করে। মেঘকে বার বার কাউন্সেলিং করানোর পরও তার মুখ দিয়ে এখন আর আগের সেই কথা বের হচ্ছে না। এতে তদন্তকারীদের মধ্যে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিকে কেন্দ্র করে স্বামীসহ রুনীকে বিশেষ মহলের টার্গেটে পরিণত হয়ে নৃশংস পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল কি না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এখন সে বিষয়টির অনুসন্ধানেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এ ধরনের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ায় এখন নতুন ধারায় তদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব। খুনের ব্যাপারে সন্দেহজনক অনেকগুলো অস্পষ্ট তথ্য যাচাইয়ের কাজও ইতোমধ্যে শুরু করা হয়। বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের ফুটেজ সংগ্রহকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধকে এখন বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলছে।
তদন্তকারীরা যে বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন তা হচ্ছে, রুনীর সরেজমিনে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের গোপন সুড়ঙ্গ পথে বিকল্প পাইপলাইন স্থাপনের ভিডিও ফুটেজসহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি হঠাৎ করে প্রচার বন্ধ করে দেয়া এবং প্রতিবেদন তৈরির কারণে হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পর হুমকির মুখে পড়ার জন্য দায়ী কারা? এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সমর্থক কিনা? তার ছোট ভাই ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসার সঙ্গী জড়িত কি? এই টিভি চ্যানেলটির তিনজন সিনিয়র সাংবাদিক বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী কিনা ? টিভি চ্যানেলটির মালিককে র‌্যাব কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করে যাওয়ার পর তাদের টিভি চ্যানেলের সুরক্ষিত অফিস থেকে কিভাবে ভিডিও ফুটেজ চুরি হয়ে যায়? তদন্তে এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। এসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ তালিকা তৈরি করছে। তালিকা তৈরি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের একটি গোপন সুড়ঙ্গ পথ থেকে পেট্রোবাংলা কিংবা সরকারী কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ঠিকাদাররা বিকল্প একটি পাইপলাইন স্থাপন করতে সক্ষম হলে কোটি কোটি টাকার সরকারের ক্ষতি হয়ে যেত। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে কোথায় কিভাবে গ্যাস নেয়া হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ধরনের রহস্যময় বিকল্প পাইপলাইন রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ কি না এখন তাও খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রুনী নিজের জীবন দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে গেছে বলে তদন্তকারী সূত্রে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পূর্ব রাতের শেষভাগে ফ্ল্যাটের বেডরুমে ধারাল অস্ত্রের আঘাতে খুন হন এ দম্পতি। ওই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন রুনীর ভাই নওশের রোমান। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আড়াই মাস তদন্ত শেষে তদন্তে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করায় উচ্চ আদালত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ মামলার তদন্ত করার দায়িত্ব দেন র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব)। র‌্যাবের এএসপি জাফর উল্লাহ তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তদন্তের তদারকিতে সহায়তা করছেন সদর দফতরের তিনজন পরিচালক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক দম্পতির খুনের মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তারা নিয়মিত মামলাটির তদন্তের মনিটারিং করছেন। তদন্তের এ পর্যায়ে এসে গ্যাস ফিল্ডের গোপন সুড়ঙ্গ পথে বিকল্প পাইপলাইন স্থাপনের ভিডিও ফুটেজসহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

No comments

Powered by Blogger.