শেখ হাসিনার লেখা সেই চিঠি by দুলাল আচার্য
আজ ১৬ জুলাই। ২০০৭ সালের এদিনে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে তিনি একটি চিঠি লিখে যান; যা পরদিন জাতীয় দৈনিকগুলো ফলাও করে প্রকাশ করে।
শেখ রেহানা সম্পাদিত ও প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাকরি করার সুবাদে এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদের স্নেহধন্য হওয়ায় সেই স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে সেদিনের কথা।
ভোর ৬টায় রঞ্জনদার (বর্তমানে এটিএন নিউজে কর্মরত) ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। তিনি জানালেন, দুলাল, আপাকে (শেখ হাসিনা) গ্রেফতার করেছে; টিভি খুলে দেখ। টিভিতে চোখ রাখতেই গ্রেফতারের প্রস্তুতি দেখে বিস্মিত হই। সকাল ৯.৪৫ মিনিটে অফিসে পৌঁছি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের দুই বাড়ি আগে শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড)। দেখি বেবী আপা টিভি রুমে। সিএসবি চ্যানেলটি সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আমি পাশের একটি চেয়ারে বসি। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কেমন যেন শোকাবহ পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর বেবী আপার মোবাইলে একটি ফোন এলো। তিনি কিছু না বলেই বের হয়ে গেলেন।
দুপুর দু’টার পর পরই অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। অফিসে ওয়ালিদ, মনির ও আমি। চারদিকে এক ধরনের নীরবতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি। রাস্তায় লোকজন খুব কম। কেমন যেন থমথমে ভাব। ওয়ালিদ (বিচিত্রার সার্কুলেশন ম্যানেজার) বলল, চল, সবাই চলে গেছে আমরাও যাই। আপা (বেবী আপা) মনে হয় আজ আর আসবেন না। আমি বললাম, দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করি। বিচিত্রার চাকরি জীবনের প্রায় নয় বছরে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেবী আপা অফিস থেকে যখনই বের হন না কেন, অফিস বন্ধ হওয়ার আগে একবার আসেন। বরাবরের মতো আমি আর মনির (অফিস সহকারী) অপেক্ষা করি।
বিকেল তিনটার কিছু বেশি হবে। বেবী আপা তাঁর রুমে ঢুকেই মনিরকে ডাকলেন। ৪/৫ মিনিট পর আমি ইচ্ছা করেই আপার রুমে যাই। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, আপা বইয়ের সেলফ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই বের করছেন, কিছু বই ইতোমধ্যে টেবিলেও রেখেছেন। আমাকে দেখে বললেন, দুলাল মনির আসুক, তোমাকে প্রেসক্লাব যেতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছু বললাম না। বুঝলাম আপার মনের অবস্থা ভাল না। আপা বললেন, তুমি এখন যাও আমি ডাকব।
৫ মিনিট পর মনির এসে বলল, দুলাল ভাই ফুপু ডাকছেন। (মনির বেবী আপাকে ফুপু বলে সম্বোধন করতেন)। আমি আপার রুমের দিকে এগুচ্ছি, পেছনে মনির। মনির বলল, দুলাল ভাই ‘জরুরী’ খবর আছে।
আমি রুমে ঢুকতেই বেবী আপা বললেন, এখানে ২০ কপি আছে তুমি প্রেসক্লাব গিয়ে আজাদের (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি) কাছে দেবে। আজাদকে তোমার কথা বলা আছে। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে যাও। আমি বুঝতে পারলাম, এটা বড় আপার হাতের লেখা। কারণ পাশেই মূল কপিটা রাখা ছিল। আমরা বিচিত্রায় যারা চাকরি করতাম তারা সবাই শেখ হাসিনাকে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বড়আপা এবং রেহানা আপাকে ছোটআপা বলেই ডাকতাম। বিচিত্রায় চাকরি করার সুযোগে শেখ হাসিনার হাতের লেখার সঙ্গে আমার একটা পরিচয় রয়েছে। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই বিচিত্রায় কম্পোজ হতো এবং এক পর্যায়ে সংশোধনের জন্য আমার কাছে আসত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত ডায়রি’র কাজে কয়েকবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ফকরুল আলম স্যারের বাসায় যেতে হয়েছে। ডায়রির বাংলা কম্পোজের পর ইংরেজী করার জন্য স্যারের বাসায় বেবী আপা আমাকে পাঠাতেন। আমি অফিস ছুটির পর স্যারকে এগুলো পৌঁছে দিতাম।
