শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর মূল নেতা গো. আযম-যুদ্ধাপরাধী বিচার-এসপি মাহবুবের জবানবন্দী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) এসপি মাহবুব জবানবন্দীতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগী বাহিনী শান্তি কমিটি, আল-বদর, রাজাকার বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।


আর জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতা হিসেবে গোলাম আযম তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রবিবার তিনি জবানবন্দী শেষ করেছেন, আজ আসামিপক্ষের আইনজীবী তাঁকে জেরা করবেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি এ জবানবন্দীতে এ কথা বলেছেন।
অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক জবানবন্দী প্রদান করেছেন। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাকে জেরা করেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফাজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তিনি এই সাক্ষ্য দেন। একই ট্রাইব্যুনাল একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
গোলাম আযম ॥ সকাল ১১টায় প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাক্ষী এসপি মাহবুবের জবানবন্দী গ্রহণের সাহায্য করেন। তিনি এ মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী। নিজের পরিচয়ে তিনি বলেন, আমার নাম মাহবুব উদ্দিন আহমদ, পিতা মৃত আলতাফ উদ্দিন আহমদ। তাঁর বয়স ৬৭ বছর। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২৬ বছর। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। তারপর তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে সাতকানিয়া চলে যান। এরপর সেখান থেকে ঝিনাইদহে আসেন। তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধ করেন। এর ওপর তিনি আদালতে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন।
জবানবন্দীর একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমাদের বাহিনীর হাতে সে সময়ে অনেক রাজাকার ধরা পড়ে। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পাই। রাজাকারদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে দেখি। গ্রামের পথগুলো তারা (রাজাকাররা) চিনিয়ে দিত। তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনকে ধরিয়ে দিত। তাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দিত। চুক নগরগ্রামে এই রাজাকার বাহিনীরা গণহত্যা চালায়। এ রকম গণহত্যা বাংলাদেশের সর্বত্র করা হয়েছে বলে শুনেছি। এই গণহত্যা, নারী নির্যাতনের সঙ্গে লুটপাট বাড়িঘরে আগুন দেয়া, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এই সবই সংঘটিত করেছে এই রাজাকার আলবদর, আল-শামস বাহিনী। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় মিরপুরে এরা জাতির কৃতী সন্তানদের হত্যা করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছে।
জবানবন্দীতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ঝিনাইদহ জেলার সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (বর্তমান এসপি পদমর্যাদা) ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে গার্ড অব অনার দেয় যে দলটি, তার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তিনি জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটি গঠনের জন্য যাঁরা জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন আমি শুনেছি তার মধ্যে গোলাম আযম, নুরুল ইসলাম ও খাজা খয়েরউদ্দিন ছিলেন। ১৯৭১ সালে জামায়াত ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের মাধ্যমে রাজাকার, আল বদর ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এ বাহিনীকে সশস্ত্র করতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গোলাম আযম দেখা করেছেন বলে আমি শুনেছি এবং স্বাধীনতার পর দেখা করার ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি।
সাক্ষী এসপি মাহবুব তাঁর জবানবন্দীতে আরো বলেন, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর যাঁরা আগ্রহী ছিলেন তাদের সশস্ত্র করা হয় এবং তাদের বেতন-ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, এ বাহিনী যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখিয়ে দেয়া, সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে আসা, বাড়িঘর লুট করা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়াসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এ ছাড়াও এ বাহিনী নিজেদের দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে দাবি করত। সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম বলেন, একাত্তর সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্বে দিয়েছে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। বড় দলের নেতা হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীরা এই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এর নেতৃত্ব দিয়েছে গোলাম আযম।
এর আগে সাক্ষী মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত যুদ্ধের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি তাঁর জবনাবন্দীর শুরুতে বলেন, আমার নাম মাহাবুব উদ্দিন আহম্মদ বীর বিক্রম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বয়স আনুমানিক ২৬ বছর ছিল। আমি ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করি। পরে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের ক্যাডারে যোগদান করি।
