‘দুইটু ট্যাকার জন্য দুইটু জান চইলি গেল!’-আকিজের কারখানায় আনসারের গুলিতে দুই শ্রমিক নিহত

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় আকিজ বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে গতকাল রোববার মালিকপক্ষের লোকজনের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যদের গুলিতে নিহত হন দুই শ্রমিক। আহত হন আরও কমপক্ষে ১০ শ্রমিক।


নিহত শ্রমিকেরা হলেন, দৌলতপুর উপজেলার বৈরাগীরচর গ্রামের ভাদু মণ্ডলের ছেলে রাকিবুল ইসলাম (২০) এবং একই গ্রামের কছিমুদ্দিন মণ্ডলের ছেলে মিন্টু (৩৫)।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে গতকাল রাতে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মল্লিক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আকিজ বিড়ির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আজিজ উদ্দিন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের একজনকে চাকরি দেওয়া এবং আহত দুজনের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি মেনে নিয়েছেন। কারখানার ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলমকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। আনসার সদস্যদের অস্ত্র জব্দ করে তাঁদের থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটার দিকে দৌলতপুরের হোসেনাবাদ এলাকায় আকিজ বিড়ি কারখানা এলাকায় গেলে শ্রমিকেরা জানান, এক হাজার বিড়ি তৈরি করতে মালিকপক্ষ ২১ টাকা দিত। শ্রমিকেরা এ টাকা বাড়িয়ে ২২-২৩ টাকা করে দেওয়ার দাবি জানান। এ নিয়ে দুই মাস ধরে শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে। ওই সময় কারখানার ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম জানিয়েছিলেন, দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) উপস্থিতিতে ১৫ জুলাই (গতকাল) মজুরি বাড়ানো হবে।
শ্রমিক শহিদুল ইসলাম বলেন, গতকাল সকালে কাজে এলে ব্যবস্থাপক খোরশেদ জানান, মজুরি বাড়ানো হবে না, যা আছে তাতেই কাজ করতে হবে। নইলে কাল থেকে সবার ছুটি।
পুলিশ ও শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, খোরশেদের এই কথা ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত হয়ে পড়েন শ্রমিকেরা। কারখানায় প্রায় দুই হাজার ৬০০ শ্রমিক কাজ না করে কারখানার বাইরে বিক্ষোভ করতে থাকেন। শ্রমিকেরা কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে তাঁদের ওপর চড়াও হন কারখানার নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্য ও কর্মকর্তারা। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকেরা বলেন, একপর্যায়ে আনসার সদস্যদের ছোড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই এক শ্রমিক নিহত হন। দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় আরও এক শ্রমিকের। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন নজরুল ইসলাম ও মনিরুল ইসলাম নামের দুজন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়।
খবর পেয়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আহত শ্রমিকদের মধ্যে নজরুলের পেটে গুলি লাগায় তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
শ্রমিক শহিদুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাত্র দুইটু (দুই টাকা) ট্যাকার জন্য দুই দুইটু তাজা জান চইলি গেল।’ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আকিজ বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তিনি তাঁর ছোট ভাইকে খুঁজতে কারখানার দিকে ছুটে যান। এ সময় কারখানার কর্মকর্তাদের ভবনের তিনতলার বারান্দা থেকে আনসার সদস্যরা শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। এতে তাঁর ডান পায়ে গুলি লাগলে তিনি মাটিতে লুটে পড়েন।
কথা হয় দৌলতপুর উপজেলা আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ওমর ফারুকের সঙ্গে। আকিজ বিড়ি কারখানায় দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বরাত দিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আকিজ বিড়ি কারখানায় ১৫ জন আনসার সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন। এর মধ্যে গতকাল ছুটিতে ছিলেন দুজন। শ্রমিকদের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে কারখানা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আনসার সদস্যরা ১০টি গুলি ছোড়েন।
কারখানার ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, সকালে শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। দিতে না পারায় শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে কারখানার ভেতরে আন্দোলন করতে থাকেন। শ্রমিকেরা কারখানায় হামলা চালিয়ে তাঁকেসহ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করেন এবং ভাঙচুর করেন।
আনসার সদস্যদের গুলি করার নির্দেশ দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘অসুস্থ’ দাবি করে খোরশেদ আলম কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এ ব্যাপারে জানতে আকিজ বিড়ি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আজিজ উদ্দিনের মুঠোফোনে কল ও খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রেজা বলেন, দুটি লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আনসার সদস্যদের ছোড়া গুলিতে দুজন মারা গেছেন। কারখানা প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.