আমি আমার সিটে গিয়ে ব্যাগটি গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটটি ব্যাগের একটি ভাঁজে রাখলাম। ওয়ালিদকে বললাম উঠো। টেবিল ছেড়ে উঠতেই বেবী আপা ডাকলেন দুলাল। আমি কাছে যেতেই ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি যাও, দেরি করো না। আর শোন, আজাদকে বলবা যাঁরা আওয়ামী লীগ বিট করেন তাদের ফোনে ডেকে হাতে হাতে দিতে। ঠিক আছে আপা, বলেই আমি বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমেই ওয়ালিদ বলল, আমি তোমার সঙ্গে নেই। আমি বুঝলাম এটি তার দুষ্টুমি। বেবী আপা আমাকে এর আগে যত দায়িত্বই দিয়েছেন তার সবগুলোতে ওয়ালিদ কোন না কোনভাবে আমাকে সহায়তা করেছে।
আমরা মিরপুর থেকে আসা (৯ নম্বর) একটি লোকাল বাসে প্রথমে নিউমার্কেট যাই। নিউমার্কেটে গিয়ে বাস আর যাবে না। পরে নিউমার্কেট থেকে রিক্সায় প্রেসক্লাব যাই। ওয়ালিদ পল্টনে প্রেসে চলে যায়। প্রেসক্লাব গেট থেকে আমি আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তিনি বললেন আমি ভেতরে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি আজাদ ভাই মাঠে পায়চারি করছেন। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সংখ্যাও আজ কম।
আজাদ ভাই আমাকে দেখে বললেন কই দেও। প্যাকেটটি হাতে দিতেই তিনি কি যেন বলতে চাইলেন। আমি বললাম, আজাদ ভাই বেবী আপা বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিট যাঁরা করেন তাঁদের ডেকে হাতে হাতে দিতে।
তিনি আমার দিকে তাকালেন। আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলত বিচিত্রা অফিসেই। সম্ভবত ২০০২ সালে। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উপদেষ্টা জাওয়াদুল করিম ভাই বিচিত্রা অফিসে (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) একটি কক্ষে বসতেন। সেখানে নেত্রীর প্রেস সংক্রান্ত কাজ চলত। শোকবাণী, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বাণী সবই তখন এখান থেকে দেয়া হতো। জাওয়াদুল করিম ভাইকে সহায়তার জন্য এক সময় আসলাম সানী ভাইকে নিয়োগ দেয়া হয়। বেবী আপার নির্দেশে আমিও জাওয়াদ ভাইকে সহায়তা করতাম। আজাদ ভাই আসার আগে এখানে কিছুদিন কাজ করেছিলেন পিআইডির সদ্য সাবেক প্রধান হারুন-উর-রসিদ ভাই। আজাদ ভাই আসার পর হারুন ভাই আর আসতেন না। জাওয়াদ ভাই মারা যাওয়ার পর আজাদ ভাই পুরো দায়িত্ব নেন। সানী ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর যতদিন বিচিত্রা অফিসে নেত্রীর প্রেস অফিস ছিল ততদিন কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা কম্পোজ করত। আমি তা সংশোধন করে দিতাম। অনেক সময় বেবী আপা আমাকে ফোনে বলতেন অমুক যাবে তাকে একটি শোকবাণী অথবা কোন কাগজ রেডি করে রাখো। আমি এসে দেখব। পরোক্ষভাবে সেসময় বেবী আপাও নেত্রীর প্রেসের দায়িত্ব পালন করতেন।
-আজাদ ভাই খুলে পুরো চিঠিটা পড়লেন।
-আমি বললাম, আজাদ ভাই আমি কি আপনাকে কোনভাবে সহায়তা করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি কোন্দিকে যাবে। আমি বললাম, মতিঝিলের দিকে। তিনি আমাকে ৬টি কপি দিয়ে বললেন। যাবার পথে এগুলো সংবাদ, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, অবজারভার অফিসে দিয়ে যাবে। একটা বেশি আছে প্রয়োজনে ফটোকপি করে নিও।
প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে প্রথমে রঞ্জনদাকে ফোন দিলাম। রঞ্জন সেন (বিচিত্রার সাবেক কর্মী) তখন সংবাদের রিপোর্টার। রঞ্জনদা বললেন, আমি অফিসে।