পরে সাত কানিয়ায় পুলিশের (সেটেলমেন্ট) ট্রেনিংয়ে ছিলাম। সাতকানিয়া থেকে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য আমিসহ বন্ধুরা চট্টগ্রামে আসি। রেডিও বন্ধ করে দেয়ায় আমরা ভাষণ শুনতে পারিনি। সেখানে বসে পরিকল্পনা করি যে আমরা কর্মস্থলে ফিরে যাব। ওই স্থান থেকে সবাই মিলে যার যার কর্মস্থল ফিরে যাই। ১৮ মার্চ আমি চলে যাই ঝিনাইদহে এসডিপিও হিসেবে যোগদান করি।
ঝিনাইদহে এসডিপিও হিসেবে যোগ দিয়ে স্থানীয় লোকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গঠন, মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকাসহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল যশোরের ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ থেকে চার কোটি ৪০ লাখ টাকা ও বিশ কেজি সোনা তুলে নেই। পরে ওইসব টাকা ও সোনা ২৫ মে নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের কোষাগারে জমা দেই। তার রশিদ বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এর আগে তিনি তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদকে মুক্তিযোদ্ধাদের (সশস্ত্র) নেতৃত্বে গার্ড অব অনার দেয়া হয়, আমি তার দলনেতা ছিলাম। ১০ এপ্রিল এই সরকার আগরতলায় গঠিত হয়। সকাল ১১টা সাড়ে ১১টার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় কলকাতা থেকে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ অনেকেই আসেন। সঙ্গে বিবিসি, ভোয়া, রয়টার, প্রভৃতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউজ এবং টেলিভিশন ও ক্যামেরা ছিল। ১২টা সাড়ে ১২টার দিকে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী ও মোস্তাক আহম্মেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুপস্থিত থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন এই নবগঠিত সরকারকে একটা চৌকস মুক্তিবাহিনী সশস্ত্র দল আমার নেতৃত্বে সমস্ত বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এই গার্ড অব অনার দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
এসপি মাহবুব জবানবন্দীতে বলেন, ২৮ মার্চ আমার সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাতে ইপিআরের ৮ নম্বর উইংয়ের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং আমাকে চুয়াডাঙ্গা ডেকে পাঠান। সেখানে আমার বন্ধু তৌফিক এলাহীর সঙ্গে দেখা হয়। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী আমাকে ক্যাপ্টেনের ব্যাজ পরিয়ে দেন। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্তে। আগের দিন ঝিনাইদহের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং সশস্ত্রবাহিনীর সবাই ঝিনাইদহের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়।
২৯ মার্চ সকাল বেলা ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি জেকে এমএ আজিজ আমাকে খবর দেন ঢাকা থেকে ২ মেহমান এসেছেন, আপনি আসুন। তার বাসায় প্রায় ১১টায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে সীমান্ত পার করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমি তাঁদের অনুরোধে বন্ধু তৌফিক এলাহীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিকেল বেলা তাদের চুয়াডাঙ্গা হয়ে চ্যাংখালী বিওপির কাছ দিয়ে তাঁদের বিএসএফের হাতে হস্তান্তর করি। তাঁরা নিরাপদে সম্মানে দিল্লী নিয়ে যায়। ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ৮নং ইপিআর উইংয়ের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহের জনগণ, কুষ্টিয়া পাক বাহিনীকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩০ মার্চ এবং শেষ রাতে কুষ্টিয়ার জনগণ এবং আমাদের তরফ থেকে চুয়াডাঙ্গার প্রেরিত এক কোম্পানী ইপিআর কুষ্টিয়ায় আক্রমণ করি। কুষ্টিয়া লাখ লাখ মানুষ সেদিনের আক্রমণে আমাদের সহায়তা করেন। জয় বাংল, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান দিয়ে আকাশ, বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে এবং পাক বাহিনীর আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী ও জনগণের আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী শহরের তিন স্থান থেকে বের হয়ে জেলা স্কুলে সমবেত হয়। জনগণ জেলা স্কুলের চারদিক ঘিরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
পাকিস্তান বাহিনী তখন দিগি¦দিক হয়ে জ্ঞানশূন্য ঝিনাইদহের দিকে রাতের অন্ধকারে রওনা দেয়। ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য। পথে গেরামগঞ্জে ববি ট্রাফে পড়ে যায় এবং অনেক গাড়ি পড়ে যায়। অনেকের সলিল সমাধি হয়। তাদের উদ্ধার করতে যারা নিচে নামে তারা নদীর ওপার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। এ অবস্থায় সারারাত কামান-বন্দুক দিয়ে ঝিনাইদহের ওপর গুলি করে আর এই অবস্থায় তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে-গঞ্জে চলে যায়। সকাল বেলায় গ্রামীণ মানুষ তাদের ধরে ফেলে। সমস্ত গোলাবারুদ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ থানায় নিয়ে আসে।
