রোহিঙ্গা বিতাড়নের লক্ষ্য বাংলাদেশ হতে পারে না-মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের ভ্রান্তি

রোহিঙ্গা সমস্যার আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছেন মিয়ানমারের সেনা-সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন। জাতিগত নির্মূলকরণের শিকার রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার থেকে বিতাড়নকেই’ এ সমস্যার সমাধান বলেছেন তিনি। এই বিতাড়ন কেবল অমানবিক ও নিষ্ঠুরতাই নয়, তা বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক।


বিতাড়নের তাড়াটা যে বাংলাদেশ অভিমুখে, সেটা ১৯৭৮ সাল থেকে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের এই নীতিনির্ধারণমূলক বক্তব্য যেহেতু আমাদের স্বার্থের বিপরীতে, সেহেতু সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া।
মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে বাস করে আসছে। আরাকানের ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্যে রোহিঙ্গাদের বসবাসের হাজার বছরের প্রমাণ নিহিত রয়েছে। ১৯৪৭ সালে বর্তমান গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সানের উদ্যোগে জাতিগত সমঝোতার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পাংলং সম্মেলনে মিয়ানমারের নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা সরকার প্রণীত সংবিধানেও রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা হয়। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিকত্ব হারায়। তাদের চাকরি-বসবাস-বিয়ে-সন্তান গ্রহণ, এমনকি চলাচলের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। অথচ পাংলং সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও সোয়ে থাইক বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই।’ ১৯৭৮ সালে আরাকানে বড় আকারের রোহিঙ্গা বিতাড়নের অভিঘাতে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আসা রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে পেরেছিল। ২০০৫ সালে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে নয় হাজার জনকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল।
সুতরাং, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার কেবল স্ববিরোধিতাই নয়, তা সভ্যজগতের আইনকানুনের পরিপন্থী। নিজ দেশের প্রায় আট লাখ মানুষকে অস্বীকার করে বিতাড়ন করা আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধতুল্য কাজ। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের ৩২ শতাংশ জনগণই শাসক বর্মি জনগোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য, তাদের এই সমস্যাটি মিয়ানমারের নোবেলজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সু চিও অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন হুমকি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের এই পরিকল্পনার সরাসরি শিকার হবে বাংলাদেশ। তৃতীয় কোনো দেশ আগ্রহী হলে সেখানেও পাঠানো হবে বলে তিনি যে ইঙ্গিত করেছেন, তার মধ্যে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাঁর এই ইঙ্গিত রোহিঙ্গা শরণার্থীতে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তির প্রতি হুমকি। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের করুণ পরিণতির বিষয়টি প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ উপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে প্রতিবাদ করা। আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘসহ বিশ্ব-জনমত ও বিশ্ব-গণমাধ্যমে মিয়ানমারের এই জাতিবিদ্বেষী ও অশান্তি সৃষ্টিকারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চাপ তৈরিরও কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের চাপে কাজ হয়, ২০০৫ সালের শরণার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তিই তার প্রমাণ।

No comments

Powered by Blogger.