সংবাদে ঢুকেই রঞ্জনদাকে একটি কপি দিলাম। তিনি দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে বার্তা সম্পাদক হয়ে নির্বাহী সম্পাদকের রুমে গেলেন। খুব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম যুগান্তর অফিসের উদ্দেশ্যে। রিসিপশনে দাঁড়িয়ে ফজলুর রহমানকে (তিনিও বিচিত্রার সাবেক কর্মী, বর্তমানে সকালের খবরের চীফ রিপোর্টার) ফোন দিলাম। তিনি বললেন, উপরে আস। হাতে একটি কপি দিলে তিনি দ্রুত সাইফুল ভাইকে (বর্তমানে যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক) দিলেন। কোথায় পেলাম জানতে চাইলে বললাম বেবী আপা দিয়েছে। সাইফুল ভাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমার দিকে পরপর দু’বার তাকালেন, বললেন, যাও সাবধানে যেও। ফজলু ভাই আমার সঙ্গে নিচে নামলেন এবং আমাকে বললেন, এখন কোথায় যাবে। আমি বললাম ইত্তেফাক, ইনকিলাব। বললেন সাবধান, ব্যারিস্টার মইনুলের পত্রিকা কিন্তু।
আমি একটা রিক্সা নিয়ে ইত্তেফাকের গেটে নেমে উপরে উঠে প্রথম ফরাজী আজমল ভাইকে খুঁজলাম। দেখি তিনি অফিসে নেই। পরে জাহিদুর রহমান সজলকে খুঁজলাম সেও বাইরে। আমার পরিচিতদের মধ্যে আবুল খায়ের, স্পোর্টসের কাশীদা অফিসে থাকলেও তাদের কাছে দেয়াটা নিরাপদ মনে করলাম না। নিচে নেমে দুটো খাম কিনে ভেতরে একটি করে কপি ইত্তেফাক ও ইনকিলাব পত্রিকার প্রেস রিলিজ বক্সে রাখি। পরে আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তাঁকে বিস্তারিত বললাম এবং আমার কাছে দু’টি কপি আছে বললাম। তিনি বললেন ঠিক আছে, তুমি কাছাকাছি থেকো। প্রয়োজনে ফোন দেব। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা হলো না। হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল মসজিদ মার্কেটে অর্থকণ্ঠ অফিসে গেলাম। পত্রিকাটির মালিক আমার বন্ধু এনামুল হক এনাম। অফিসে বসে দুই গ্লাস পানি খেলাম। ভাবলাম বেবী আপাকে একটা ফোন দেই।
-প্রথমবার তিনি ধরলেন না। দশ মিনিট পর আবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেই বললেন, দুলাল বলো। আপাকে বিস্তারিত বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে বাসায় চলে যাও।
এবার এনামের রুমে গিয়ে তার হাতে একটি কপি দেই। সে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ৫টি ফটোকপি করিয়ে আনে। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্থকণ্ঠ অফিসের সবাই জেনে যায়।
ওয়ালিদকে ফোন দিলাম। বলল, আমি প্রেসে, আসবা। আমি বললাম, মতিঝিল এনামের অফিসে আছি। মতিঝিল হয়ে যাও।
-সে বলল না দেরি হবে, তুমি চলে যাও, কাল সকাল সকাল এসো।
ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই, যানবাহনও কম, দু’একটা রিক্সা চলছে। রিক্সা না পেয়ে হেঁটেই বাসায় চলছি। ভাবছি ১৯৭১ সাল আর ২০০৭ সাল। ব্যবধান ৩৬ বছরের। স্বাধীনতার সমবয়সী আমি। আমার যখন জন্ম হয় তখন এদেশে চলছে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতা।
মা-বাবার কাছে শুনেছি, আমার জন্মের সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা। মার কোলে করে শরণার্থী হয়েছিলাম আমি।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস মেসেজের কথা আজ ইতিহাসের অংশ। পেশার কারণে অসংখ্যবার পড়েছি। লেখায় ব্যবহার করেছি। সেই মেসেজটিতে জাতির জন্য যে নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন দেশবাসী সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমরা মুক্ত হলাম, দেশ স্বাধীন হলো। ৩৬ বছর পর অন্যায় শাসন আর অরাজকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা জেলে। তাঁর এই মেসেজটি (চিঠি) এদেশের জনগণকে উদ্দেশ করে লেখা।
আমি বঙ্গবন্ধুর ম্যাসেজ আর আজ তাঁর কন্যার মেসেজটি তুলনা করলাম। দুটোতেই মুক্তির কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা রয়েছে। দুটোই মুক্তির সনদ। একটি দেশকে শত্রুমুক্ত করে দেশ স্বাধীন করতে অন্যটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায়, অগণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতে। যে সংগ্রাম শেখ হাসিনা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