লে. আতা উল্লাহ শাহ শৈলকুপায় বন্ধ দালানের ওপর আশ্রয় নিয়ে পাগলের মতো গুলি ছুড়তে থাকে। আমি নিজে আমার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঘেরাও করে গুলি ছোড়া বন্ধ করার আহ্বান করলে সে গুলি ছোড়া বন্ধ করে। তাকে আমরা গ্রেফতার করি এবং পিওডব্লিউ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেই। আমার জানা মতে, লে. আতা উল্লাহ শাহ একজন গ্রেফতারকৃত প্রথম পিওডব্লিউ। এটা ছিল পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ ২৭ নম্বর এস এ্যান্ড টি ব্যাটালিয়ন। পাকিস্তানী সৈন্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য আরেকটি দল পাঠায়। ১ এপ্রিল তারা বিষয়খালি এসে একই ভাবে পর্যুদস্ত হয়। সেখানেও মুক্তিকামী আরেকটি দল তাদের প্রতিহত করে এবং তারা পালিয়ে যায়।
এই দুদিনের যুদ্ধে আমাদের অনেকে আহত হয়। ৬ জন মারা যায়। নিহত দুজন ছিলেন স্থানীয় এলএমএ ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম সাহেবের দু’ছেলে। পরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার চিন্তা করি। এই যুদ্ধের ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সমস্ত অঞ্চল মুক্ত হয়। যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হই। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ মাইল উত্তরে বারো বাজারে আড়াআড়ি রেললাইনের পাশে ট্রেন্স কেটে অবস্থান গ্রহণ করি। পাকবাহিনী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে গোয়ালন্দ, ঈশ্বরদী, ঝিনাইদহ অঞ্চল হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ করে।
জবানবন্দীতে এসপি মাহবুব আরও বলেন, ১১ এপ্রিল পাকসেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। আমরা তাদের প্রতিহত করি। আমাদের চারদিক থেকে আক্রমণ করে। আমাদের পেছনে কালীগঞ্জেও অবস্থান করে। ফলে আমরা পেছন ও সামনে থেকে আক্রান্ত হই। এই অবস্থায় সেখানে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। আমি সদলবলে উইথড্র করে গ্রামের পথ দিয়ে ঝিনাইদহে চলে যাই। পাকিস্তানী বাহিনী অতি ধীরগতিতে অগ্রসর হয়ে ১৪ তারিখ ঝিনাইদহের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ঝিনাইদহে জেনারেল উইথড্রয়েল দিয়ে সবাইকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গার পথে রওনা হই।
যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ২০ কেজি স্বর্ণ তুলে নিয়ে যাই। এই টাকা-পয়সা পরবর্তীতে ২৫ মে বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা দেই। পরে সেই জমার রশিদ বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ১৪ তারিখ রওনা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর হয়ে সদলবলে ভারতীয় নিতাইক্যাম্পে উপস্থিত হই। পরদিন সকাল বেলা আমার বন্ধু তৌফিক এলাহী এবং আমি আমাদের ২ জনের থাকা গাড়ি নিয়ে কিছু সৈনিক নিয়ে বর্ডার ক্রস করে আবার মেহেরপুরের বৈদেরনাথ তালায় চলে আসি।
২৮ মে সাতক্ষীরার ভোমরার দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে ৯ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে নাস্তানাবুদ করেছি। তাদের ক্ষয়ক্ষতির কারণে পাকিস্তান আর্মি এদেশ থেকে এই রেজিমেন্টকে পুরোপুরি তুলে নেয়। তাদের মেজর ক্যাপ্টেনসহ অনেক অফিসার হতাহত হয়। তাদের লাশ উদ্ধার করেছি এবং সাতক্ষীরা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্মখু লড়াই করেছি। ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানী কাকডাঙ্গা বিওপি আক্রমণ করতে গিয়ে বালিয়াডাঙ্গায় অনেক সৈনিক হারিয়েছি। নিজেও আহত হয়েছি। আহত হয়ে ভারতের ব্যারাকপুরের সামরিক হাসপাতালে ৪ সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিলাম।
১৬ অক্টোবর পুনরায় আমার সাবসেক্টরে চলে আসি। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরার কলারোয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখি। এই যুদ্ধে শেষ অংশে ৮ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার হানাদার মুক্ত হয়। আমি দলবল নিয়ে মনিরামপুর প্রাথমিক স্কুলে অবস্থান নেই। ১৬ ডিসেম্বর খবর পাই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাক বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে।
তিনি জবানবন্দীতে বলেন, আমাদের সংগ্রাম প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানীদের ধীরে ধীরে কিছু রাজাকার আলবদর ধরা পড়ে। তাদের কাছে শুনেছি, বাংলাদেশ ১৯৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়ী হয়। বিরুদ্ধে প্রধান দল ছিল জামায়াতে ইসলামী। স্বাধীনতাবিরোধী মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছে সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। বড় দল হিসেবে বড় দলের নেতা হিসেবে গোলাম আযম এবং তার সাথীরা যারা এই পাকিস্তানের সহযোগী বাহিনীদের সম্পূর্ণ নিজের কমান্ডে নিয়েছিল, তারাই এই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। তাদের মূল নেতা ছিলেন, গোলাম আযম এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম জবানবন্দীতে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনে অর্থাৎ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজশাহী, নড়াইল, রবিশাল, খুলনা এই বিশাল অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই বিবরণ প্রদান করেন। রবিবার সকালে গোলাম আযমকে প্রিজন সেল থেকে আন্তজাতিৃক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হাজির করা হয়।
