সম্পর্কের টানাপোড়েন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে নানা জটিলতা এসে ভিড় করছে, যা সামাল দিতে আমাদের নিত্য হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধ ও আদর্শগুলো ক্রমেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিক সামাজিক কালচারের দাপটে।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক কর্পোরেট সমাজব্যবস্থায় শুধুমাত্র পরিবারই পরিবর্তনের ধাক্কায় আক্রান্ত নয়। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পারস্পরিক আচরণ, সামাজিকতা, লৌকিকতা, এমনকি ধর্মীয় আচার পালনেও ভিন্নতার ছোঁয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগের মতো যৌথ পরিবার ব্যবস্থা আজকাল আর নেই। নানা বাস্তবতায় এখন একক পরিবারের আধিপত্য চোখে পড়ছে শহরের সারি সারি বহুতলা ভবনের ফ্ল্যাট আর এ্যাপার্টমেন্টকেন্দ্রিক একক পরিবারগুলো এক সময় বড় বড় যৌথ পরিবারেরই অংশ ছিল। নানা প্রয়োজনে সময়ের দাবি পূরণ করতে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গড়ে তুললেও এখানে সঙ্কটের শেষ নেই। একক পরিবারের বড় একটি সমস্যা হলো, এখানে পারিবারিক সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরে এখানে খুব সহজেই। পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বাস ও আস্থার অনেক ঘাটতি থাকে। সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন চলতে থাকে সারা সময়েই। আর এই সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন আর জটিলতার শিকার হয় পরিবারের সন্তানরা। তাদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় চরমভাবে। তারা উদারভাবে কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না। সব সময়ে একটা ভয় আর অনিশ্চয়তাবোধ তাদেরকে তাড়া করে ফিরে। তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে গিয়ে এক সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যার প্রকাশ আমরা এখন দেখছি আমাদের চারপাশে। নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েরা আজকাল হতাশা, বিষণœতা, আত্মকেন্দ্রিকতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সামাজিক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যৌন অপরাধে এবং বিকৃতির দিকে ঝুঁকছে। এ সবের কোনটাই আমাদের কাম্য নয়। নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতা, ইমোশনাল ডিপ্রাইভেশন ও আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভুগতে ভুগছে আমাদের নতুন প্রজন্ম সম্ভাবনার বিপরীত পথে হাঁটছে। শুধু তাই নয়, একক পরিবারে যে কোন একজন সদস্যের অনুপস্থিতি তৈরি করছে নানা সঙ্কট। কারণ এখানে সব দিক থেকে সাপোর্ট দেয়ার মতো কেউ থাকছে না। একক পরিবারে স্থান হচ্ছে না বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। তাদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে নিভৃত নির্জন পরিবেশে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে তাঁরা ধুঁকে ধুঁকে চরম অবহেলা আর অযতেœ জীবনের শেষ সময়গুলো কোনভাবে পার করছেন। এর ফলে নাতি-নাতনিরা দাদা-দাদি, নানা-নানির স্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরমভাবে। তারা দাদা-দাদির, নানা-নানির কাছ থেকে অতীত দিনের নানা অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির কথা জানতে পারছে না। তারা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান বা ধারণা লাভ করতে পারছে না প্রবীণ অভিজ্ঞজনের অনুপস্থিতিতে। অনেক একক পরিবারে স্ত্রীর আপত্তি কিংবা অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ঠাঁই দিতে না পেরে আক্ষেপে দুঃখে ক্ষোভে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পুত্রহৃদয়। এভাবেই নানা টানাপোড়েনে আর সঙ্কটে বার বার ধাক্কা খাচ্ছে একক পরিবারগুলো।
সারাদিনে কর্মক্লান্তি শেষে আমরা আমাদের যে যার পরিবারে ফিরে এসে প্রশান্তি আর স্বস্থির বদলে চরম অশান্তি এবং টেনশনের যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরছি। সবাই এখন পরিবারের গ-িকে ছোট করে ফেলতে চাইছে, একা একা থাকতে চাইছে। নিজের সুখ, নিজের আনন্দই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে সবার চিন্তাভাবনায়। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে যেতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। এখন আমাদের নাগরিক জীবনধারা প্রভাবিত হচ্ছে সিনেমা, নাটক, টিভি চ্যানেলের দ্বারা। এক সময়ে বড়রা বাড়িতে ঢুকলে ছোটরা সংযত হয়ে যেত, পড়াশোনায় মন দিত। বাড়িতে বড় মুরব্বি গোছের কেউ এলে ছোটরা পারতপক্ষে সামনে যেত না। এখন আগের সেই মূল্যবোধ আর অটুট নেই। আজকাল ‘ফ্রিডম’ আর ‘ফ্রিনেস’ এতটাই আক্রান্ত করেছে যে পরিবারে কেউ কাউকে সহজে মানতে চাইছে না। খুব ছোট বয়স থেকেই সব কিছুতে তর্ক করা কিংবা দুর্বিনীতভাবে ভুল ধরিয়ে দেয়ার প্রবণতাই ফ্রিডমের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। এখন সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবারা আগের তুলনায় বেশি ফ্রি। কিন্তু এই ফ্রি হওয়ার সুযোগটা মঙ্গলজনকভাবে কাজে না লাগিয়ে খারাপ কাজে লাগাচ্ছে এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে। তারা বাবা-মাকে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। বাড়ির বাইরে থাকছে রাত হয়ে যাবার পরেও। এ বিষয়ে কঠিনভাবে শাসন বারণও করা যাচ্ছে না। তারা নানা রকমের দোহাই দিয়ে বাবা-মায়ের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাসায় বাবা-মাকে জানিয়ে তাদের মতামত নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করছে না। তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে তারা প্রায়ই বিপদে পড়ছে। আধুনিক যুগের এই নতুন উপাদান ফ্রিডম ও ফ্রিনেস বদলে দিচ্ছে আমাদের দীর্ঘদিনের মূল্যবোধকে। প্রবণতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর স্বাধীনতা মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে হয়ত বা কিন্তু একই সঙ্গে এর বিরূপ প্রভাবে নানা বিপর্যয় নেমে আসছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে। সবাইকে ভীষণভাবে সচেতন হতে হবে। অতীতের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাগুলো এত তাড়াতাড়ি অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার হয়ে গেছে ভাবলে চলবে না। আধুনিক সমাজে এগুলো অচল হয়ে যায়নি। তবে এগুলোকে সুকৌশলে নিজেদের পারিবারিক প্রয়োজনে সার্বিক মঙ্গলের জন্যে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনের অনেক সঙ্কট ঘুচবে।
ফারহানা তাসনিম
সারাদিনে কর্মক্লান্তি শেষে আমরা আমাদের যে যার পরিবারে ফিরে এসে প্রশান্তি আর স্বস্থির বদলে চরম অশান্তি এবং টেনশনের যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরছি। সবাই এখন পরিবারের গ-িকে ছোট করে ফেলতে চাইছে, একা একা থাকতে চাইছে। নিজের সুখ, নিজের আনন্দই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে সবার চিন্তাভাবনায়। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে যেতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। এখন আমাদের নাগরিক জীবনধারা প্রভাবিত হচ্ছে সিনেমা, নাটক, টিভি চ্যানেলের দ্বারা। এক সময়ে বড়রা বাড়িতে ঢুকলে ছোটরা সংযত হয়ে যেত, পড়াশোনায় মন দিত। বাড়িতে বড় মুরব্বি গোছের কেউ এলে ছোটরা পারতপক্ষে সামনে যেত না। এখন আগের সেই মূল্যবোধ আর অটুট নেই। আজকাল ‘ফ্রিডম’ আর ‘ফ্রিনেস’ এতটাই আক্রান্ত করেছে যে পরিবারে কেউ কাউকে সহজে মানতে চাইছে না। খুব ছোট বয়স থেকেই সব কিছুতে তর্ক করা কিংবা দুর্বিনীতভাবে ভুল ধরিয়ে দেয়ার প্রবণতাই ফ্রিডমের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। এখন সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবারা আগের তুলনায় বেশি ফ্রি। কিন্তু এই ফ্রি হওয়ার সুযোগটা মঙ্গলজনকভাবে কাজে না লাগিয়ে খারাপ কাজে লাগাচ্ছে এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে। তারা বাবা-মাকে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। বাড়ির বাইরে থাকছে রাত হয়ে যাবার পরেও। এ বিষয়ে কঠিনভাবে শাসন বারণও করা যাচ্ছে না। তারা নানা রকমের দোহাই দিয়ে বাবা-মায়ের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাসায় বাবা-মাকে জানিয়ে তাদের মতামত নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করছে না। তারা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে তারা প্রায়ই বিপদে পড়ছে। আধুনিক যুগের এই নতুন উপাদান ফ্রিডম ও ফ্রিনেস বদলে দিচ্ছে আমাদের দীর্ঘদিনের মূল্যবোধকে। প্রবণতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর স্বাধীনতা মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে হয়ত বা কিন্তু একই সঙ্গে এর বিরূপ প্রভাবে নানা বিপর্যয় নেমে আসছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে। সবাইকে ভীষণভাবে সচেতন হতে হবে। অতীতের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাগুলো এত তাড়াতাড়ি অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার হয়ে গেছে ভাবলে চলবে না। আধুনিক সমাজে এগুলো অচল হয়ে যায়নি। তবে এগুলোকে সুকৌশলে নিজেদের পারিবারিক প্রয়োজনে সার্বিক মঙ্গলের জন্যে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনের অনেক সঙ্কট ঘুচবে।
ফারহানা তাসনিম
No comments