মনিরের কথা মনে পড়ল, দুলাল ভাই ‘জরুরী’ খবর আছে ...।
ajoyakash@yahoo.com
ভোর ৬টায় রঞ্জনদার (বর্তমানে এটিএন নিউজে কর্মরত) ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। তিনি জানালেন, দুলাল, আপাকে (শেখ হাসিনা) গ্রেফতার করেছে; টিভি খুলে দেখ। টিভিতে চোখ রাখতেই গ্রেফতারের প্রস্তুতি দেখে বিস্মিত হই। সকাল ৯.৪৫ মিনিটে অফিসে পৌঁছি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের দুই বাড়ি আগে শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড)। দেখি বেবী আপা টিভি রুমে। সিএসবি চ্যানেলটি সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আমি পাশের একটি চেয়ারে বসি। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কেমন যেন শোকাবহ পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর বেবী আপার মোবাইলে একটি ফোন এলো। তিনি কিছু না বলেই বের হয়ে গেলেন।
দুপুর দু’টার পর পরই অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। অফিসে ওয়ালিদ, মনির ও আমি। চারদিকে এক ধরনের নীরবতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি। রাস্তায় লোকজন খুব কম। কেমন যেন থমথমে ভাব। ওয়ালিদ (বিচিত্রার সার্কুলেশন ম্যানেজার) বলল, চল, সবাই চলে গেছে আমরাও যাই। আপা (বেবী আপা) মনে হয় আজ আর আসবেন না। আমি বললাম, দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করি। বিচিত্রার চাকরি জীবনের প্রায় নয় বছরে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেবী আপা অফিস থেকে যখনই বের হন না কেন, অফিস বন্ধ হওয়ার আগে একবার আসেন। বরাবরের মতো আমি আর মনির (অফিস সহকারী) অপেক্ষা করি।
বিকেল তিনটার কিছু বেশি হবে। বেবী আপা তাঁর রুমে ঢুকেই মনিরকে ডাকলেন। ৪/৫ মিনিট পর আমি ইচ্ছা করেই আপার রুমে যাই। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, আপা বইয়ের সেলফ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই বের করছেন, কিছু বই ইতোমধ্যে টেবিলেও রেখেছেন। আমাকে দেখে বললেন, দুলাল মনির আসুক, তোমাকে প্রেসক্লাব যেতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছু বললাম না। বুঝলাম আপার মনের অবস্থা ভাল না। আপা বললেন, তুমি এখন যাও আমি ডাকব।
৫ মিনিট পর মনির এসে বলল, দুলাল ভাই ফুপু ডাকছেন। (মনির বেবী আপাকে ফুপু বলে সম্বোধন করতেন)। আমি আপার রুমের দিকে এগুচ্ছি, পেছনে মনির। মনির বলল, দুলাল ভাই ‘জরুরী’ খবর আছে।
আমি রুমে ঢুকতেই বেবী আপা বললেন, এখানে ২০ কপি আছে তুমি প্রেসক্লাব গিয়ে আজাদের (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি) কাছে দেবে। আজাদকে তোমার কথা বলা আছে। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে যাও। আমি বুঝতে পারলাম, এটা বড় আপার হাতের লেখা। কারণ পাশেই মূল কপিটা রাখা ছিল। আমরা বিচিত্রায় যারা চাকরি করতাম তারা সবাই শেখ হাসিনাকে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বড়আপা এবং রেহানা আপাকে ছোটআপা বলেই ডাকতাম। বিচিত্রায় চাকরি করার সুযোগে শেখ হাসিনার হাতের লেখার সঙ্গে আমার একটা পরিচয় রয়েছে। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই বিচিত্রায় কম্পোজ হতো এবং এক পর্যায়ে সংশোধনের জন্য আমার কাছে আসত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত ডায়রি’র কাজে কয়েকবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ফকরুল আলম স্যারের বাসায় যেতে হয়েছে। ডায়রির বাংলা কম্পোজের পর ইংরেজী করার জন্য স্যারের বাসায় বেবী আপা আমাকে পাঠাতেন। আমি অফিস ছুটির পর স্যারকে এগুলো পৌঁছে দিতাম।