এর আগে ১ জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন তাঁর জবানবন্দী পেশ করেন। ১১ জানুয়ারি গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানান। এ আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
কামারুজ্জামান ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধ হামিদুল হক জবানবন্দী প্রদান করেছেন। পরে আসামি পক্ষের আইনজীবী তাঁকে জেরা করেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ তিনি এই জবনবন্দী ও জেরা প্রদান করেছেন।
জবানবন্দীতে মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক বলেন, তিনি ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের আলবদর ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমাকে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার প্রস্তাব দেন।’তিনি জানান, ময়মনসিংহ জেলা প্রশকের কার্যালয়ে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে তিনি ২৬ দিন বন্দী ছিলেন। ‘বদর বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার কামারুজ্জামান বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন এবং রাতের বেলা বিভিন্ন অপারেশনে যেতেন।’ আলবদর বাহিনী আনন্দমোহন কলেজে আক্রমণ চালায়। আমি শুনেছি সে আক্রমণে কামারুজ্জামান প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন করেন। সে অপারেশনে ডিগ্রি হোস্টেলের বেয়ারা শাহেদ আলীকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলেজের প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দিন বিষয়টি আমাকে বলেন।’
হামিদুল হক বলেন, ‘শেরপুরের নালিতাবাড়ির সোহাগপুরে একটি বড় হত্যাকা- হয়। সেখানে গ্রামে পুরুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলা হয়। পুরুষশূন্য সে গ্রাম এখন বিধবাপল্লী নামে পরিচিত। আরেকটি হত্যাকা- হয় সিরাজগঞ্জের বড়ইতলায়। এ ছাড়া ময়মনসিংহের ট্যাপা মিমার ছেলে দারা মিয়াকে হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে ট্যাপা মিয়া বেঁচে যান। তিনি বলেন, ‘বন্দী থাকা অবস্থায় দেখেছি, কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার সর্বাত্মক পরিকল্পনা করেন এবং পাকিস্তানকে রক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।’ জবানবন্দীর পর হামিদুল হককে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী কফিল উদ্দিন। আজ আবারও তাকে জেরা করা হবে। জেরার কিছু অংশ নিম্নে দেয়া হলো।
প্রশ্ন:আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এসএসসি কোন্ সালে পাস করেছেন।
উত্তর: ১৯৬৮ সালে।
প্রশ্ন: কোন্ বিভাগে।
উত্তর: দ্বিতীয় বিভাগে।
প্রশ্ন: দেখাতে পারবেন।
উত্তর: সব কিছু হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন: কবে জেলে গেলেন।
উত্তর: বিএনপি, আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির সরকারের আমলে।
প্রশ্ন: আপনি এইচ এসসি তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন। অসত্য কথা বলেছেন।
উত্তর: অসত্য। মান উন্নয়ন পরীক্ষা দিয়েছি।
প্রশ্ন: কোন্ বছর।
উত্তর: ৬৮ সালের পরে।
প্রশ্ন: এমএ পাস করেন কবে।
উত্তর: পাস করার আগেই রাজনীতিতে ঢুকে পড়ি। আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
প্রশ্ন: কখন গ্রেফতার হন। জেল থেকে পালিয়েছিলেন।
উত্তর: ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে। থানা থেকে একবার আবার জেল থেকেও একবার পালিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: কামারুজ্জামানকে ১৯৭১ সাল থেকে চিনেন।
উত্তর: ১৯৬৮-৭৯ সাল থেকে চিনি।
প্রশ্ন: ঐ সময় তিনি কলেজের ছাত্র ছিলেন।
উত্তর: নাসিরাবাদ কলেজের ছাত্র ছিলেন বলে মনে হয।
প্রশ্ন: আপনার কলেজ থেকে দূরত্ব কত।
উত্তর: এক থেকে দেড় মাইল।
প্রশ্ন: উনি কোথায় থাকতেন।
উত্তর: লজিং এ থাকতেন।
প্রশ্ন: কার বাড়ি থাকতেন।
উত্তর: জানি না।
প্রশ্ন: কামারুজ্জামান ইসলামী ছাত্র সংঘের কোন্ পদে ছিলেন।
উত্তর: মনে নেই।
মুজাহিদ ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রবিবার সকালে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্ব তিন সদস্যের বেঞ্চে শুনানি শেষে এই আদেশ দেয়া হয়।
৭ জুলাই আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনালের দেয়া আদেশ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সুনির্দিষ্ট সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। এ আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আসামি পক্ষ এ আবেদন দাখিল করেন।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে ১৯ জুলাই প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপনের তারিখ ধার্য রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আসামি পক্ষকেও তাদের সাক্ষীদের তালিকা এবং অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ দাখিল করতে বলা হয়েছে। গত বছরের ১ নবেম্বর জামায়াত নেতা মুজাহিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। ২৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়।২০১০ সালের ২৯ জুন একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক দেখানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.