আমি আমার সিটে গিয়ে ব্যাগটি গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটটি ব্যাগের একটি ভাঁজে রাখলাম। ওয়ালিদকে বললাম উঠো। টেবিল ছেড়ে উঠতেই বেবী আপা ডাকলেন দুলাল। আমি কাছে যেতেই ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি যাও, দেরি করো না। আর শোন, আজাদকে বলবা যাঁরা আওয়ামী লীগ বিট করেন তাদের ফোনে ডেকে হাতে হাতে দিতে। ঠিক আছে আপা, বলেই আমি বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমেই ওয়ালিদ বলল, আমি তোমার সঙ্গে নেই। আমি বুঝলাম এটি তার দুষ্টুমি। বেবী আপা আমাকে এর আগে যত দায়িত্বই দিয়েছেন তার সবগুলোতে ওয়ালিদ কোন না কোনভাবে আমাকে সহায়তা করেছে।
আমরা মিরপুর থেকে আসা (৯ নম্বর) একটি লোকাল বাসে প্রথমে নিউমার্কেট যাই। নিউমার্কেটে গিয়ে বাস আর যাবে না। পরে নিউমার্কেট থেকে রিক্সায় প্রেসক্লাব যাই। ওয়ালিদ পল্টনে প্রেসে চলে যায়। প্রেসক্লাব গেট থেকে আমি আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তিনি বললেন আমি ভেতরে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি আজাদ ভাই মাঠে পায়চারি করছেন। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সংখ্যাও আজ কম।
আজাদ ভাই আমাকে দেখে বললেন কই দেও। প্যাকেটটি হাতে দিতেই তিনি কি যেন বলতে চাইলেন। আমি বললাম, আজাদ ভাই বেবী আপা বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিট যাঁরা করেন তাঁদের ডেকে হাতে হাতে দিতে।
তিনি আমার দিকে তাকালেন। আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলত বিচিত্রা অফিসেই। সম্ভবত ২০০২ সালে। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উপদেষ্টা জাওয়াদুল করিম ভাই বিচিত্রা অফিসে (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) একটি কক্ষে বসতেন। সেখানে নেত্রীর প্রেস সংক্রান্ত কাজ চলত। শোকবাণী, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বাণী সবই তখন এখান থেকে দেয়া হতো। জাওয়াদুল করিম ভাইকে সহায়তার জন্য এক সময় আসলাম সানী ভাইকে নিয়োগ দেয়া হয়। বেবী আপার নির্দেশে আমিও জাওয়াদ ভাইকে সহায়তা করতাম। আজাদ ভাই আসার আগে এখানে কিছুদিন কাজ করেছিলেন পিআইডির সদ্য সাবেক প্রধান হারুন-উর-রসিদ ভাই। আজাদ ভাই আসার পর হারুন ভাই আর আসতেন না। জাওয়াদ ভাই মারা যাওয়ার পর আজাদ ভাই পুরো দায়িত্ব নেন। সানী ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর যতদিন বিচিত্রা অফিসে নেত্রীর প্রেস অফিস ছিল ততদিন কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা কম্পোজ করত। আমি তা সংশোধন করে দিতাম। অনেক সময় বেবী আপা আমাকে ফোনে বলতেন অমুক যাবে তাকে একটি শোকবাণী অথবা কোন কাগজ রেডি করে রাখো। আমি এসে দেখব। পরোক্ষভাবে সেসময় বেবী আপাও নেত্রীর প্রেসের দায়িত্ব পালন করতেন।
-আজাদ ভাই খুলে পুরো চিঠিটা পড়লেন।
-আমি বললাম, আজাদ ভাই আমি কি আপনাকে কোনভাবে সহায়তা করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি কোন্দিকে যাবে। আমি বললাম, মতিঝিলের দিকে। তিনি আমাকে ৬টি কপি দিয়ে বললেন। যাবার পথে এগুলো সংবাদ, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, অবজারভার অফিসে দিয়ে যাবে। একটা বেশি আছে প্রয়োজনে ফটোকপি করে নিও।
প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে প্রথমে রঞ্জনদাকে ফোন দিলাম। রঞ্জন সেন (বিচিত্রার সাবেক কর্মী) তখন সংবাদের রিপোর্টার। রঞ্জনদা বললেন, আমি অফিসে।
সংবাদে ঢুকেই রঞ্জনদাকে একটি কপি দিলাম। তিনি দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে বার্তা সম্পাদক হয়ে নির্বাহী সম্পাদকের রুমে গেলেন। খুব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম যুগান্তর অফিসের উদ্দেশ্যে। রিসিপশনে দাঁড়িয়ে ফজলুর রহমানকে (তিনিও বিচিত্রার সাবেক কর্মী, বর্তমানে সকালের খবরের চীফ রিপোর্টার) ফোন দিলাম। তিনি বললেন, উপরে আস। হাতে একটি কপি দিলে তিনি দ্রুত সাইফুল ভাইকে (বর্তমানে যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক) দিলেন। কোথায় পেলাম জানতে চাইলে বললাম বেবী আপা দিয়েছে। সাইফুল ভাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমার দিকে পরপর দু’বার তাকালেন, বললেন, যাও সাবধানে যেও। ফজলু ভাই আমার সঙ্গে নিচে নামলেন এবং আমাকে বললেন, এখন কোথায় যাবে। আমি বললাম ইত্তেফাক, ইনকিলাব। বললেন সাবধান, ব্যারিস্টার মইনুলের পত্রিকা কিন্তু।
আমি একটা রিক্সা নিয়ে ইত্তেফাকের গেটে নেমে উপরে উঠে প্রথম ফরাজী আজমল ভাইকে খুঁজলাম। দেখি তিনি অফিসে নেই। পরে জাহিদুর রহমান সজলকে খুঁজলাম সেও বাইরে। আমার পরিচিতদের মধ্যে আবুল খায়ের, স্পোর্টসের কাশীদা অফিসে থাকলেও তাদের কাছে দেয়াটা নিরাপদ মনে করলাম না। নিচে নেমে দুটো খাম কিনে ভেতরে একটি করে কপি ইত্তেফাক ও ইনকিলাব পত্রিকার প্রেস রিলিজ বক্সে রাখি। পরে আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তাঁকে বিস্তারিত বললাম এবং আমার কাছে দু’টি কপি আছে বললাম। তিনি বললেন ঠিক আছে, তুমি কাছাকাছি থেকো। প্রয়োজনে ফোন দেব। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা হলো না। হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল মসজিদ মার্কেটে অর্থকণ্ঠ অফিসে গেলাম। পত্রিকাটির মালিক আমার বন্ধু এনামুল হক এনাম। অফিসে বসে দুই গ্লাস পানি খেলাম। ভাবলাম বেবী আপাকে একটা ফোন দেই।
-প্রথমবার তিনি ধরলেন না। দশ মিনিট পর আবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেই বললেন, দুলাল বলো। আপাকে বিস্তারিত বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে বাসায় চলে যাও।
এবার এনামের রুমে গিয়ে তার হাতে একটি কপি দেই। সে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ৫টি ফটোকপি করিয়ে আনে। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্থকণ্ঠ অফিসের সবাই জেনে যায়।
ওয়ালিদকে ফোন দিলাম। বলল, আমি প্রেসে, আসবা। আমি বললাম, মতিঝিল এনামের অফিসে আছি। মতিঝিল হয়ে যাও।
-সে বলল না দেরি হবে, তুমি চলে যাও, কাল সকাল সকাল এসো।
ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই, যানবাহনও কম, দু’একটা রিক্সা চলছে। রিক্সা না পেয়ে হেঁটেই বাসায় চলছি। ভাবছি ১৯৭১ সাল আর ২০০৭ সাল। ব্যবধান ৩৬ বছরের। স্বাধীনতার সমবয়সী আমি। আমার যখন জন্ম হয় তখন এদেশে চলছে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতা।
মা-বাবার কাছে শুনেছি, আমার জন্মের সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা। মার কোলে করে শরণার্থী হয়েছিলাম আমি।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস মেসেজের কথা আজ ইতিহাসের অংশ। পেশার কারণে অসংখ্যবার পড়েছি। লেখায় ব্যবহার করেছি। সেই মেসেজটিতে জাতির জন্য যে নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন দেশবাসী সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমরা মুক্ত হলাম, দেশ স্বাধীন হলো। ৩৬ বছর পর অন্যায় শাসন আর অরাজকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা জেলে। তাঁর এই মেসেজটি (চিঠি) এদেশের জনগণকে উদ্দেশ করে লেখা।
আমি বঙ্গবন্ধুর ম্যাসেজ আর আজ তাঁর কন্যার মেসেজটি তুলনা করলাম। দুটোতেই মুক্তির কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা রয়েছে। দুটোই মুক্তির সনদ। একটি দেশকে শত্রুমুক্ত করে দেশ স্বাধীন করতে অন্যটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায়, অগণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতে। যে সংগ্রাম শেখ হাসিনা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
মনিরের কথা মনে পড়ল, দুলাল ভাই ‘জরুরী’ খবর আছে ...।
ajoyakash@yahoo.com
No comments